মঈন স্যার প্রায় জোর করেই আমাদের দাখিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করালেন। কাওমির পরীক্ষা শেষে হাতে শুধু রামাযান। ইংরেজি, বাঙলা’তে টুকটাক অভিজ্ঞতা থাকলেও বীজগণিত, অর্থনীতি কিংবা পৌরনীতির মতো বিষয়ে পহেলা কদম।
প্রথমে কিছুটা ভয় থাকলেও পরীক্ষা ঘনিয়ে আসলে সরকারি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার কিছু অঘোষিত নিয়ম দেখে যেন মরুতে জলের মুশক পেলাম। যেমন-
-শিক্ষক এবং সিনিয়রদের মতে, আগেরবারের প্রশ্নপত্র থেকে যে এবছর কোনো প্রশ্ন আসবে না, সেটা ৯৯.৯৯% নিশ্চিত। তাই সাধারণত পড়ানোও হয় না।
-আল ফালাহ, আল বারকাহ ইত্যাদি গাইডে সম্ভাব্য সাজেশন দিয়ে ১০০% এবং ৯৯% দিয়ে পূর্ববর্তী বছর সমূহে তাদের সফলতার রেকর্ডও দেয়া।
অনার্সে ভর্তি হয়ে দেখলাম, সাজেশন প্রায় মাদরাসার মতই। কিন্তু কিছু গাইড তো মাদরাসা বোর্ড থেকে আরেকটু উপরে উঠে একেবারে হাতে আসমান ধরিয়ে দিল। নবদূত, মৈত্রী সহ কয়েকটি গাইড দেখলাম। একটা গাইডের পিছনে তো পরীক্ষার সম্ভাব্য সাজেশন দিয়ে প্রকাশকের একটি চিঠিও ছাপিয়ে দিয়েছে। “যদি সাজেশনের শতভাগ কমন না পড়ে, যোগাযোগ করলে গাইডের মূল্য ফেরত দেয়া হবে”।
এই সাজেশনের আশ্বাস এবং স্টুডেন্টদের তাতে বিশ্বাস মনে করিয়ে দিত কাওমি মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষানীতি, পরীক্ষানীতি, সাজেশন ইত্যাদির কথা।
তখন ছিলাম ফযিলত দ্বিতীয় বর্ষে। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার কয়েকদিন পূর্বে আমাদের এক শিক্ষক ক্লাসে আসলেন। আমরা তাঁকে জোর-জবরদস্তি করতে লাগলাম, পরীক্ষার জন্য কিছু সাজেশন দিতে। তিনি বললেন- পড়া শেষে দিয়ে যাবেন। পুরো ক্লাসটাইম আমরা ছিলাম চরম এক্সাইটেড। পড়ানো শেষ করে ক্লাস থেকে যাওয়ার সময় হুজুর বললেন, “বইয়ের পৃষ্ঠা নম্বর এবং অধ্যায়ের নাম পরীক্ষায় আসবে না। আর আমি যা কিছু পড়াইনি, সেগুলোও আসবে না। তোমাদের কষ্ট করে পড়ার দরকার নেই। বাকি সবই ‘মহল্লে ইমতিহান’ (সাজেশন) ।
প্রায়ই শোনা যায়, “এখন প্রশ্নপত্র সৃজনশীল হয়। অধ্যায়ের মাঝখান থেকে প্রশ্ন আসে, আগের মতো নয়”। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এই অগ্রগতি দেখে আপন মনে হাসি। একবিংশ শতাব্দীতে এসে যারা “সৃজনশীলতা” চাষ করতে যাচ্ছে, সেই তারা সৃষ্টিশীলতার বুলি শেখাতে চায় তাদেরকে, যারা “সৃজনশীলতা” নিয়েই সৃজিত!