মাকড়শা নামের কুৎসিত পোকাটাকে ঘৃণা করেনা, এমন মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। কিন্তু জীবনে প্রথমবার অধ্যবসায় রচনা পড়তে গিয়ে, লিখতে গিয়ে আমরা কিন্তু আটপেয়ে অদ্ভুৎ কুৎসিত এই জীবটার উদাহরণই দিয়েছিলাম।
ওই যে, শত্রুপক্ষের নিকট বারবার পরাজিত হয়ে রবার্ট ব্রুস যখন খাটে শুয়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে ছিল তখন দেখল এক মাকড়শা কড়িকাঠের একপাশ থেকে আরেকপাশে যাওয়ার জন্য অসংখ্যবার চেষ্টা করছে। এভাবে চেষ্টা করতে করতে মাকড়শাটা সফল হয়, আর এটা দেখে রবার্ট ব্রুসের উৎসাহ একলাফে কয়েকগুন বেড়ে যায় । হতাশাকে মাটিচাপা দিয়ে রবার্ট ব্রুস এরপর শত্রুপক্ষকে দ্বিগুণ বিক্রমে আক্রমন করে জয় লাভ করে। সামান্য এক মাকড়শা এইভাবে অধ্যবসায় এর জ্বলন্ত এক উদাহরণ হয়ে টিকে আছে শত বছর ধরে…।
কিন্তু মাকড়শা নামের ভয়াবহ কুৎসিত প্রাণীটা যে মাতৃত্বের সবচেয়ে বড় উদাহরণ সেটা জানার পর আমি কিছুক্ষনের জন্য হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বলছি। অন্যান্য পোকামাকড়ের মত মাকড়শা নামের আর্থ্রপোডা শ্রেণীর পোকাটিও ডিম পাড়ে। কোন কারণে যাতে ওগুলো নষ্ট হয়ে না যায় সেজন্য ডিমগুলো সবসময় নিজে বহন করে মা মাকড়শা। প্রকৃতির নিয়মে একদিন ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। এত বাচ্চার খাবার জোগার করা মাকড়শা মায়ের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না।
ক্ষুধার জ্বালায় মাকড়শার বাচ্চাগুলো জন্মদাত্রী মায়ের দেহই খাওয়া শুরু করে দেয় । সত্যি কথা । সব কষ্ট সহ্য করে মা মাকড়শা বাচ্চাদের কাছে নিজের দেহ বিলিয়ে দেয় । সময় যায় , মৃত মা পড়ে থাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে , মায়ের দেহ খেয়ে বেঁচে থাকা মাকড়শার দল আবার পায় মাতৃত্বের স্বাদ! কি অদ্ভুত! তাই না?
বনী ইসরাইল বংশের দু মহিলা একবার গল্প করছিলো। তাদের দুই বাচ্চা ছেলে (যারা দেখতে ছিল প্রায় একই রকম আর যাদের বয়সও একই ছিল) অদূরেই খেলা করছিলো। হঠাৎ একটা বাঘ এসে একটা বাচ্চা ছেলেকে তুলে নিয়ে গেল। এরপরে …
বাকি শিশু ছেলেটি নিজের বলে দুই মহিলাই দাবি করতে লাগলো। মাতৃত্বের দাবি নিয়ে সঠিক বিচারের আশায় দুই মহিলাই সুলাইমান আ.’র কাছে গেল। হযরত সুলাইমান আ.’র সামনে বাচ্চার দাবীতে দুই মহিলাই বুক ফাটিয়ে কান্নাকাটি করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে হাতে একটা চাকু নিয়ে সুলাইমান আ বাচ্চাটাকে কেটে দুই টুকরা করতে উদ্যত হলেন। তিনি ঠিক করলেন বাচ্চাটার দুই টুকরা তিনি দুই মহিলাকে ভাগ করে দিবেন। তার এই রায় শুনে অপেক্ষাকৃত কম বয়সী মহিলা কেঁদে বলল যে, বাচ্চাটাকে কাটার দরকার নেই। সে স্বীকার করছে যে বাচ্চাটা তার না , বয়স্ক মহিলার বাচ্চা। এই কথা শোনার পর আল্লাহর নবী সুলাইমান আ আর বুঝতে বাকি নাই যে, বাচ্চাটা আসলে ওই কম বয়সী মহিলারই। তিনি তার হাতে তার বাচ্চা ছেলেকে তুলে দিলেন। আসলে বুন্ধুরা জানেন মায়েরা এমনই। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে তারা চান, তাদের সন্তানের গায়ে যাতে ফুলের টোকাটাও না পড়ে!
মূল কথা হচ্ছে, গত কিছুদিন ধরে হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক্স ওয়ার্ডে (শিশু বিভাগ) আমার প্লেসমেন্ট। গত তিনদিন যাবত আমি লক্ষ্য করছি , বারান্দার সামনে পাটি বিছিয়ে এক মহিলা তার তিন বছরের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দেয়াল ঘেসে একই ভঙ্গিতে বসে আছেন! সকাল- সন্ধ্যা দুই বেলাই আমাকে ওয়ার্ডে যেতে হয়। এভাবে মহিলাকে বসে থাকতে দেখে আমার কেন যেন মনে হল, তিনি সারারাতও এভাবে বসে থাকেন। দ্যাট মীনস রাতে তিনি হয়তো ঘুমোন না। কাছে গিয়ে ঐ মায়ের সাথে কথা বলে সব বুঝলাম। আসলেই মা গত তিনদিন যাবত ঘুমুচ্ছেন না। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে কিছুক্ষনের জন্য হয়তো বিশ্রাম নেন , পরমুহুর্তে বাচ্চাটার কান্নায় তার তন্দ্রা ছুটে যায়।
অর্ধ-তন্দ্রার চোখ নিয়ে বাচ্চার শুশ্রূষায় নিজেকে নিয়োজিত করেন তিনি। জানলাম, বাচ্চাটার ব্রঙ্কিওলাইটিস নামের রোগ হয়েছে। এই রোগে বাচ্চাদের প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হয়। শুয়ে থাকলে প্রবলেমটা আরও বেশি হয়, কিন্তু বসে থাকলে আবার শ্বাসকষ্টটা কম হয়। তাই বাচ্চার কষ্ট লাঘবের জন্য মা নিজে বসে কোলে বাচ্চাকে বসিয়ে রেখে ঘুম পাড়ান! অথচ নিজে ঘুমুতে পারছেন না, সেদিকে তার খেয়াল নেই । নিজের এই আত্মত্যাগের বদলে অবুঝ বাচ্চাটার শ্বাসকষ্ট যদি একটুও কমে তাতেই তিনি খুশি…
[লিখতে গিয়ে কোন ফাঁকে জানে অশ্রু বেরিয়ে চলে আসলো টেরই পেলান না। মানবতার বড় বড় উদাহরণ মায়েরা ছাড়া আর কারা দিতে পারে। লেখাটি সংগৃহীত।]