ইসলামি আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, জীবনের সর্বস্তরে বিজয়ী আদর্শ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও শিক্ষা প্রতিটি ক্ষেত্রই ইসলামি আদর্শের আলোকে পুনর্গঠন করা। এ লক্ষ্য অর্জন করার জন্য বিশ শতকে দেশে দেশে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগঠন গড়ে উঠেছে। উপনিবেশ-উত্তর সময়ে এসব ইসলামি দল নিজ নিজ দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে এবং দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নীতির পরিবর্তনের প্রয়াস চালায়। বিগত আট দশকের তৎপরতায় ইসলামি দলগুলো বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিকভাবে কতটুকু সফল হয়েছে বা ব্যর্থ হয়েছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন করা হয়েছে এখানে।
ইরানে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে বিপ্লব সাধিত হয়েছে এবং ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পশ্চিমা যড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে ইসলামি নীতি, আইন ও মূল্যবোধকে সামনে রেখে একটি আধুনিক রাষ্ট্র চালানো সম্ভব বলে প্রমাণ করেছে ইরান। ৩৫ বছর ধরে সেখানকার ইসলামপন্থীরা মোটামুটি সফলতার সাথে সরকার পরিচালনা করছে। আন্দোলন ও সরকার পরিচালনার ইরানি অভিজ্ঞতাকে অনেকে ‘ইরানি মডেল’ বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। ইরানি মডেল এক সময়ে মুসলিম বিশ্বে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। অবশ্য বর্তমানে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি, বিশ্বজুড়ে ইসলামের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র ও ইরানি জাতি প্রধানত শিয়া হওয়া এবং মুসলিম বিশ্বের শিয়া অধ্যুষিত দেশ ও শিয়া সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের পক্ষপাতিত্ব (বিশেষ করে সিরিয়ার ব্যাপারে) এর প্রধান কারণ বলে মনে হয়।
১৯৯২ সালে আফগান মুজাহিদরা যুদ্ধ করে কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে আফগানিস্তানকে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ ঘোষণা করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তখন থেকেই মুজাহিদদের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে ১৯৯৬ সালে মুজাহিদদের একটি অংশ তালেবানরা ক্ষমতা দখল করে ‘ইসলামি আমিরাত আফগানিস্তান’ নামে দেশটির পুনঃনামকরণ করে। ২০০১ সালে আমেরিকার আক্রমণের ফলে তালেবান সরকারের পতন ঘটে। সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল ও ইসলামি আইন প্রয়োগের আফগান ধরনকে কেউ কেউ আফগান বা তালেবান মডেল বলে থাকেন। অবশ্য বর্তমানে ‘তালেবান মডেলের’ তেমন কোনো আবেদন নেই। ‘তালেবান মডেলকে’ অনেকে ধর্মীয় ও রাষ্ট্র পরিচালনায় চরমপন্থী-কট্টরপন্থী মনে করে থাকেন।
তুরস্কে ২০০২ সালে নির্বাচনে প্রথমবারের মতো এরদোগান ও গুলের নেতৃত্বাধীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) ৩৪.২৮ শতাংশ ভোট ও সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। ২০০৭ ও ২০১১ সালের নির্বাচনেও তারা যথাক্রমে ৪৬.৫৮ শতাংশ ও ৪৯.৯ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে। ২০১৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও একেপির প্রার্থী এরদোগান নিরঙ্কুুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। অবশ্য ২০১৫-এর জুনের সাধারণ নির্বাচনে ‘একেপি’ এককভাবে সরকার গঠন করার মতো পার্লামেন্টে আসন না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত ২০১৫-এর নভেম্বরে আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে একেপি ৪৯.৪ শতাংশ ভোট পেয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে। একেপি নিজেদের ইসলামি দল না বলে রক্ষণশীল দল বলে আখ্যায়িত করে। দেশের সার্বিক উন্নয়ন, মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন, দারিদ্র্য, নারী-শিশু ও বৃদ্ধসহ সমাজের সাধারণ মানুষের জীবনের মানোন্নয়ন ও সহযোগিতা দান, দীর্ঘ দিন ধরে উপেক্ষিত ও নিগৃহীত ধার্মিক জনগোষ্ঠীর জীবনকে সহজ করা, সরকারি চাকরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়াসহ বিভিন্নমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে তারা তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। তদুপরি রাজনীতির ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর প্রভাব ও কর্তৃত্বের ইতি টানতে সক্ষম হয়েছে একেপি। একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশের শাসনক্ষমতায় বসে এসব কর্মকাণ্ডও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তাদের পূর্বতন সংগঠন ড. নাজমুদ্দিন আরবাকানের নেতৃত্বাধীন স্যালভেশন, রেফাহ ও ফজিলত পার্টির সাথে ধর্মীয় এজেন্ডা না আর্থসামাজিক ও উন্নয়নের এজেন্ডা প্রাধান্য পাবে, এ মতবিরোধের সূত্র ধরেই এরদোগান ও আব্দুল্লাহ গুল একেপি গঠন করেন। তারা এ পর্যন্ত পরপর চারটি নির্বাচনে সরকার গঠন করেছে। বস্তুত একেপি তুরস্কে সবচেয়ে জনপ্রিয় পার্টি। অন্য দিকে রেফাহ ও ফজিলত পার্টির সরাসরি উত্তরসূরি ২০০১ সালে গঠিত সাদাত পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে নির্বাচনে মোটেই ভালো করতে পারেনি। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন ও দেশকে ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়ার নতুন মডেল তুরস্ক। একে তুর্কি মডেলও বলা হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে অনেক গণতান্ত্রিক মুসলিম দেশে ‘তুর্কি মডেল’ অনুসরণ করার চেষ্টা চলছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ’৭০-এর দশকে ও ’৯৬ সালে তুরস্কে নাজমুদ্দিন আরবাকানের নেতৃত্বে সেকুলার দলের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে আরবাকান দু’বার ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ও একবার প্রধানমন্ত্রী হন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর চাপে তাকে পদত্যাগ করতে হয়।
সুদানে ১৯৯২ সালে হাসান তুরাবির নেতৃত্বে ন্যাশনাল ইসলামি ফ্রন্ট সামরিক জান্তা জেনারেল বশিরের অধীনে সরকারে যোগ দেয়। কিন্তু মতবিরোধ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত ১৯৯৯ সালে জেনারেল বশির তুরাবিকে বহিষ্কার ও বন্দী করেন। সামরিক শাসকের মাধ্যমে ইসলাম কায়েমের চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
২০১১ সালে মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা এফজেপি আর্থসামাজিক এজেন্ডাকে প্রাধান্য দিয়ে এককভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। সালাফি সংগঠনের রাজনৈতিক শাখা আল নুর পার্টিও ধর্মীয় এজেন্ডার চেয়ে আর্থসামাজিক এজেন্ডাকে প্রাধান্য দিয়ে পার্লামেন্টে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হয়। উভয় দল মিলে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন দখল করে নেয়, কিন্তু সাংবিধানিক কারণ দেখিয়ে আদালত নির্বাচন বাতিল করে দেন। মিসরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এফজেপির ড. মুরসি ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। কিন্তু এক বছরের মাথায় সামরিক জান্তা ক্যু করে মুরসি সরকারকে উৎখাত করে।
২০১১ সালে তিউনেসিয়ায় আন নাহদা সাধারণ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে কয়েকটি সেকুলার দলের সাথে মিলে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। অবশ্য দুই বছরের মাথায় ‘ব্যর্থতার অভিযোগে’ সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
