বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৩:০০
Home / প্রতিদিন / সিরাতুন্নবী সা. উম্মতের জন্য অনুসরণীয়

সিরাতুন্নবী সা. উম্মতের জন্য অনুসরণীয়

Hadith-18-Small20151215071402এহসান বিন মুজাহির ::

গত ২৫ ডিসেম্বর সারাদেশে পবিত্র মিলাদুন্নবি সা. যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হল। এ উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে দিনভর মিলাদুন্নবির আলোচনা, র‌্যালিসহ প্রভৃতির আয়োজনছিলো চোখে পড়ার মত। বক্ষমান নিবন্ধে কুরআন-হাদিসের আলোকে মিলাদুন্নবী ও সিরাতুন্নবী সা. প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হলো।

মিলাদুন্নবী ও ওফাতুন্নবী মাহে রবিউল আউয়ালেই সংঘটিত হয়েছিলো। এ কারণেই মাহে রবিউল আওয়ালের গুরুত্ব অপরিসীম। এ মাসেই প্রিয় নবি, রাহমাতুল্লিল আলামীন, বিশ্বনবি সা.’র শুভাগমন ও ইন্তেকাল মানবেতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা। এরচেয়ে অত্যধিক আনন্দদায়ক, শ্রেষ্ঠত্ব ও অবিস্মরণীয় কোনো ঘটনা বিশ্বের মানচিত্রে দ্বিতীয়বার  ঘটেনি। প্রিয় নবি যখন এ ধরায় শুভাগমন করেন, তখন সেই যুগ ছিল আইয়্যামে জাহেলিয়াতের। সে সময়ে গোটা জাতির ওপর অন্যায়-অত্যাচার, অবিচার, অস্থিরতা, নৈরাজ্য, স্থবিরতা জেঁকে বসেছিল। আরব দেশে বিরাজ করছিল অসংখ্য সঙ্কট ও সমস্যা। যুদ্ধ-সংঘাত, রক্তপাত ছিলো তখন নিত্যদিনের ঘটনা। সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, মিথ্যা, অসত্য, কুসংস্কার, কু-প্রথা, বিভ্রান্তি, নারী জাতির অবমাননা, শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, ধর্মের নামে অধর্মসহ এমন কোনো দিক ছিল না, যেখানে অবক্ষয় ও সঙ্কট ভয়াবহ রূপ ধারণ করেনি।

এমনই এক পরিবেশে শান্তি, মুক্তি ও কল্যাণের পয়গাম নিয়ে তিনি আগমন করেছিলেন। তার আগমনের বদৌলতে জাহেলিয়্যাত, শিরক, পৌত্তলিকতা ও বর্বরতার ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত দুনিয়ায় হিদায়াতের নূর উদ্ভাসিত হয়। জাহিল ও পথভ্রান্ত জাতি হিদায়াতের পরশ পেয়ে জান্নাতের সন্ধান পায়। নবির আগমনে মানবজাতি দ্বীনের রাস্তার সন্ধান লাভ করে। এমন নবির আগমনের মাস অবশ্যই অপরিসীম গুরুত্বের দাবি রাখে। বিশ্বনবির সিরাত আলোচনা নিঃসন্দেহ গুরুত্বপূর্ণে এবং সওয়াবের কাজ। নবির জীবনচরিত আলোচনার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ ঈমানী চেতনাকে আরো শাণিত, উদ্বেলিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
রবিউল আওয়ালের ১২ তারিখ রাসূলুল্লাহ সা.’র মিলাদ দিবস। এদিনে মহানবি সা. ধুলোর এ ধরায় আগমন করেছিলেন। তবে ১২ রবিউল আওয়ালে নবিজীর জন্ম হয়েছিল, এ নিয়ে ঐতিহাসিকগণ একমত নন। জন্মের তারিখ নিয়ে তাদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন ৯ রবিউল আওয়াল, আবার কারো মতে ১২ রবিউল আওয়াল। পক্ষান্তরে ১২ রবিউল আওয়াল যে নবির ইন্তেকাল হয়েছিল, এ নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। তাঁর মিলাদ (জন্ম) ১২ রবিউল আওয়াল সবার কাছে যেমন ছিল আনন্দের, তেমনি ওফাতুন্নবি (নবির ইন্তেকাল) ১২ রবিউল ছিল বিরহ শোকের। মিলাদুন্নবী অর্থ হলো- নবীর জন্ম। সিরাতুন্নবী অর্থ হলো- নবীর জীবনী। জন্ম পালন করার বিষয় নয়; বরং আলোচনার বিষয়। সিরাতুন্নবী (৬৩ বছরের যিন্দেগী) উম্মতের জন্য অনুসরণীয়-অনুকরণীয়।

