এদিকে অনিবার্য পরাজয়ের সম্মুখীন পাকিস্তানী বাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল নিয়াজিসহ শীর্ষ কমান্ডাররা এদিন বিকালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেলের হাতে তাদের উভয়ের সই করা একটি চিঠি তুলে দেন। বলেন, এটাই হলো ভারতের সাথে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব। অর্থাৎ আত্মসমর্পণ শব্দটিকে তখনো গ্রহণ করতে রাজী ছিলেন না নিয়াজি, যদিও পরদিনই তিনি সে অবস্থান থেকে বাধ্য হয়ে সরে আসেন। ওদিকে ভারতীয় সেনাপ্রধান মানেকশ’র পক্ষ থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের আহ্বান বারবার প্রচারিত হচ্ছিল। এ অবস্থায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মনোবল ধরে রাখা কোনক্রমেই আর সম্ভব ছিল না। ১৯৭১ সালের এদিনে সাভার, কেশবপুর, মোড়েলগঞ্জ, শাহজাদপুর, শেরপুর (বগুড়া), সিরাজগঞ্জ, উল্লাপাড়া, তাড়াইল, আক্কেলপুর, পাঁচবিবি, নবীনগর, গজারিয়া, মির্জাপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কাউখালি, চিলমারী, দোহাজারী, সান্তাহার রেল জংশন প্রভৃতি স্থান হানাদারমুক্ত হয়। আজ শেরপুর মুক্ত দিবস ১৯৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় যখন দ্বারপ্রান্তে, সে সময়ে ১৪ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় বগুড়ার শেরপুর। পাকহানাদার বাহিনী মুক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এদিন শেরপুরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।
বিজয়ের মাস ডিসেম্বর (১৪)
কমাশিসা ডেস্ক :: আজ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গভীর শোকাবহ ও বেদনামথিত দিন। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার অদম্য স্পৃহাকে থামিয়ে দিতে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই নিকট আত্মীয়রা মিরপুর ও রাজারবাগ বধ্যভূমিতে স্বজনের লাশ খুঁজে পায়। বর্বর পাক বাহিনী ও রাজাকাররা এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করেছিল। বুদ্ধিজীবীদের লাশজুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন, চোখ, হাত-পা বাঁধা, কারো কারো শরীরে একাধিক গুলি, অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে। লাশের ক্ষত চিহ্নের কারণে অনেকেই প্রিয়জনের মৃতদেহ শনাক্ত করতে পারেননি। ছিলেন ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকেই শেরপুরে চলে তরুণ ছাত্র সমাজের মধ্যে দেশ স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন তৎকালীন শেরপুর ডিগ্রী কলেজ ছাত্র সংসদের জি,এস ও ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে মুক্তি বাহিনী। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হন ন্যাপ নেতা সিদ্দিক হোসেন বারি, শেরপুর ডি.জে হাইস্কুল চত্বরে চলে কাঠের রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং। পরে শেরপুর থানা থেকে ১৪টি রাইফেল দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেন থানার তৎকালীন হাবিলদার আব্দুল হালিম। তাকে সহযোগিতা করেন থানার দারোগা ওয়াযেদ মিয়া। ২৪ এপ্রিল শেরপুরে পাকবাহিনী প্রবেশ করে। তখন মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তায় গাছ কেটে ব্যারিকেড দেয়ার চেষ্টা চালায় এবং সামান্য অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। কিন্তু পাক বাহিনীর সাথে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্নভাবে দেশে বিদেশে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফেরা আরম্ভ করে। সিরাজগঞ্জ মুক্ত দিবস ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনী সিরাজগঞ্জ শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা সিরাজগঞ্জ শহরে বিজয়ের প্রতীক হিসাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয়। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে সিরাজগঞ্জে পাক হানাদার বাহিনীর মনোবল ভাংতে শুরু করে। তাদের সহযোগী তথাকথিত শান্তি কমিটির রাজাকার মুজাহিদ বাহিনী ও আল বদরদের সহযোগীরাও অল্পপরিসর এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ হতে থাকে। ১৩ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদার বাহিনীকে ৩ দিক থেকে ঘিরে ফেলে স্থল ও নৌপথ মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রবর্তী বাহিনীও রেকি করতে পাঠানো মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে হানাদারদের পালিয়ে যাবার খবর সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা ধ্বনি ও মুহুর্মুহু ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজে ধ্বংস করে ফেলা শহীদ মিনারের পাদদেশে সমবেত হন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে দেশ গঠনের শপথ নেন। এখানে মরহুম আমীর হোসেন ভুলুকে মুক্তিবাহিনীর আঞ্চলিক অধিনায়ক ও ইসমাইল হোসেনকে প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সিরাজগঞ্জ শহর থেকে পাক হানাদারদের পালিয়ে যাবার সাথে সাথে জেলার বেলকুচি, কামারখন্দ, রায়গঞ্জ, চৌহালী, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর থানা এলাকাসহ অন্যান্য এলাকাগুলিও শত্রু মুক্ত হয়। কালিয়াকৈর মুক্ত দিবস পাকিস্তানী শোষণ ও বঞ্চনার হাত থেকে দেশকে ও দেশের মানুষকে মুক্ত করার জন্য ১৯৭১ সালে এদেশের মুক্তি পাগল মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে। সারাদেশের মত গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার অসংখ্য অসীম সাহসী যুবক ও তরুণ এ মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেয়। কালিয়াকৈরের যেসব অকুতোভয় সূর্য সন্তানেরা নিজেদের জীবন বাজী রেখে দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলন, তাদের অনেকেই আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু জাতি প্রতি বছর তাদের সেই কথা বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করে।
তথ্য সহায়তা. উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই।