পিতাহারাদের সাথে কিছুক্ষণ এবং নতুন জামা…
তিন তলার ছাদে এক বন্ধুর সাথে একান্তে আলাপ৷ রাতে৷ প্রিয়তমা বলল, নারী দিবস গেলো কী অধিকার দিলেন আমাকে এই দিবসে? দিলাম তোমাকে সোনালী কাবিন৷ ভালোবাসা৷ শুধুই ভালোবাসা৷ এই কথার বিনিময়ে রান্নার টাকা না চেয়ে আবার পায়েস পাঠালো রান্না করে৷ মেয়েদের রান্নার প্রশংসা করলে তাঁরা খুশী হয়৷ বাসার ছাদে আজই এলাম৷ চার দিকে আকাশচুম্বি ভবন হচ্ছে৷ গলগন্ডায় আমি দেখেছি টিনের ঘর৷ মেঠো পথ৷ এখন অপরিচ মনে হয়৷
দুই : মাদরাসা দারুল কুরআনে এলাম সকালে৷ পুরুস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান৷ ছাত্রদের উদ্দেশ্য কিছু কথা বলতে হবে৷ এই মাদরাসার সাথে আমি মন থেকে জড়িত৷ নানা অনুষ্ঠানে মুদীর দাওয়াত দেন৷ আমার ভালোবাসার একটি কারণ পিতাহারা কিছু তালেবে ইলম এই মাদরাসায় পড়ে৷ আজ ১৮জন পিতাহারা ছেলেকে নতুন জামা উপহার দেওয়া হয়েছে৷ কাপড় পড়ার দুআটি সম্মিলিতভাবে শিখালাম৷ সবাই জুব্বা পড়েছে৷ আমি নাহবেমীরের বছর পিতাহারা হই৷ আব্বু আমাকে ওপারে যাওয়ার আগে একটি ঘড়ি কিনে দিয়ে ছিলেন৷ একটি সাইকেল কিনে দিতেন বলে ছিলেন কিন্তু আব্বুর সেই সাইকেল পাওয়ার আগেই আব্বু আমাদের থেকে চলে যান কবর দেশে৷ এরপর বাদ দিয়ে ছিলাম পড়া লেখা৷ যাযাবরি জীবন থেকে আবার ফিরে আসি ময়মনসিংহে৷ মাদরাসায়৷ কল্পায় জায়গীর থাকতাম৷ কল্পার সাথেই কালিকাপুর৷ বিকেলে বেড়াতাম কালিকাপুর৷ মাদরাসা দারুল কুরআনের সাথেই আমার জায়গীর ছিলো৷ তবে তখন মাদরাসাটি ছিলো না৷ আমি ছিলাম ১৯৮৬/৮৭ সালের দিকে৷ মাদরাসা ২০০০ সালে শুরু৷ আজ মাদরাসা অনুষ্ঠানে এসে আমি ফিরে গেলাম অতীতে৷ পড়ার সময় সারা বছরেও একটি নতুন জামা পাইনি৷ পুরতান জামায় আসা যাওয়া করতাম৷ কাউকে বোঝতে দিতাম না আমার শূণ্যতা৷ বিকেলে কল্পার রাস্তায় হঠাৎ মনে হতো আব্বুর কথা৷ আমার সেই সাইকেলের কথা৷ আড়াই কিলো হেটে যেতাম মাদরাসায় মেঠো পথে৷ রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে৷
সারা বছর বাড়িতেও যেতাম না ভাড়ার অভাবে৷ বা বাড়ীতে গেলে আসার সময় আম্মু ভাড়া দিতে পারবেন না এবং আঁচল ভেজাবেন দেউরির ফাঁকে দাঁড়িয়ে৷ তারচে বাড়ীতে না যাওয়াই ভালো৷ কল্পা থেকে গ্রামের বাড়ী ৮০ কিলোমিটার দূরে৷
তিন : আজ পিতাহারা ছেলেদের মাথায় একটু হাত রাখলাম৷ একটু হাসলাম৷ আমি জানি তাদের মনে হাসি কম থাকে৷ বিষন্ন থাকে তারা৷ বাবার আদর থেকে বঞ্চিত৷ মা সব সময় তাদের খুঁজ নিতে পারেন না৷ মা একান্তে কাঁদেন৷ ছেলের আগামী নিয়ে ভাবেন৷ যারা এই পিতাহারা ছেলে মেয়েদেরকে একটু আশ্রয় দেয় একটু ভালোবাসা দেয় তারা কিন্তু সাদা মনের মানুষ এবং মহৎ৷ এতিম শব্দটি বললেও মনটা আনমনা হয় তাদের৷ কত আনন্দ কত ঈদ তাদের জন্য নিরানন্দ৷ ঈদের দিনেও তাদের স্মৃতিতে থাকে আব্বু৷ অন্যের জামা জুতো দেখে তাদের মনেও স্বাধ জাগে কিন্তু সব কি পূরণ হয়? মমতা কি কেউ দিতে পারে পিতার মতো৷
আমি মাঝে মাঝে পিতাহারদের সাথে মিশি৷ তাদেরকে একটু কথা দিয়ে হলেও সাহস দেই৷ আজও এলাম পিতাহারদের একটি পুরস্কার অনুষ্টানে৷ আমি জানি তাদের এই পুরস্কার কাকে দেখাবে বা কাকে বলবে তা নেই তাদের৷ মা হয়তো মনে মনে বলবেন তোর বাবা থাকলে খুশী হতেন আজ৷ কিন্তু ছেলের সামনে তাও বলেন না মমতাময়ী মা৷ আমরা ভোগবাদী সমাজে থাকি৷ পূঁজিবাদী সমাজে৷ পিতাহারাদের খুঁজ নেবার সময় কোথায়?
যার বাবাহারা তাদের নীরব কান্না কেউ শুনতে চায় না৷ কেউ বোঝতে চায় না৷ তবে কেউ কেউ কিছু বোঝে৷ তাদের নতুন জামা দেয়৷ বাবা যাদের আছে তাঁরা বোঝবেন না কী কষ্ট পিতার শূণ্যতার৷ আমি কিছু সময় কাটাচ্ছি এই পিতাহারাদের সাথে৷ আমাকে উপস্থাপন করতে হলো তাদের অনুষ্ঠান৷
আমরা যদি ব্যস্তার ফাঁকে সমাজের পিতাহারা ছেলে বা মেয়ের একটু খুঁজ নিতে পারি তাহলে তাদের মুখে কিছুক্ষণের জন্য হলেও হাসির রেখা থাকবে৷ আছে কি আমাদের হাতে সময়? কিছু অর্থ এবং একটি নতুন জামা৷ যা গোপনে দেবে কেউ পাশের কোনো পিতাহারাকে৷পড়ালেখার কিছু খরচ৷
চার : আমরা দুই ভাই চার বোন৷ কেউ এতিমখানায় বসবাস করে নাই৷ আমি সবাইকে ঢাকা ও ময়মনসিংহে রেখে পড়ালেখার খরচ দিয়েছি৷ সবাই হাফেয ও মাওলানা৷ বোনরা সবাই দাওরায়ে হাদীস পড়েছে৷ এক বোন হেদায়া পড়া অবস্থায় ওপারে চলে গিয়েছো৷ আল্লাহর খাস রহমতে এবং আম্মুর দৃঢ়চেতা মনোভাব, দুআয় আমরা এখন সবাই শহরে থাকি৷ সবাই শিক্ষকতার সাথে জড়িত৷ আমার জীবনটা উদ্বাস্তু সেই আব্বু ইন্তেকালের পর থেকই এবং যাযাবরি জীবন৷ এই উদ্বাস্তু জীবনে তিন তলার ছাদে বসে পায়েস খাই এবং আনন্দ পাই পিতাহারাদের কাছে এসে৷ কত বিচিত্র এই জীবন৷ উদ্বাস্তু জীবন৷ যাযাবরি জীবন৷