ফিলিস্তিনের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ফিলিস্তিনি জনগণের আশা আকাক্সক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে হামাস জয়লাভ করে সরকার গঠন করে যদিও পশ্চিমা সরকারগুলো তাকে স্বীকৃতি দেয়নি। মরক্কোর পার্লামেন্টে আবদুল্লাহ বারকিরানের নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থী জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (পিজেডি) ২০১১ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ১০৭ আসন পেয়ে সরকার গঠন করেছে।
লিবিয়ায় স্বৈরশাসক গাদ্দাফির পতনের পর সেখানে ইসলামপন্থী জাস্টিস অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন পার্টি ’১২ সালের নির্বাচনে ১০.২৭ শতাংশ ভোট ও ১৭টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে। ইয়েমেনে ইসলামি দল আল ইসলাহ ২০০৩ সালের নির্বাচনে ২২.৬ শতাংশ ভোট ও ৪৬টি আসন পেয়ে বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে। আলজেরিয়ায় ’৯০-এর দশকে নির্বাচনে প্রথম দফায় ‘এফআইএস’ অভূতপূর্ব বিজয় লাভ করলে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচনই হতে দেয়নি সামরিক বাহিনী। দেশে দীর্ঘ দিন চলেছে গৃহযুদ্ধ। সর্বশেষ পার্লামেন্ট নির্বাচনে বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও ইসলামপন্থী তিনটি দলের জোট গ্রিন অ্যালায়েন্স ১৫.৬ শতাংশ ভোট পেয়ে ৬০টি আসন লাভ করেছে। সেখানকার আরেক ইসলামি দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি পেয়েছে ৩.০৫ শতাংশ ভোট ও আটটি আসন। মৌরিতানিয়ায় ইসলামপন্থী ন্যাশনাল র্যালি ফর রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সংক্ষেপে তাওয়াস্সুল পার্টি পেয়েছে ১৬টি আসন।
সিরিয়ায় চলছে স্বৈরশাসক বাশারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যুদ্ধরত গ্রুপগুলোর মধ্যে মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থিত গোষ্ঠী অন্যতম। ইরাকে সাদ্দাম-উত্তর নির্বাচনে শিয়া সমর্থিত দল ক্ষমতায় আসে এবং নুর-ই মালিকী সরকার গঠন করেন। মালিকী সরকারের নীতি অতিমাত্রায় শিয়াবাদী হওয়ায় সুন্নিরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ফলে সরকারের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। অন্য দিকে সুন্নিদের একটি চরমপন্থী গোষ্ঠী যুদ্ধ শুরু করে। এর সাথে যোগ দেয় সাদ্দামের অনুগত সেনারা। তারা অল্প সময়ের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে সেখানে আবুবকর বাগদাদির নেতৃত্বে খেলাফতের ঘোষণা দেয়। এখন সেখানে চলছে দায়েশ (আইসিস) বিরোধী আন্তর্জাতিক অভিযান। বস্তুত ইরাকের সঙ্কট অত্যন্ত জটিল। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব ও কুর্দি সমস্যা প্রকট। ব্রাদারহুড সুন্নিদের মধ্যে অত্যন্ত সক্রিয়। অন্য দিকে শিয়াদের মধ্যে আয়াতুল্লাহ বাকের আল সদর প্রতিষ্ঠিত দাওয়া আন্দোলনেরও তৎপরতা লক্ষণীয়।
ইয়েমেনে জায়েদিয়া শিয়ার একটি সশস্ত্র মিলিশিয়া গোষ্ঠী হুথি (আল হোচিওন) (যা আল শাবাব আল মুমিনুন নামেও পরিচিত) ইয়েমেন সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান শুরু করে ২০০৪ সালে। হুথিদের মূল নেতা ছিলেন হোসাইন বদরুদ্দিন আল হুথি। তাকে ইয়েমেনের সরকারি বাহিনী হত্যা করেছে বলে মনে করা হয়। হুথিদের বক্তব্য তারা সরকারের জায়েদিয়াদের প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদে ও এর প্রতিকারে সংগ্রাম করছে। অন্য দিকে সরকারের (যা প্রধানত সুন্নি) বক্তব্য হচ্ছে, হুথিরা সরকারকে অস্থিতিশীল করে শিয়া নীতি ও আইন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। হুথিরা অভিযান চালিয়ে কয়েকটি প্রদেশ ও বেশ কয়েকটি জেলা অধিকার করে সেখানকার শাসন পরিচালনা করছে। সর্বশেষে তারা রাজধানী সানার সরকারি ভবন ও বেতারকেন্দ্র দখলে নিয়েছে এবং দেশের প্রেসিডেন্টকে সৌদি আরবে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। একে কেন্দ্র করে সৌদি নেতৃত্বে ‘সুন্নিজোট’ হুথিদের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ শুরু করে। ইয়েমেনের