তাজ উদ্দীন হানাফী ::
বায়তুল মাক্বদিস, এটি সকল ধর্মের সম্মানের স্থল, ভালোবাসার জায়গা, ভক্তির শেষ সীমানা। সকল ধর্মের করায়ত্বে হলেও এটি নৈতিক দিক থেকে মুসলমানদের ধর্মীয় এবং নেতৃত্বের কেন্দ্রস্থল। নানাবিধ সমস্যায় মুসলিম বিশ্ব আজ জর্জরিত। মুসলমানদের ঈমানী ও আমলী দুর্বলতার সুযোগে তাদের মধ্যে ভয়াবহ অনৈক্য সৃষ্টি করে বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ তাদের স্বার্থান্ধ সকল ক্ষমতাই এখন তাদের হাতের মধ্যে। বিশ্বের অর্থনৈতিক সামাজিক সকল সংস্কৃতির ধারক আজ তারাই। মুসলমানদের মধ্যে আন্তর্জাতিক ইহুদী-খৃষ্টীয় চক্র মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নী, আরব-অনারব, আরব-তুর্কী এবং আরব-পারস্য ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের বিভাজনী উপাদান ছড়িয়ে দিয়ে তাদেরকে আজ খণ্ড-বিখণ্ড করছে। ফলে বিশ্ব মুসলিমের উপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছে শোষণ বঞ্চনা আর জুলুম নির্যাতনের স্টিমরুলার। আল আক্বসার দিকে চেয়ে কি সেই অত্যাচার নির্যাতনের কথা আমাদের মনে একটুও পীড়ার সঞ্চার করেনা?
মাসজিদে আক্বসা একত্ববাদে বিশ্বাসীদের
ইতিহাসের পাঠ বলে বায়তুল মোকাদ্দাস একত্ববাদদীদের। বায়তুল মোকাদ্দাসকে প্রথম হযরত দাউদ আ. তার রাজত্বের রাজধানী স্থাপনা করেন এবং বিশাল ইবাদতগাহ নির্মাণ করার প্রয়াসে হাত দেন, যা হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম এর জ্বিন দ্বারা সমাপ্তি ঘটে। এর পরের ধারাবাহিকতায় বায়তুল মোকাদ্দাস ঈসা আলাইহিস সালাম এর সময়ে পবিত্রতার মর্যাদা বাস্তব রূপ লাভ করে। তার পরের ক্রমান্বয় নবুওত প্রাপ্তির পর আমাদের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম এর অধীনেই তা পবিত্রতার চরম শৃঙ্গে পৌঁছে। মাসজিদে আক্বসা প্রথম ক্বিবলায় রূপান্তরিত হয়। এরই ধারাবাহিকতা মেরাজ রজনীতে সকল নবীর মুক্তাদী আর আমাদের নবীর ইমামতির স্মৃতিকথা এই মাসজিদে আক্বসার মধ্যে সংঘটিত হয়। ক্রমান্বয় যখন হযরত ওমরের খেলাফত কাল, ইসলামের ছায়া তখন শুধু আরবে নয়, বিশ্বের দূরদেশে ছড়িয়ে, অর্ধজাহান তখন মুসলিম শাসক ওমর রাযি. এর অধীনে। আরবী সন্তান যাদের ছিলনা রূম পারস্যের সাথে পাল্লা দেওয়ার কোন ইস্পাত কঠিন মনোবল, তাদের বিরুদ্ধবাদ করতে যাদের ছিলনা একটু সাহসের জুড়ি, সেই সন্তানের নেতৃত্বে আজকের বিশ্ব, এ যেন খোদ মাওলা পাকেরই সাহায্য। যেন আল্লাহর পক্ষ থেকে নুসরাতের কোন বিশেষ অনুপম দৃষ্টান্ত। পারস্যের শাষকের তখত বরাবর ওমর রাযি. এর চিঠি; এ যেন ছিল এক দুঃসাহসী কোন বীরত্বকাব্য। আরবের মরুভূমি তপ্ত মরীচিকায় বিকালের রোদসীতে শায়িত দেখে আগত পারস্য সেনাবাহিনীরা হয়েছিল কিংকর্তব্যবিমূঢ়, এ কোন শাষক! এ কোন নীতির পরিচালক!! ফুরাত নদীর ওপারে কোন কুকুরের মৃত্যু ঘটলে অনাহারে, “আমি ওমর জবাবদিহিতার কাটগড়ায় কিভাবে বিজিত হব”এ কেমন শাষকের দায়িত্ববোধ?
৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ২০ আগস্ট ঐতিহাসিক ইয়ারমুক যুদ্ধের মাধ্যমে খ্রিষ্টানদের হাত থেকে মুসলমানরা এ পবিত্র নগরীর কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। সে সময় খলিফা হযরত ওমর রা. নিজের ভৃত্যকে উটের পিঠে বসিয়ে সেই উটের রশি টানতে টানতে জেরুজালেম নগরীতে এসে ইসলামের বিজয়ের ইতি ঘটান। সমুন্নিত করেন ইসলামের ঝাণ্ডাকে। জীবনে দুটি স্বপ্ন দেখেছিলেন, এক- হজ্ব করা। দুই- মুসলমাদের প্রথম ক্বিবলা মাসজিদে আক্বসা খৃস্টানমুক্ত করা। একটি স্বপ্ন পূরণ হলেও হল না হজ্ব করা। টাকার অভাবে হজ্ব গমনে যেতে পারেননি এই মুসলিম সেনাপতি, অবশেষ নিজ কাংখিত বায়তুল মোকাদ্দাস জয় করেন।
সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী রাহ. দুঃসাহসী সফল এক যোদ্ধার নাম। বিজিত এক সমরনায়ক। অসাধারণ এক সেনাপতি। ইসলামের শত্রুরা আজও তাঁকে সম্বোধন করে “গ্রেট সালাদিন বলে”। মুসলিমবিশ্ব স্মরণ করে জাতীয় বীর হিসেবে। মুসলিম মিল্লাতের ইতিহাসের পাতায় সোনার হরফে লেখা রয়েছে তাঁর নাম। যাঁর হাত ধরে ৫৮৩ হিজরিতে ফিরে পেয়েছিলাম আমাদের প্রথম ক্বিবলা “বায়তুল আক্বসা” কিন্তু আফসোস আজও মুসলিম বিশ্বের জন্য। জবাব দিতে পারলাম না লর্ড কার্জন এর কথার “আমরা মুসলিমদের মেরুদণ্ড খিলাফতকে ধ্বংস করে দিয়েছি, তারা আর দাঁড়াতে পারবে না।” তারা সেই সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর কবরে লাথি মেরে বলল- উঠো সালাহুদ্দীন, তোমার বায়তুল মুকাদ্দাসকে রক্ষা কর। আর আমরা কি করলাম? পেরেছি কি সেই খিলাফতকে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করতে? পেরেছি কি সেই বায়তুল মুকাদ্দাসকে আবার ফিরিয়ে আনতে?
উত্তর হবে- না। এখনো নয়, পারিনি, পারার বেলায় কিছুটা নিরন্তর, যা পারার নয়, বেস্টিত প্রথম ক্বিবলার স্মৃতি। সালাহুদ্দীনের বিজিত আক্বসা আজও বেস্টিত। ওমরি হুংকারের উত্তরতর জাতী আজ বিলাসিনী, তাই এখনো হয়ে ওঠেনি। ইতিহাসের সেই অক্ষুন্ন বাণী হুংকারের প্রলাপ ফ্রেডরিকের প্রতিজ্ঞা- যেকোন মূল্যে সে জেরুজালেমের মাটিতে পা রাখবে। সে সালাহুদ্দিনকে হুমকি দিয়ে বলেছিল, “১ বছরের সময় দিলাম, জেরুসালেম ছেড়ে চলে যাও” কিন্তু ইতিহাসের অধ্যায় মোড় নেয় অন্য কোন পথে, নতুন পথের সুচনায় নতুন আঙ্গীকে, দাঁড়াতে হল সালাহুদ্দীন আয়ুবীকে দুটি জিনিসের মধ্যে
১. ইসমাইল আল মালিকের কথা মত মিশরে বসে থাকা এবং জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের আশা পরিত্যাগ করা, সেইসাথে সিরিয়াকে কুচক্রীদের হাতে হস্তান্তর করা।
২. ইসমাইল আল মালিকের নির্দেশ অমান্য করে দামাস্কাস দখল করে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার পথ সুগম করা এবং নিজের নেতৃত্বের নিকট বিশ্বাসঘাতক সাব্যস্ত হওয়া।
শতাব্দীর পর শতাব্দীর রচনায় এমন ব্যক্তিত্বের অধিকারি কিভাবে করতে পারেন, তাই হয়নি, হয়ে ওঠেনি।
আক্বসার আহাজারি
কোন সালাহুদ্দীন আয়ুবীর জন্মের অপেক্ষায়, আমি মাসজিদে আক্বসা বলছি, রক্ত ঝরছে মুসলিমের। রক্তাক্ত হচ্ছে ভূমি। কাদছে স্বজন হাসছে শত্রু। কম্পিত হচ্ছে আকাশ ভুমি। ভূলণ্ঠিত হচ্ছে মাতৃত্বের সতীত্ব। অশান্ত হচ্ছে পরিবেশ। গাছপালা ধুলোবালীতে লজ্জার চাদর ডেকে কাঁদছে। পাতর ফেটে সারা জিবনের কান্না করছে। অসহায় ভূমি যেন অপারগতা পেশ
করছে। আরব অতন খুশিতে যেন আটলাট।
বোমারু বিমানের আঘাতে প্রাণ হারাচ্ছে লক্ষ লক্ষ শিশু কিশোর। গোটা বিশ্ব অসহায় আখিযুগলে অশ্রু ঝরাচ্ছে। আমরা বন্দি ইহুদীদের কাছে। মাসজিদে আক্বসা মুসলিম বিশ্বের পানে মুক্তির ভিক্ষা করছে। মেরাজের সময় হুযুর সা. আমার মাঝে দুরাকাত নামায পড়েন। ইমামতি করেন সকল নবী ও রাসুলের। আমাকে প্রথম ইমারাত করেন হযরত ইব্রাহীম, দ্বিতীয়বার হযরত ইসহাক এর পর ইয়াকুব সুলাইমান আ.। ৬৩৬হিজরিতে ওমর আমায় মেরামত করেন। আমি আল্লাহর ঘর। আমার মাঝে ইবাদত হবে। আমি গর্ব করব তা নিয়ে। কিন্তু কোথায় মুসলিম বিশ্ব? ওরাতো পারছে না। বলছি ফিলিস্তিনিরা। দেখনি মেয়েরা বিবাহের বয়সের আগে বাবাকে বলছে আমাকে বিবাহ দিয়ে দাও। যেন আমি সন্তান জন্ম দিতে পারি আর সে জিহাদে যাবে। এমন আকুতি তোমরা দেখনি? তাহলে কি দেখছ? আমায় মুক্ত করো না! আর কি জন্মাবে না কোন সালাহুদ্দীন আয়ুবী? আমি আর বন্দি থাকতে চাইনা।
জেগে উঠো মুসলিম, জেগে উঠো। জেগে উঠো সালাউদ্দীন আয়ুবীর চেতনায়, জাগো বীর সৈনিক উসামার চেতনায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক