খতিব তাজুল ইসলাম::
যৌতুক সমস্যা :
যৌতুক আসলে মুসলিম সমাজে আমদানি করা খারাপ একটি দৃষ্টান্ত। ঘৃণিত একটি কাজ। হিন্দু ধর্মে মেয়েদের বিয়ে একবারই হবে। স্বামী মারা গেলে মরতে হবে চিতায় আর তালাকপ্রাপ্তা হলে থাকতে হবে একাকী বাকি জীবন। তাই জনমের মত পিতা-মাতার কাছ হতে যা পাওয়ার, যা নেওয়ার তা তাকে নিয়ে নিতে হবে। পিতা-মাতার সম্পদে নেই তাদের উত্তরাধিকার। হিন্দুয়ানী এই জুলুম আর নিঃষ্পেষণের ছোঁয়া লেগেছে মুসলিম সমাজে। বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে চলছে যৌতুকের নামে নারী জাতির প্রতি নীরব উৎপীড়ন। তারা আজ যৌতুকের বলি। কত শত নারীর জীবন গেছে আর ঘর ভাঙছে যৌতুকের জন্য।
যৌতুক পাওয়ার কোন অধিকার আছে পুরুষের? বস্তুত মুসলমানি তারিকায় পুরুষরা উল্টো নারীদের কিছু একটা আর্থিক সুবিধা দিতে হয় বিযেতে। যেটাকে মোহর বলে। মোহর মেয়েদের প্রাপ্য। ন্যায্য অধিকার। বাঙালী সমাজে তাকে বাড়িয়ে বানানো হয়েছে কাবিন নামা। অর্থাৎ ছেলের পক্ষ সোনা-দানা তো দিবেই, সাথে দিবে স্থাবর সম্পত্তির কিছু অংশের মালিকানা। যাক, এগুলো মোহরানার অংশ করে নিলেও মন্দ বলব না। কিন্তু তাতেও আছে ফাঁকিবাজি। মোহর থাকে পুরোটাই বাকি, কাগুজে লেখা চুক্তিনামা। নাম মাত্র পরিশোধ করে অনেক পুরুষরা স্ত্রীর কাছ হতে মাফ নিয়ে নেয়। রাসুল সা. এরশাদ করেন, “যারা মোহর না দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিয়ে করে, সে আর ডাকাতের মাঝে কোন পার্থক্য নেই।”
অনেকে তো তার পরোয়াই করেনা। উল্টো মেয়েকে চাপ দিতে থাকে বাপের বাড়ি থেকে এটা আনো ওটা আনো। শ্বাশুড়ি ছেলে মিলে নির্যাতন করতে করতে অনেক মেয়েকে জীবন্ত আগুনে পোড়ানোর অসংখ্য উদাহরণ সংবাদপত্রের পাতায় প্রতিদিনই দেখা যায়। ফাঁসিতে ঝুলানোর দৃষ্টান্তও আছে। মানসিক ভারসাম্যহীন বানানোর হাজারো উপমা আছে। অনেক পিতা-মাতা মেয়েকে বিযে দিয়ে দু’চোখের পানি মুছতে মুছতে হয়রান।
একবার পত্রিকায় পড়লাম যৌতুকের জন্য শ্বাশুড়ি বউর বুকে কামড় দিয়ে গোশত ছিড়ে খেয়ে ফেলেছেন। বিশেষ করে যারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে, তাদের মাঝে এই রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। মাদরাসা পড়ুয়াদের মাঝে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে শুনিনি। মানুষ যখন কলের বলদ বনে, তখন তার কাছে আর মানবিক গুণ থাকে না। আজকাল আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররা বেশি সময় কাটায় রামদা, চাপাতি আর বন্দুক পিস্তল নিয়ে। তারা একে অন্যকে কুপায় অহরহ। কারো চোখ উপড়ে ফেলছে, কারো হাত -পা কেটে দিচ্ছে, কারো বা গলা। এমন পরিস্থিতিতে তারা কি শিখবে? সহপাঠী মেয়েদের ধর্ষণ একটি সাধারণ ব্যাপার। তাই এই শিক্ষিতদের অবক্ষয় আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে।
মেযের পিতৃালয় পথে বসেছে জামাই বাবুর আবদার মিটাতে মিটাতে। এই পুরুষ নামক জানোয়ার গুলোর মানবিক কোন বোধ নেই; ইসলামি জ্ঞান থাকাতো অনেক দূরের কথা। সমাজে চলছে নারকীয় তাণ্ডব, অথচ ওয়াজ-নসিহত আর খুতবার কমতি নেই। ধনির দুলালীরা জামাইর আবদার হয়তো পুরো করতে পারছে কিন্ত গরিবের দু:খিনী বধুর পিঠের উপর বয়ে চলেছে হাবিয়া জাহান্নাম। বাংলাদেশের হাজার হাজার মেয়েরা আজ বুড়িয়ে যাচ্ছে। বিয়ের বয়স পেরিয়ে ২৫ থেকে ৩০, ৩০ থেকে ৩৫, ৩৫ থেকে চল্লিশ। আচ্ছা, চল্লিশের পর ওই মেয়ের আর বিযের কোন প্রয়োজন আছে? যৌতুক নামক সামাজিক অভিশাপ থেকে নারী সমাজকে মুক্তি দিতেই হবে। আর তা বাস্তবায়ন করতে হলে তিনটি ধাপ আমাদের অতিক্রম করতে হবে একযোগে।
ক. রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে যৌতুক দমন। দেশের আইন-আদালত যখন এই জুলুমের বিরুদ্ধে সক্রিয় হবে এবং যৌতুক লোভি পাচককে কঠিন শাস্তি প্রদান করা শুরু করবে, তখন তা মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
খ. সামাজিক সংগঠনগুলোকে সোচ্চার হতে হবে। এ ব্যাপারে নারীবাদী কিছু সংগঠন ছাড়া আর কারো কোন উচ্চ বাচ্চ নেই। যেন পুরুষরা এই বিষয়কে এড়িয়ে চলতে চায়। ওরা কি আপনার মা, বোন মেয়ে, দাদি, নানি, খালা, ফুফু কেউ নয়? আমাদের সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। এটা নারীদের সমস্যা নয়; বরং কিছু পুরুষের মানস্তাত্তিক ক্যান্সার রোগ।
গ. ওয়াজ-মাহফিল, বয়ান-খুতবা, লেখনীসহ সকল মাধ্যম ব্যবহার করে আমাদেরকে এই মুছিবত তাড়াতে হবে।
যৌতুক নারী জাতির অপমান। নারীকে হেয় করা। তাদের অবমুল্যায়ন করা। তাদের অবজ্ঞা করা। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার শামিল। পুরুষের জীবনে এসে নারী ধন্য হলো, নাকি নারীর জীবনে এসে পুরুষ ধন্য হলো? আমরা উভয়ই ধন্য হয়েছে বলবো। তথাপি লাভমান বেশি হয় পুরুষ। আপনার যৌন জীবনকে কে আরামদায়ক করে দিলো? কে আপনাকে বাবা হওয়ার সক্ষমতা দান করলো? কে আপনার তাবত সংসারের দেখভাল করে? একজন অভিভাবক ১৮, ২০, ২২ কিংবা ২৫ বছর ধরে তার মেয়েকে লালন-পালন করে কতটুকু আর্থিক, মানসিক, শারীরিক কষ্ট বহন করেন, তা কি কেউ হিসেব কষে দেখেছেন? আল্লাহর রাসূল সা. ফরমান- “শুধু পুরুষরা যদি এই কথাটার দিকে খেয়াল করে যে, একজন নারী তার ঘরবাড়ি, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ছেড়ে আপনার ঘরে সারা জীবনের জন্য চলো এলো। এই কুরবানি এবং সেক্রিফাইসের বদলা তারা কী দিয়ে দিবে বা পরিশোধ করতে পারবে?”
যদি কোনো বাবা খুশিমনে মেয়ের বিয়েতে উপহার স্বরূপ কিছু দেন, তা আলাদা বিষয়। কিন্তু ধনীদের বলবো, আপনার সামর্থ্য থাকলেও এই দেওয়ায় অতিরঞ্জন করবেন না প্লীজ! কারণ আপনার এই জৌলুস গরিবের ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেবে। কু-পুরুষদের পথ দেখিয়ে দেবে। সামর্থ্যবানরা আল্লাহকে ভয় করুন। বিয়ে-শাদিতে অত্যধিক সাজ সাজ রব থেকে বিরত থাকুন। আপনার ছেলে-মেযের বিয়ে অপচয় না করে খরচ বাচিয়ে যাদের বিয়ে হচ্ছে না তাদের দিকে একটু নজর দিন। পারলে গরিবের কোন মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিন।
লেখক: খতিব ও গবেষক।
আরও পড়ুন- যৌনশিক্ষা ও আমাদের করণীয় (পর্ব-৮)
রাজধানীর কেরানীগঞ্জে গৃহবধু মীমকে হত্যা করার অভিযোগ পরিবারের:
গত ১৬ ডিসেম্ভর পরিবারের সদস্যদের জানানো হয মীম অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। কিন্তু তাকে দেখতে গেলে মীমের মাকে মারধর করে বের করে দেয় শ্বশুর বাড়ির লোকজন। ২ দিন লাশ আইসিইউতে রেখে দেয়ারও অভিযোগ করেন তারা।
এই ঘটনায় থানায় মামলা দায়েরর পরও আসামীকে ছেড়ে দেয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন স্বজনরা।
এদিকে পুলিশ জানিয়েছে, তদন্ত করেই আসামীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পরিবারের দাবি, স্বামী এবং শ্বাশুড়িকে রিমান্ডে নিলেই প্রকৃত ঘটনা বের হয়ে আসবে।