আলকায়েদাও হোথিবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। ফলে ইয়েমেনে শিয়া সুন্নি বিরোধ আরো তীব্র হচ্ছে। সে দেশের ইসলামি আন্দোলনকে (শিয়া ও সুিন্ন উভয় ক্ষেত্রেই) অবশ্যই শিয়া সুন্নি বিরোধের রাজনৈতিক সমাধান বের করতে হবে। এটা শুধু ইয়েমেনের সমস্যা নয় বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষত ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, বাইরাইন, দক্ষিণ সৌদি আরবে এ সমস্যা প্রকট। এখন পর্যন্ত প্রচলিত ইসলামি দলগুলো শিয়া-সুন্নি ইস্যুকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি।
প্রসঙ্গত, মনে রাখা প্রয়োজন, ঐক্যবদ্ধ ইয়েমেনে সুন্নি জনসংখ্যা ৬০-৬৫ শতাংশ। অন্য দিকে জায়েদিয়া শিয়া জনসংখ্যা ৩৫-৪০ শতাংশ। জায়েদিয়ারা উত্তর ইয়েমেনে আর সুন্নিরা দক্ষিণ ইয়েমেনে সংখ্যাগরিষ্ঠ। হুথিরা ইসরাইল ও আমেরিকা বিরোধী আর তার প্রধান শত্রু আলকায়েদাও ইসরাইল এবং আমেরিকাবিরোধী। নিছক ধর্মতাত্ত্বিক সম্প্রদায়গত কারণে উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে মরণপণ লড়াই চলছে।
পাকিস্তানে ১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামি জেনারেল জিয়াউল হকের অধীনে সরকারে যোগ দেয়, কিন্তু অল্প কয়েক মাসের মাথায় তাদের পদত্যাগ করতে হয়। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী জুনিয়র পার্টনার হিসেবে ২০০১ সালে চারদলীয় সরকারে যোগ দেয় ও পুরো মেয়াদ ক্ষমতায় থাকে।
পাকিস্তানে ২০০২ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত, জমিয়ত, আহলে হাদিস ও তাহরিকে জাফরি মিলে গঠিত ‘মুত্তাহিদা মজলিসে আমল’ পেয়েছিল ১১.৩ শতাংশ ভোট ও ৬৩টি আসন আর তারা সীমান্ত প্রদেশে সরকারও গঠন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে ইসলামি দলগুলো সুবিধা করতে পারেনি। সর্বশেষ ২০১৩ সালের নির্বাচনে এককভাবে জামায়াত পেয়েছে তিনটি আসন এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (মাওলানা ফজলুর রহমান) পেয়েছে আটটি আসন। কাজেই তুলনামূলকভাবে সর্বাধিক অনুকূল পরিবেশে কাজ করার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও জামায়াতসহ পাকিস্তানের ইসলামি দলগুলো নির্বাচনে তেমন কোনো অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি।
বাংলাদেশে ২০০১ সালে চারদলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে নির্বাচন করে জামায়াতে ইসলামি সংসদে ১৮টি আসন পেয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত পায় মাত্র তিনটি আসন। পরে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জামায়াত সঙ্কট ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এখনো সঙ্কট কাটেনি। পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও অন্য কয়েকটি দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, দলগত নির্বাচনের চেয়ে জোটবদ্ধ নির্বাচনে ইসলামপন্থীরা কিছুটা ভালো করেছে।
ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতিতে ইসলামি শক্তি বরাবরই একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। স্বাধীনতা-উত্তর ইন্দোনেশিয়ার প্রথম নির্বাচনে ইসলামি দল মাসুমি পার্টি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে এর নেতা ড. নাসির প্রধানমন্ত্রী এবং ন্যাশনাল পার্টির নেতা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থপতি ড. সুকর্নো হন প্রেসিডেন্ট। ১৯৬৫ সালে জেনারেল সুহার্তো ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট হন। তার আমলে আইন করে ইসলামি দলগুলোকে একীভূত হতে বাধ্য করা হয়। তখন তদানীন্তন ইসলামি দলগুলো একীভূত হয়ে গঠন করে পিপিপি (ইউনাইটেড পিপলস পার্টি)। সে সময়কার রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনেও পিপিপি প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে। ১৯৯৮ সালে সুহার্তোর পতনের পর দলগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণাদেশ বাতিল করা হয়। তখন পিপিপি থেকে বেরিয়ে এসে আরো কয়েকটি ইসলামি দলের আবির্ভাব ঘটে।
