ফরীদ আহমদ রেজা::
প্রথমে আসুন, রবীন্দ্রনাথের নৈবদ্য গ্রন্থের একটি বহুল-পঠিত কবিতা পাঠ করি। কবিতাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর লেখা। আমরা এখানে দেখবো, গত একশ বছরে পৃথিবীর অবস্থা খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
‘শতাব্দীর সূর্য আজি রক্তমেঘ-মাঝে/ অস্ত গেল , হিংসার উৎসবে আজি বাজে/ অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদ রাগিনী/ ভয়ংকরী দয়াহীন সভ্যতানাগিনী/ তুলেছে কুটিল ফণা চক্ষের নিমেষে/ গুপ্ত বিষদন্ত তার ভরি তীব্র বিষে । স্বার্থে স্বার্থে বেধেছে সংঘাত, লোভে লোভে/ ঘটেছে সংগ্রাম প্রলয়মন্থনক্ষোভে/ ভদ্রবেশী বর্বরতা উঠিয়াছে জাগি/ পঙ্কশয্যা হতে। লজ্জা শরম তেয়াগি/ জাতিপ্রেম নাম ধরি প্রচন্ড অন্যায়/ ধর্মেরে ভাসাতে চাহে বলের বন্যায়। কবিদল চীৎকারিছে জাগাইয়া ভীতি/ শ্মশানকুক্কুরদের কাড়াকাড়ি-গীতি।’
হিংসার উৎসব, দয়াহীন সভ্যতা বা স্বার্থে স্বার্থে সংঘাত, এর মধ্যে কোনটা একবিংশ শতাব্দীতে অনুপস্থিত? বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের কারো অজানা নয়। নৃশংস স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের পক্ষে রাশিয়া এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ দায়েশ যত মানুষকে হত্যা করেছে এর চেয়ে শতগুণ বেশি মানুষ নিহত হয়েছে বাশারের হাতে। পুতিন সেখানে এসেছেন আসাদকে রক্ষা করতে, রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষার্থে। নিজের দেশে অস্ত্রের ধার পরীক্ষা করে এখন এসেছেন ত্রাণর্তার রূপ ধরে সিরিয়ার আসাদ-বিরোধী নিরীহ জনগণকে শায়েস্তা করতে। বিনিময়ে তার দুটো লাভ হবে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে রাশিয়া এখন বিতাড়িত। এর মাধ্যমে সেখানে তিনি আসন গাড়বেন। দ্বিতীয়তঃ সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর বিশ্বরাজনীতিতে তাদের অবস্থান হয়েছে গোবেচারা টাইপের। শক্তিমত্তা দেখিয়ে বাশার আল আসাদকে রক্ষা করতে পারলে রাশিয়ার হৃত-গৌরব পুনরুদ্ধার হবে।
মুসলিম বিশ্বের ইরান আসাদের পক্ষে, এখানেও রাজনীতি। সাউদি আরবের প্রতি মুসলিম বিশ্বের জনগণের আস্থা নেই, এটা সবার জানা। শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের আসন অধিকার করার সুযোগ ইরানের ছিল। কিন্তু নিজের দেশে নিন্দিত বাশার আল আসাদের পক্ষে লড়াইয়ে অংশ নিয়ে এবং তুরস্কের মুসলিম ভাবাপন্ন সরকারের বিপক্ষে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে ইরান সে সুযোগ হাতছাড়া করে ফেলেছে। ইয়েমেন নিয়ে সাউদি আরবের অবস্থা লেজেগোবরে। ইরানের ব্যাপারে এমনিতেই সাউদিদের মধ্যে রয়েছে প্রবল ভীতি। ইরাক-ইরান-ইয়ামেন-সিরিয়া, এ চারটি দেশের সম্মিলিত শিয়া-উত্থানের সম্ভাবনা এর সাথে যোগ হয়েছে। এমনি অবস্থায় সাউদি সরকার বাশার আল আসাদ সরকারের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করবে, এটাই স্বাভাবিক।
আমেরিকা আসাদের বিপক্ষে। তারা মধ্যপ্রাচ্যের নতুন মানচিত্র তৈরি করতে চায়। তাদেরই তৈরি পুরানো মানচিত্র এখন আর নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। আমেরিকার সাথে নেটো আছে, নেটোর একমাত্র মুসলিম সদস্য তুরস্কও সেখানে আছে।
‘যুদ্ধ ধোকাবাজির নাম’ – এ নীতি গলায় ঝুলিয়ে কিছু মুসলমান যুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ ইরানেএবং কেউ সাউদি সরকারের চাকরি করেন। তারা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সে সরকারের পক্ষে কথা বলেন, প্রচারণা চালান। সত্য-মিথ্যা যাচাই করার চিন্তা করেন না। কোন কোন পক্ষ সুন্নি-শিয়া বিরোধও উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সাধারণ মুসলমান কোন সরকারের কেনা মানুষ নয়। তারা শিয়া-সুন্নি বিরোধ নিয়ে ভাবে না। তারা অমুসলমানদের সাথেও সহ-অবস্থানে বিশ্বাসী। তাদের ভাবনা ভিন্ন রকম। যুদ্ধটা হচ্ছে সিরিয়ায়। বোমা পড়ছে সেখানে। যারা মরছে তারা সবাই মুসলমান। ধ্বংস হচ্ছে হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য এবং সম্পদ। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মুসলমানরা।
