হাকীম সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ ::
উপমহাদেশে দারুল উলুম দেওবন্দকে ঘিরে তা’লিম, তাবলীগ, তাজকিয়া ও ইসলামি আন্দোলনের যে মহান যুগান্তকারী ধারা তৈরি হয়েছিল, সে ধারায় তা’লিম ও তাবলীগ বিশ্বব্যাপি সফলতার স্বর্ণ শিখরে পৌঁছুলেও তাজকিয়াভিত্তিক (খানকা) মেহনত অনেকটা নির্জীব হয়ে আছে। অপর দিকে ইসলামি আন্দোলন দিন দিন প্রচলিত রাজনীতির চোরাবালিতে হারিয়ে যাচ্ছে। এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, তাগুতি সংগঠনগুলোর কার্যক্রম, কর্মসূচি, আন্দোলন-সংগ্রাম, পলিসি নির্ধারন ও রাজনীতি এবং আমাদের রাজনীতির মধ্যে ব্যবধান ক্রমশ কমে যাচ্ছে। এমন হওয়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? ব্যর্থতার মূল রহস্য কি? বিশেষ করে আমাদের দেশের ইসলামি রাজনীতির এই করুন দশা কেন? আজকের প্রজন্মের কাছে এসব বিষয় পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন একটি তথ্যভিত্তিক পর্যালোচনার। নতুবা রাজনীতি অঙ্গনে ইসলামি আন্দোলনের ক্ষেত্রে সামনে আমাদের আরো কঠিন সময় পার করতে হবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ইসলামি সংগঠনের অভাব নেই। যার যখন নেতা হওয়ার খায়েশ সৃষ্টি হয়, তখন তিনি আর নিরব থাকতে পারেন না। দলের মধ্যে একটু বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেই আরেকটি নতুন তাজা দল গঠন করে ফেলেন। নিজের সাথে জনগণ বা নেতা কর্মী আছে কিনা, তা ভেবে দেখা উচিত বলে মনে করেন না। দু’একটি মাদরাসায় প্রভাব থাকলে তো আর উপায় নেই। শক্তির মহড়া প্রদর্শন করতে বেগ পেতে হয় না।| ডাক দিলেই মাদরাসার ছাত্ররা জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ শ্লোগান দিয়ে আকাশে তুলে ফেলেন তথাকথিত নেতাকে। রিজার্ভ ছাত্রদের ব্যবহার করে নিজের কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে সাহস বেড়ে যায় অনেক গুণ। এজন্য নতুন সংগঠন জন্ম দিতে খুব একটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়না।
সংগঠন হচ্ছে মানুষের। সব নেতা-কর্মীরা কিন্তু এক পরিবার থেকে আসেনি। এখানে বিভিন্ন পরিবার ও ভিবিন্ন বংশের লোকের অংশগ্রহণ রয়েছে। বিভিন্ন মত থকতে পারে। বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে | মানুষের বাস যেখানে আছে সেখানে সমস্যা থাকবে সাথে সমাধান ও থাকবে। হ্যা, তবে সমাধানের পথে হাঁটতে হবে। সমস্যা সাহাবাদের যুগেও হয়েছিল। তখন সমাধানের পথ কী ছিল? আমাদের সামনে “হায়াতুস সাহাবা” না থাকার কারণে ইসলামি আন্দোলনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আজ একেবারেই অবহেলা আর গুরুত্বহীনে পরিণত হয়েছে।
