খতিব তাজুল ইসলাম ::
আবাসিকের চেয়ে অনাবাসিক স্থানীয় ছেলে-মেয়েদের আকৃষ্ট করুন। অভিভাবক সচেতনতা সৃষ্টির জন্য তাদের সাথে নিয়মিত বৈঠক করুন।
একটি এলাকার সমান দুরত্বে দু’টি প্রতিষ্ঠান। একটি কওমি মক্তব অন্যটি প্রাইমারি স্কুল। যে প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র/ছাত্রীর সংখ্যা মোট ২৫০ থেকে ৩০০’র কাছা কাছি। শিক্ষক মাত্র ৩জন, তাও হেড মাস্টার অনিয়মিত। দুইজন হিন্দু আর একজন মুসলমান নিয়ে চলছে এই শিক্ষার লীলা। মুসলমানদের ধর্ম শিক্ষার পবিত্র কাজটুকুও সারেন মহান এই হিন্দু শিক্ষক! কিন্তু পাশের সেই মক্তব বিরাণ। খালি ময়দান। এলাকার লোকেরা তাদের সন্তানদের মআদরাসায় দিতে চায়না। এমনকি ভিখারি লোকগুলো ভিক্ষা করে সন্তানকে প্রাইভেট স্কুলে পড়ায়, তবু এই যাকাতের কারখানা বা এতীমখানায় বাচ্চা দেয় না। বাধ্য হয়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ বর্ডিং খোলেন, যাতে দূরের ছাত্ররা এসে থেকে খেয়ে পড়তে পারে। এই সমস্ত মাদরাসায় পড়ার জন্য ছাত্র যত জরুরি, তারচেয়ে বেশি জরুরি এই সমস্ত হুজুর বা উস্তাযগণের চাকুরী বহাল রাখার জন্য। অনেক মাদরাসায় ক্লাস শুরু হয় ৪র্থ ও ৫ম থেকে। কারণ, স্থানীয় ছাত্র নেই, তাই শিশু ক্লাসও খোলা যায় না। আর দূরের মানুষ কচি শিশু বর্ডিংএ দিলে তাদের কে সামাল দিবে? যদি সম্ভব হতো, তাহলে তারা তাই করতেন।
আমি একজন মুহতামিম সাহেবকে বললাম, হযরত! আপনার ওখানে যে শিশু ক্লাস নেই; তখন তিনি বললেন, স্থানীয় লোকেরা শিশুদের স্কুলে দেয়, আমাদের প্রতিষ্ঠানে দেয় না। আচ্ছা, একটু কি ভেবেছেন যে, স্থানীয়রা কেন আপনার প্রতিষ্ঠানে এনে তাদের শিশুদের ভর্তি করে না? হ্যাঁ, ঐযে বাংলা ইংলিশ ও স্কুলের পড়া নেই। সরকারি সার্টিফিকেট নেই এজন্য। বললাম, তাহলে আপনার প্রতিষ্ঠানে বাংলা ইংলিশ ও স্কুলের পড়া শেখান না কেন? এসব শিক্ষা দেয়াতে কি কোন অসুবিধা আছে? বললেন, ভাই! আমাদের সামর্থ্য নেই! যাক, উনার সাথে আরো অনেক কথা হয়েছে, সব কথা এখানে বলা সমিচীন নয়। বস্তুত আমাদের সমস্যা সম্পর্কে সবাই ওয়াকিবহাল কিন্তু সমস্যা সমাধানের পথে কিছু ফতোয়াবাজ আছেন; যারা তাদেরকে চোখ রাংগিয়ে রাখেন। স্কুলের মুসলমান শিশুরা হিন্দুর কাছে কালিমা পড়ুক আর মাদরাসার মক্তবসমূহ বিরাণ হোক, এতে তাদের কিছু যায় আসেনা।
একটি অনাবাসিক প্রতিষ্ঠানের যা খরচ, তার চেয়ে ৪গুণ বেশী খরচ হয় আবাসিক প্রতিষ্ঠানে। তিনবেলা খাবারসহ গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, চৌকিদার বিল, পানি বিল, হোস্টেল সুপার খরচ মিলিয়ে তাই হবে যা আগে বললাম। আবাসিকের খরচগুলো বাচিয়ে ভাল ২/৩ জন স্কুলের শিক্ষা পড়ানোর মতো শিক্ষক রাখা যায়না? অবশ্যই পারবেন। সামান্য মাথা খাটালেই তা হয়ে যায়। ছানুভিয়া ও ফযিলত এবং টাইটেল জামাতগুলো আবাসিক হোক- তাতে কোন সমস্যা নেই। একটি মানসম্মত আবাসিক ছাত্রাবাস থাকা প্রয়োজন। যেখানে পড়ার পরিবেশ, থাকার পরিবেশ, ঘুমের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত যেন হয়। যেখানে ১০০জনের আয়োজন সেখানে জোর করে ১৫০জন করা গর্হিত কাজ।
মানসম্মত ও আখলাক্বী পরিবেশ বজায় রেখে বড় ছাত্রদের পাশে কখনো ছোট ছাত্র থাকতে পারেনা। তাই আমাদের মতে দশম পর্যন্ত কোন আবাসিক ছাত্র রাখা ঠিক নয়। দেখা গেছে, গুরুতর বিভিন্ন গর্হিত কাজগুলো বড় ছাত্ররা ছোট ছাত্রদের ফুসলিয়ে করে। তাদের বিপথগামী করে। তাই কোমলমতি শিশুদের কোন ক্রমেই এমন মিশ্রিত পরিবেশে থাকতে বাধ্য না করা।
অনেক কমজুর ঈমানের শিক্ষকরা ছাত্রদের কাছ হতে গোলাম বান্দির মতো খেদমত গ্রহণ করেন। একজন ব্যক্তি যে কাজ তার স্ত্রী, সন্তানাদি ও চাকর-নওকরের কাছ হতে নিবে, সে কাজ কেন ছাত্রের কাছে চাইবে? কাপড় ধোয়া, খাবার পরিবেশন, শরীর মর্দন ইত্যাদি তো আছেই। একজন ছাত্রকে তার পিতামাতার পারমিশন ছাড়া লেখাপড়া ও প্রাতিষ্টানিক দায়িত্ব ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তিগত কাজে লাগানো সম্পুর্ণ হারাম এবং গর্হিত।
তাই ছোট শিশু যাদের বয়স ১৫ বছরের কম, তাদের কোন অবস্থাতাতেই আবাসিক করা যাবে না। আর বড় যারা আবাসিক থাকবে, তারা যেন সুস্থ ও আখলাকি পরিবেশ বজায় রেখে থাকতে পারে, সেই বিষয় নিশ্চিত করা।
বড় ছাত্রদের কাজের প্রতি আগ্রহি করে গড়ে তুলা। এই বয়সে সে যেন কাজ করে জীবন পরিচালনা করা শিখতে পারে, সেজন্য তাদের খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ প্রদান। যাতে বর্ডিংএ থাকা খাওয়ার একটা বিল সে তার উপার্জন থেকে দিতে পারে।
মাদারিসে কওমিয়ায় অভিভাবকদের কোন মূল্য দেয়া হয় না। ভর্তির দিন এসে অভিভাবক যেই ভর্তি করিয়ে দিয়ে যাবেন, আর দেখা নেই। আসারও দরকার নেই, ভর্তির পরই যে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল! উস্তায মহুদয়গণ শিক্ষার্থীদের অভিভাবকের সাথে কথা বলা প্রয়োজন মনে করেন না। কারণ, দশ জেলা থেকে দশজন এসেছে, তারা তাদের অভিভাবক পাবে কোথায়? মূলত : এটা একটা সামাজিক সমস্যা। স্থানীয় ছেলে মেয়েরা যখন মাদরাসায় আসে না, তখন এই সমস্যা থাকবেই। অতএব আমাদের পরামর্শ- অবশ্যই স্থানীয় ছেলে মেয়েদের আকৃষ্ট করার সকল আয়োজন হাতে নিবেন। ছানুভিয়ার আগপর্যন্ত প্রতিটি ছাত্রের অভিভাবকের সাথে উস্তাযের নিয়মিত যোগাযোগ চাই। বছরে কম হলেও দুটো অভিভাবক সভা হবে। প্রয়োজনে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক মিলে আলাদা আলাদা সভায় বসবে। ঘর ঠিক না হলে বাহির ঠিক হবে কিভাবে? তাই শিক্ষার গুরুত্ব অভিভাবকের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া চাই।
অভিভাবকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ থাকলে মাদরাসার আর্থিক অনেক সংকটও দূরীভুত হবে।