ইন্দোনেশিয়ার পাঁচটি ইসলামি দল সুহার্তো-উত্তর কোনো জাতীয় নির্বাচনেই পৃথক পৃথকভাবে ১০-১২ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। তবে ২০০৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে দলগুলো সম্মিলিতভাবে ২৭.২৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ৫৬০ আসনের মধ্যে ১৭৯টি আসন লাভ করেছে। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে তারা সম্মিলিতভাবে পায় ৩১.৪১ শতাংশ ভোট এবং ১৭৫টি আসন।
ইন্দোনেশিয়ার সব ক’টি সরকারেই কোনো না কোনো ইসলামি দল অংশগ্রহণ করে। ১৯৯৯ সালে পিকেবি নেতা আবদুর রহমান ওয়াহিদ ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সে সময় পিপিপি নেতা হামজা হাজ তার ক্যাবিনেটের জনকল্যাণমন্ত্রী হন। ২০০১ সালে প্রেসিডেন্ট মেঘবতির অধীনে ভাইস প্রেসিডেন্ট হন পিপিপি নেতা হামজা হাজ। ১৯৯৯ সালে পিএএন নেতা ড. আমিন রইস পিপলস কনসাল্টেটিভ কাউন্সিলের (এমআরপি) চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৪ সালে পিপিপি যদুন্যুর সরকারে যোগ দেয় এবং কয়েকটি মন্ত্রণালয় লাভ করে। ২০০৯ সালেও ইসলামি দলগুলো কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল। পিকেবি ২০১৪ সালের নির্বাচনোত্তর সরকারে যোগ দেয়। মোটকথা ইন্দোনেশিয়ায় বিভিন্ন সরকারের সময়ে ইসলামি দলগুলো অংশগ্রহণ করে। যদিও এ পর্যন্ত তারা এককভাবে বা সম্মিলিতভাবে নিজেরা সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়নি।
মালয়েশিয়ার ইসলামি দল (পার্টি ইসলাম সে-মালয়েশিয়া) বা ‘পাস’ প্রায় বরাবরই কেলেনতান এবং কয়েক দফা টেরেঙ্গুন ও একবার কেদাহ প্রদেশে সরকার গঠন করেছে, যদিও কেন্দ্রে তারা ভালো করতে পারেনি। তবে তারা দীর্ঘ দিন পর্যন্ত প্রধান বিরোধী দলের অবস্থান ধরে রেখেছিল। কিন্তু ২০১৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে আনোয়ার ইব্রাহিমের পিপলস জাস্টিস পার্টি (পিকেআর) ৩০টি আসন পেয়ে পার্লামেন্টে পাসকে (যার বর্তমান আসন ২১) ছাড়িয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন বারিশান ন্যাশনাল (বিএন) জোটের বিকল্প জোট পাকাতান রাকিয়াত (পিআর) ২০১৩ সালের নির্বাচনে ৮৯ আসন পেয়ে পার্লামেন্টে তারা বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে। যদিও তারা মোট ভোটের ৫০.৮৭ শতাংশ পেয়েছিল। অন্য দিকে ৪৭.৩৮ শতাংশ ভোট পেয়ে বিএন সরকার গঠন করেছে।
এ ছাড়া সোমালিয়ার আল ইত্তেহাদ, নাইজেরিয়ার জামা’য়াতুল আহলে সুন্নাহ লিদ্দাওয়াহ ওয়াল জিহাদ (যা বুকো হারাম নামে পরিচিত), ইন্দোনেশিয়ায় জামাহ ইসলামিয়া,পাকিস্তানে তেহরিকে তালেবান ও ইয়েমেনে আলকায়েদাসহ বেশ কিছু সংগঠন সামরিক কর্মসূচি নিয়ে কাজ করছে। তবে তারা কিছু ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক ও সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা ছাড়া কার্যত কোনো কিছু অর্জন করতে পারেনি। বাংলাদেশে ছোট ছোট কিছু গোষ্ঠী জিহাদের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে কিন্তু তার পরিণাম হয়েছে আত্মঘাতী। ইসলামের জন্যও হয়েছে ভীষণ ক্ষতিকর।
নির্বাচনী ধারায় কর্মরত দলগুলোর বক্তব্য ও কর্মসূচি