আমরা লক্ষ্য করেছি, অনেক নেতৃবৃন্দের সামান্য সমস্যাটুকু মোকাবেলা করার মতো ধৈর্যশক্তি নেই। নিজের মতের একটু বিপরীত হলেই আমি আর নেই। আমি আমীর বা মহাসচিব হলেই আমার মতামতকে চূড়ান্ত হিসেবে মেনে নিতে হবে। যে সিদ্ধান্ত হলে আমার ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিল হবে, সেটাই নিয়ে আমি ব্যস্থ। এখানে ইসলামের ফায়দা কতটুকু হবে, সেটা আমার দেখা বা চিন্তার বিষয় নয়। এরকম মন-মানসিকতা থাকার কারণেই ইসলামি সংগঠনগুলোর বেহাল দশা। অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতাদের জীবন থেকে এখলাস নামক অধ্যায় একেবারেই হারিয়ে গেছে। নামায, রোযা, হ্জ্জকে এবাদত মনে করলেও রাজনীতিকে আমাদের নেতারা এখলাসওয়ালা এবাদতের মত মনে করতে বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। কোন জায়গায় তার একটু কম মূল্যায়ন কিংবা বক্তৃতা-বিবৃতিতে নাম না দিলেই দেখা যায় এখলাস আর লিল্লাহিয়তের কি অবস্থা! পদ-পদবী আর পজিশন ঠিক মত না পেলে তো আর কথাই নেই।
জাতি আজ হতাশ। যাদের কাছ থেকে অনেক অনেক ভালো কিছু আশা করে এ জাতি, সে আশা আজ আর বাস্থবায়িত হচ্ছে না। সকল স্বপ্ন হারিয়ে যাচ্ছে এক অজানা গলিপথে। কিছু ক্ষনিক স্বার্থের মোহে। নিজের সামান্য দুনিয়াবী আখের গোছানো আর পদ-পদবীর লোভে। আখেরাতের অনন্ত জীবন আর পরকালের জবাবদিহিতার কোন পরোয়া নেই। ঈমান কমজোর হতে হতে ব্যক্তিস্বার্থ এতো বেশি জজবার তৈরি করছে, যার ফলে অনৈক্যের ক্ষত-বিক্ষত ক্যান্সার আজ ইসলামি গণবিপ্লবের পথ পদ্ধতিতে পচন ধরিয়েছে। নিজেদের স্বার্থের জন্য একটি আন্দোলন, একটি সংগঠনকে ভেঙ্গে খান খান করতে, টুকরো টুকরো, খণ্ড-বিখণ্ড করতে। নেতা কর্মীদের বিপর্যয়ের মূখে ফেলে পুরো দল ও আন্দোলনের কর্মীদের বেঁচাকেনা করতে আমাদের বুক একটুও কাপেঁনা খোদার ভয়ে। সাংগঠনিক বই, সংবিধান আর কুরআন-কিতাবের পাতায় মলাটবদ্ধ সব বাস্তবতা। লেবাসের আড়ালে আমাদের আরেক রূপ পলকেই ভেসে উঠে অতি সহজে। মঞ্জিলে মকসুদের রাজপথ হারিয়ে আজ আমরা উদ্দ্যশ্যহীন এক পথে হাটছি। নিজেকে একমাত্র হক, ভুলের উর্ধ্বে আর বাকী সব ভুল পথে- এই নীতি ঐক্যের পথে অন্তরায় হয়ে আছে। অন্যের এতাআত আমাদের ডিকশনারীতে নেই। স্বজনপ্রীতি আর পারিবারিক নেতৃত্ব মূল য্যোগ্যতার চাবিকাটিতে রূপ নিয়েছে। আমরা কেবল সংবিধান চর্চা করি, সংবিধান বুঝি বাকিরা এব্যাপারে মূর্খ। কিন্তু আমার সংবিধানিক চর্চা যে কুরআন চর্চা ও সুন্নাহ চর্চার খেলাফ চলছে, সে কথা মাথায়ই নেই।
জানিনা, কবে যে সুস্থ হবে আমাদের প্রত্যাশিত এ পথ। কবে যে ঐক্যের মিশন আলোর মুখ দেখবে। কবে যে বাংলাদেশের সবুজ ভুখণ্ডের বুকে পত পত করে উড়বে কালেমা খচিত লাল সবুজের শান্তির পতাকা।
ইসলামি সংগঠনগুলোর ঐক্য হচ্ছে ব্যাপকভিত্তিক। সুসংহত, শক্তিশালী এক আন্দোলন। এ আন্দোলনকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের ইতিহাসে অতীতে ইসলামি ঐক্যের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে অনেকবার। কখনো ঐক্য হয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত নেতৃত্বের লড়াইয়ে ঐক্যের মধ্যে ফাটল ধরে যায়। জাতি ঐক্যের ফল ভোগ করতে পারেনি এবং ইসলামেরও তেমন কোন ফায়দা হয়নি।
আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত কর এবং ইসলামি আন্দোলনের সহী সমুঝ দান কর। আমীন।
[চলবে…]