বিরোধে সকল বৃহৎশক্তি জড়িত। বিশ্বযুদ্ধ হতে আর কী লাগে? মুশকিল হলো, যারা যুদ্ধবাজ তাদের হাতেই ক্ষমতা। তারা অস্ত্র বানায় এবং বিক্রয় করে। তারাই সিদ্ধান্ত নেয়, কখন কোথায় যুদ্ধ লাগাতে হবে। সাধারণ মানুষ এর কুফলটা শুধু বহন করে। মানুষ কি যুদ্ধ চায়? যুদ্ধ ছোট হোক বা বড় হোক, কোনটাই আমাদের কাম্য নয়। কোন যুদ্ধের ক্ষতি বহন করার ক্ষমতা কি আমাদের, মানে পৃথিবীর আছে? যুদ্ধ এক সময় শেষ হবে সমঝোতার মাধ্যমে। পারমাণবিক অস্ত্রের যুগে কেউ সর্বব্যাপী যুদ্ধের ঝুঁকি নেয়ার কথা নয়। বৃহৎশক্তিবর্গ তখন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত মুসলিম বিশ্বকে বানরের পিঠা ভাগের মতো ভাগ করে লুটেপুটে খাবে।
শুরু থেকেই দায়েশ বা আইসিস-এর বিরুদ্ধে মুসলমানদের কঠোর অবস্থান ছিল। দায়েশ কে সৃষ্টি করেছে তা নিয়ে ধুম্রজাল এখনো আছে। কিন্তু এর উত্থানে কারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তা বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যায়, স্বার্থটা কার। সন্ত্রাসীরা ইসলামকে বিকৃত করার কারণে ইউরোপে মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারণা হাওয়া পেয়েছে। বৃটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানরা বৈষম্য ও আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেটো এবং রাশিয়া, সকলের বোমা হামলা এবং আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু মুসলিম দেশ এবং মুসলমানরা। দায়েশ-এর অর্জন এ ছাড়া কী আছে?
দায়েশ-এর সাথে কথিত সম্পর্ক আছে এমন মুসলিম তরুণ-তরুণীদের কেউ ইসলামী স্কলার নয়। তারা ইউরোপ-আমেরিকায় সেকুলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে বড় হয়েছে। কোন মুসলিম স্কলার দায়েশ’র প্রতি সমর্থন দিয়েছেন বলে আমরা জানি না। এর পরও এ দায় ও বোঝা মুসলমানদেরই বহন করতে হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, তা হলেই বৃহৎ শক্তির উদ্দেশ্য অর্জিত হবে।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা বাঙালি পাঠকরা ভালো বুঝবেন। ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশে বামপন্থী দলগুলোর গলাকাটা রাজনীতির কথা আমরা জানি। এ জন্যে কি কেউ কার্লমার্কস বা লেনিনকে দায়ি করে? মিয়নমারে হত্যাযজ্ঞের দায় কি বুদ্ধদেব বা বুদ্ধধর্মের উপর চাপানো যায়? হিটলারের কারণে কি খৃস্টধর্মকে দায়ি করা যায়? কিন্তু দায়েশের দায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।
মুসলমানদের এত দুঃখের মধ্যেও কিছু আনন্দ সংবাদ আছে। দীর্ঘদিন থেকে পাশ্চাত্যের বর্ণবাদী গোষ্ঠী এবং তাদের সমর্থক একচোখা মিডিয়া ‘মুসলমান মানেই সন্ত্রাসী’, এ কোরাস গেয়ে চলেছে। এর পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃটেনের জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ‘মুসলমান মাত্রই সন্ত্রাসী’ এ বটিকা তারা গ্রহণ করেনি। সন্ত্রাসী তৎপরতার জন্য ইসলামকে দায়ী করা ফ্যাশন এবং বানিজ্যের অংশ, তা তারা বুঝতে পেরেছে। মুসলমানদের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট-প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্য নিয়ে খোদ তার দেশেই প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বৃটেনসহ ইউরোপ-আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার বিবেকবান ও সচেতন মহল এর প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছেন।