যারা নির্বাচনে ভালো করেছে তাদের ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচি এবং নির্বাচনী মেনিফেস্টো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাদেরকে জনগণের চাহিদা ও সমস্যাকে গুরুত্ব দিতে হয়েছে। জনগণের বিরাজমান সমস্যাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে ধর্মীয় এজেন্ডাকে প্রাধান্য দিয়ে নির্বাচনে ভালো করার সম্ভাবনা থাকে না। তাই তাদের কর্মসূচিতে ধর্মীয় এজেন্ডার চেয়ে আর্থসামাজিক এজেন্ডাকে প্রাধান্য দিতে হয়েছে। মোট কথা, যারা জনগণের সমর্থন পাওয়ার (গণ-আন্দোলন ও নির্বাচন উভয় ক্ষেত্রেই) ওপর ভিত্তি করে আন্দোলন করেছে তাদেরকে জনগণের মূল সমস্যা ও চাহিদাকে সামনে রাখতে হয়েছে। নিছক ধর্মীয় বক্তব্য দিয়ে জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সঞ্চালিত করা ও তাদের সমর্থন আদায় করা সম্ভব হয়নি। তাদেরকে প্রেসার গ্রুপের রাজনীতির বদলে গোটা জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো প্রধান ধারার জাতীয় রাজনীতি করতে হয়েছে। অন্য দিকে যারা ধর্মীয় বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে আন্দোলন করছে তারা নির্বাচনের ফলাফল বিবেচনায় প্রান্তিক অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
দলগুলোর নাম প্রসঙ্গ
আরেকটি বিষয়ও প্রণিধানযোগ্য যে, বিভিন্ন দেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বেশির ভাগ ইসলামি দলের নামের সাথে ইসলামি বা খেলাফত শব্দটি যোগ করা হয়নি। যেমন- তুরস্কে ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টি (এনএসপি) ও জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি), মালয়েশিয়ায় পিপলস জাস্টিস পার্টি (পিকেআর), মিসরে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (এফজেপি), তিউনিসিয়ায় আন নাহদা পার্টি, ইয়েমেনে ইসলাহ পার্টি, লিবিয়ায় জাস্টিস অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন পার্টি, মরক্কোয় জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (পিজেডি) ইত্যাদি। ইন্দোনেশিয়ার পাঁচটি ইসলামি দলের নামের সাথেও ইসলাম শব্দটি নেই। বেশির ভাগ দলের নামের সাথে উন্নয়ন (ডেভেলপমেন্ট ), ন্যায়-ইনসাফ (জাস্টিস), কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাধীনতা (ফ্রিডম), জাগরণ ইত্যাদি শব্দ রয়েছে।
কোন কৌশল বিবেচিত হতে পারে বাংলাদেশে
বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, ইসলামি আন্দোলনের প্রতি বৈরী শক্তিশালী প্রতিবেশী, বিশ্ব পরিস্থিতি, ভৌগোলিকভাবে মুসলিম বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্নতা, দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে তদানীন্তন ইসলামি শক্তিগুলোর নেতিবাচক ভূমিকা পালন, দেশে তথাকথিত জঙ্গিবাদের ধুয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখলে এটি খুবই স্পষ্ট, এখানে সামরিক জিহাদের বা এ জাতীয় কর্মকাণ্ডের কোনো ধরনের উপযোগিতা ও বাস্তবতা নেই। তদুপরি নির্বাচন এড়িয়ে গণ-আন্দোলনের প্রচেষ্টাও খুব একটা কার্যকর বিষয় বলে প্রমাণিত হয়নি। তাই বলা যায়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য এখন নির্বাচন পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। এটা মেনে নিয়েই বাংলাদেশের ইসলামি দলগুলোকে কর্মসূচি ও কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে হবে।
তা ছাড়া নির্বাচনী রাজনীতির মাধ্যমে সফলতা লাভ করতে হলে দলগুলোর কর্মসূচিতে জনগণের সমস্যাদি ও আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হতে হবে। আর জাতীয় নেতৃত্ব দেয়ার জন্য দলগুলোকে প্রস্তুত হতে হবে। জাতীয় নেতৃত্ব দেয়ার জন্য দলগুলোকে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রকৃতির হতে হবে। নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই শুধু বৃহত্তর স্বার্থে সাময়িকভাবে জোটবদ্ধ হওয়া ও কমসূচিগত ঐক্য করা যেতে পারে। স্থায়ী জোটের রাজনীতি ইসলামি আন্দোলনের জন্য মোটেই লাভজনক প্রমাণিত হয়নি। তবে ইসলামপন্থীদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী অর্থবহ ঐক্য গড়ে তুলতে পারলে তা অধিকতর লাভজনক হতে পারে। তাই এ দেশের ইসলামি আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট দলগুলোকে পুরো বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে এবং প্রয়োজনীয় নীতি-কর্মসূচি ও বক্তব্যে পরিবর্তন আনতে হবে।