নবী নেই তাতে কি? নবির সিরাত (৬৩ বছরের জীবনী) তো আছেই? নবির সিরাত সম্পর্কে আল্লাহপাক কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সা.’র জীবনে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। (সূরা-আহযাব: ২১)
আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘যদি তোমরা রাসূলকে অনুসরণ কর, তবেই তোমরা সত্যপথের সন্ধান পাবে’। (সূ. নূর:৫৪)

imagesজেনে রাখা দরকার যে, রাসূলের অনুসরণ ব্যতীত ইহ-পরকালে নাযাত পাওয়া নিতান্তই দূরূহ ব্যাপার। রাসূল্লাহ সা.’র অনুসরণের মাঝেই সকল প্রকার সাফল্য নিহিত রয়েছে।
এ সর্ম্পকে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে কেউ আল্লাহর আনুগত্য করে এবং রাসূলের অনুসরণ করে, সে অবশ্যই মহাসাফল্য লাভ করবে’। (সূরা আহযাব : ৭১)
নবিজী বলেন, ‘আমার উম্মতের সকল লোকই জান্নাতী হবে, অস্বীকারকারী ব্যতীত। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল সা.! অস্বীকারকারী কে? উত্তরে রাসূল সা. বললেন, যে আমার অনুসরণ করবে সে বেহেশতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার নাফরমানী করবে সে অস্বীকারকারী’। (বুখারি শরীফ)
রাসূল অনুসরণের অর্থ হলো; তার আদর্শ গ্রহণ করা, ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় জীবন থেকে নিয়ে সর্বক্ষেত্রে রাসূলের আদর্শ মেনে চলা। আমাদের সমাজ আজ রাসূলের আদর্শ থেকে সরে এসেছে। আজ রবিউল আওয়াল মাস এলেই আমরা দিবস পালনের নামে বর্ণাঢ্য র‌্যালি-মিছিল নিয়ে ব্যস্ত থাকি! রবিউল আওয়ালের পর্যালোচনার ফুরসত কোথায়?
নবির জন্মদিন পালনের জন্য মিছিল র‌্যালি করা যদি কল্যাণ ও সওয়াবের হতো, তাহলে নবিজিকে যারা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন, সেই সাহাবায়ে কেরামই তো এভাবে নবির জন্মদিন পালন করেন নি! চার মাযহাবের ইমাম, হযরত আবু হানিফা, শাফেয়ী, মালেক, আহমদ ইবনে হাম্বল, ইমাম বুখারী প্রমুখ কেউই তো মিলাদুন্নবি পালন করেন নি! পালন করেছেন বলে গ্রহণযোগ্য কোনো কিতাবে প্রমাণও নেই।
এছাড়া পবিত্র মক্কাতুল মুকাররামা ও মদীনাতুল মোনাওয়ারায় এমন মিছিল, র‌্যালি বা নবির জন্মদিন উদযাপন করেছেন বলেও নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই। অথচ তারা ছিলেন খাঁটি আশিকে রাসূল।
নবির মহব্বত, ভক্তি, শ্রদ্ধা প্রদর্শন ঈমানের দাবি । তবে তার মহব্বতে আতিশয্যে শরীয়ত সীমারেখা লঙ্ঘন করাও তেমনি গোমরাহী। শরীয়তের গন্ডিকে সমুন্নত রেখে ইসলামের নির্দেশিত পথে রাসূল্লুাহর মহব্বত প্রকাশই যথার্থ প্রকৃত নবিপ্রেমিকের পরিচয়। রাসূলের মহব্বতে মনগড়া মিলাদের নামে বর্তমানে যা হচ্ছে, মিলাদের নামে অশুদ্ধ দুরূদ ও সালাম পাঠ, মাহফিলে রাসূলের উপস্থিতি বিশ্বাসে কিয়াম, নারায়ে রিসালাত ইয়া রাসূলুল্লাহ্ বলা ইত্যাদি কাজগুলো বিদআতের শামিল, কিছু কার্যক্রম শিরকও। আহলে সুন্নাতের নীতি আদর্শের পরিপন্থী যা হবে তা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। বর্তমানে যারা মিলাদ নিয়ে এতো মাতামাতি করেন, নিজেদেরকে ও জোর গলায় আশিকে রাসূল বলে তারা রাসুলের আদর্শ বিবর্জিত নবিপ্রেমিক! কাজেই ব্যক্তিজীবনে নবির আদর্শ ও পদ্ধতি অনুসরণ না করে কেবল মুখে মুখে নবির আশেক দাবি করা প্রতারণ ছাড়া আর কিছুই নয়! রাসূলের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের নামে যদি কেউ এমন কোনো গর্হিত পন্থা গ্রহণ করে উদ্ভাবন করে, যা রাসূলের নীতি ও আদর্শের সাথে সংঘাতপূর্ণ বিবেচ্য শরয়ী দৃষ্টিতে সেটাই বিদআত এবং তা পরিতাজ্য। রাসুলের আদর্শ বিচ্যুত হয়ে মুখে নবিপ্রেমের গান গেয়ে মুক্তির আশা করা এবং আশেকে রাসূল দাবি করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং অবান্তর। রাসূলকে ভালোবাসার নিদর্শন হচ্ছে তার আনুগত্য ও অনুসরণ করা। রাসূলের আদর্শ অনুসরণ না করে মুখে রাসূলপ্রেমিক সাজা প্রতারণা নয় কি?।
শেষ কথা, কুরআন ও হাদিসের আলোকে জানা গেল সিরাতুন্নবীর মাঝেই রয়েছে মিলাদুন্নবী। অতএব মিলাদুন্নবী পালনীয় নয়, বরং সিরাতুন্নবীই উম্মতের জন্য অনুসরণীয়। আল্লাহপাক আমদেরকে মনগড়া আমল, বিদআতি কার্যক্রম থেকে হেফাজত করুন এবং ব্যক্তি জীবন থেকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় জীবনসহ সর্বক্ষেত্রে রাসুলের সা.’র আদর্শ অনুসরণের তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও আলেম।

About Abul Kalam Azad

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...