ফেইস বুকের প্রতিষ্ঠাতা জাকারবার্গ বলেন, ‘অন্যের অপরাধে মুসলিমদের নির্যাতিত হওয়া বা ভয় পাওয়া উচিত নয়।’ ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, প্যারিসে হামলার ঘটনায় মুসলমানদের বৈষম্যের মুখোমুখি হওয়া কিংবা চরমপন্থীদের সঙ্গে তাঁদের মিলিয়ে দেখা উচিত হবে না।’ফেসবুকে তিনি আরো লিখেছেন, প্যারিস হামলার পর আমি দেখেছি, অন্যের অপরাধের ফলে নিজেদের শাস্তি পাওয়ার আশঙ্কায় মুসলমানরা কী পরিমাণ আতঙ্কিত হয়েছে। ইহুদি হিসেবে আমার বাবা-মা আমাদের সব ধরনের সম্প্রদায়ের ওপর হামলার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শিক্ষা দিয়েছেন।’ জাকারবার্গ ফেইস-বুক ব্যবহারকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনি যদি মুসলিম সম্প্রদায়ের কেউ হন, ফেসবুকের দলপতি হিসেবে আমি জানাতে চাই, এখানে সব সময় আপনাদের স্বাগতম এবং আমরা আপনাদের অধিকার রক্ষা করব, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করব।’
আকাশ থেকে বোমা মেরে দায়েশকে যারা নিশ্চিহ্ন করার কথা বলছেন তারা জনগণকে ধোকা দিচ্ছেন। মালয়েশিয়ার মহাথির মুহাম্মদ এ ব্যাপারে খুব চমৎকার একটা মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, আকাশ থেকে বোমা হামলা করাও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। আফগানিস্থান এবং ইরাকের ইতিহাস সাক্ষী, এ সব দেশে হামলার কারণেই আজ সন্ত্রাস দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সংকট দূর করতে হলে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে, রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান অন্বেষণ করতে হবে। লড়াইয়ে শরিক না হয়ে ইরান এবং তুরস্ক সে উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ ছিল। হতে পারে সাউদি-ভীতি ইরানকে এবং কুর্দি-ভীতি তুরস্ককে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। আমাদের বুঝতে হবে, চলমান অবস্থায় লড়াই কোন সমাধান দেবে না, বরং পরিস্থিতি আরো জটিল ও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
অন্যদিকে বৃটেনবাসীর জন্যে সামনে কঠিন দুঃসময় রয়েছে।সামাজিক অস্থিরতার পাশপাশি সিরিয়ায় বোমা হামলায় অংশ গ্রহণের সকল খরচপাতি বৃটেনবাসীকে বহন করতে হবে। এর ফলে বৃটেনের অর্থনৈতিক সংকট আরো বাড়বে, বাড়বে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি। টনি ব্লেয়ারের মিথ্যা-ডসিয়ার দেখিয়ে বৃটেনকে ইরাক-যুদ্ধে জড়িত করেছেন। ডেভিড ক্যামারোন দেখাচ্ছেন জুজুবুড়ির ভয়। জুজুবুড়ি সত্যি হলে এর কারণ অনুসন্ধানের গরজ তাঁর নেই। কিন্তু এর খেসারত দিতে হবে বৃটেনের সাধারণ মানুষকে।
মধ্যপ্রাচ্যে কী হচ্ছে এবং কেন হচ্ছে, এর একটা চিত্র পাওয়া যায় আমেরিকা প্রবাসী এক কবির সাম্প্রতিক কবিতায়। ‘দেবদারু গাছগুলো নিষ্পন্দ, যেন জরা/ জলপাই পাতাগুলো ঝলসে গেছে আর/ শ্যান দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রাজশকুন/ গড়াচ্ছে তবু জল টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসে, আর/ উৎসুক হয়ে কারা দেখছে মরা মাছের জলকেলি ! মৌমাছির মতো বোমারুর গুঞ্জন ! বসফরাস থেকে জ্যোৎস্নার মরিচিকা বাদ দিয়ে/ যারা প্রণালীর বাণিজ্য দেখতে চায় তারাও/ এখন তরল সোনার ধ্যানে মগ্ন/ হিসেবি প্রতিপক্ষ-/ তস্করের হাতে নেয়া এতো তরল যায় কোথায়। কে তবে গোপন বাণিজ্য খেলে টাইগ্রিস থেকে ইউফ্রেটিস অবধি ? কারা লাশ হয়, কারা মরে/ জঘন্য রাজনীতিচক্রে কারা ঘোর-এ, কারা অবিরত ঘোরে !’ [তমিজ উদদীন লোদী: টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস]
ফিলিস্তিন, আফগাস্তিান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, মায়নমার – সর্বত্র লাশ আর লাশ। হত্যাকারী ভিন ভিন্ন হলেও লাশগুলোর পরিচয় এক ও অভিন্ন। আমাদের ভাবতে হবে, এতো লাশের বোঝা বহনের ক্ষমতা পৃথিবীর কতটুকু আছে? মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ধবংসযজ্ঞ এবং শরণার্থীর ঢল দেখে বিশ্বসম্প্রদায়ের মধ্যে শুভবুদ্ধির নবজাগরণ সৃষ্টি হোক, এটাই আমাদের কাম্য।
লন্ডন, ১০ ডিসেম্বর ২০১৫