রবিবার, ২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সকাল ৬:২৪
Home / অনুসন্ধান / বিবেকের কাঠাগড়ায় ইমাম আবু হানিফা এবং হানাফি মাযহাব

বিবেকের কাঠাগড়ায় ইমাম আবু হানিফা এবং হানাফি মাযহাব

Badrul_Komashishaফাহিম বদরুল হাসান ::

নাম নুমান, পিতার নাম সাবিত। উপাধি আবু হানিফা। জন্ম: ইরাকের কুফা নগরীতে ৫ই সেপ্টেম্বর ৭০২ ঈসায়ী মোতাবেক ৮০হিজরী এবং ইন্তিকাল ১৪ই জুন ৭৭২ ঈসায়ী মোতাবেক ১৫০হিজরী।

কোর’আন-হাদিস গবেষণা করে বিভিন্ন মাস’আলা-মাসাঈল উদঘাটনের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর যে খেদমত করে গেছেন, ইসলামের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে যুক্ত থাকবে। ইনশাআল্লাহ।

কিন্তু বর্তমানে কিছু মানুষের কথাবার্তায় মনে হয়, ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) হালের গরু মাঠে রেখে রাস্তায় এসে হঠাত কোরআন-হাদিস না জেনেই ইসলাম নিয়ে আবোল-তাবোল বকে গেছেন, আর তার অনুসারীরা “হানাফী ধর্ম” বানিয়ে ফেলেছে। নাউজু বিল্লাহ। তাদের কথায় ফুটে ওঠে, মাযহাবের ইমাম যেমন মূর্খ, অনুসারীরাও মূর্খ।

আবার কিছু আছে, খুব ঠান্ডা অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) সহ সকল ইমামকে জুতা মারে। তারা মাযহাবের ইমামদের ঘাড় মালিশ করে করে কান মোচড় দেয়।
বলে- “তারা খুবই বড় মাপের মুজতাহিদ। কিন্তু হতে পারে সকল হাদিস তাঁদের কাছে পৌঁছে নি, তাই তারা সহীহ হাদীসের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন।”
আফসুস! এইসব সমালোচনা কারীদের জন্য। এরা একটু যদি জানার চেষ্টা করতে, ইমাম আবু হানিফার স্তর এবং তাঁর “শরীয়ত গবেষণা ক্যাবিনেট” সম্পর্কে। এবং তাঁরা কীসের ভিত্তিতে মাস’আলা-মাসাঈল উদ্ভাবন করেছেন।

ইমাম আবু হানিফা রহঃ এবং তাঁর কর্মের বিবরণে কতখানি গ্রন্থ রচনা হয়েছে এবং কতশত মুহাদ্দিস, মুজতাহিদ, মুফাসসির উক্তি করেছেন, এগুলো একত্র করলে আরেকটি বিশাল গ্রন্থ হয়ে যাবে। নিম্নে অতি স্বল্পাকারে কিছু আলোচনা করা হল।

ইমামুল আইম্মাহ হযরত আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে বিভিন্ন মনীষীদের উক্তি

১) ইমাম শাফিঈ রহঃ বলেন- “ফিকহের ক্ষেত্রে সকল মানুষ ইমাম আবু হানিফার পরিবারতুল্য”। অর্থাৎ পরিবারের লোকজন যেমন কর্তার মুখাপেক্ষী, ফেকহের ক্ষেত্রে মানুষ তাঁর মুখাপেক্ষী।
(অযাফাতুল আ’য়ান)
২) আল্লামা শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ আস সালেহী রহঃ বলেন- ইমাম আবু হানিফা একজন শীর্ষ হাফেযে হাদিস ছিলেন। তিনি যদি অধিক হারে হাদিস অর্জন না করতেন, তবে তাঁর পক্ষে ফিকহের মাসাঈল আবিষ্কার করা সম্ভব হতো না। কোর’আন-সুন্নাহ থেকে তিনিই তো প্রথম মাসাঈল আবিষ্কার করেন। (উকুদুল জুমান ৩১৯)
৩) প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইসমাইল আজলুনী রহঃ লিখেছেন- তিনি(আবু হানিফা) ছিলেন হাফেযে হাদিস, প্রামাণ্য ব্যক্তিত্ব ও ফকীহ। তবে হাদিস অর্জন ও বর্ণনার শর্তাবলীর ক্ষেত্রে এবং হাদিস গ্রহণের শর্তাবলীর ক্ষেত্রে তিনি অনেক কড়াকড়ি করেছেন। ফলে অধিক হারে হাদিস বর্ণনা করেন নি।
(ইকদুস জাওয়ারিস সিমান ০৬)
৪) হাফেযে হাদিস আল্লামা ঈসা ইবনে ইউনুস রহঃ বলেন- আল্লাহর কসম! আবু হানিফার চেয়ে উত্তম, তার চেয়ে বড় পরহেযগার ও তাঁর চেয়ে বড় ফকীহ কাউকে আমি দেখিনি।
(ইবনে আবদুল বার, আল ইনতিকা ১১২)
৫) হাফেযে হাদিস আল্লামা ইয়াযিদ বিন হারুন বলেন- আমি এক হাজার ফকীহের দেখা পেয়েছি, তাদের মধ্যে পাঁচ জনের চেয়ে বড় ফকীহ, পরহেযগার এবং সহনশীল কাউকে পাইনি। তাদের প্রথম হলেন আবু হানিফা রহঃ।
৬) বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকীহ আবু বকর ইবনে আইয়াশ বলেন- নুমান ইবনে সাবিত (আবু হানিফা) অত্যন্ত সমঝদার এবং যুগের অন্যতম ফকীহ ছিলেন।
৭) শায়খ আবু আসিম আন নাবিল রহঃ বলেন- আমার মতে আবু হানিফা সুফিয়ানের চেয়েও বড় ফকীহ।
৮)আল্লামা আহমদ ইবনে হারব রহঃ বলেন- আমির উমারাদের মধ্যে খলিফার যে মর্যাদা, আলেমদের মধ্যে আবু হানিফারও তেমন মর্যাদা।
৯) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহঃ বলেন- এ উম্মতের কারো যদি মতামত দেয়ার থাকে, তবে তা আবু হানিফার রয়েছে।
১০) তিনি আরো বলেন- তোমরা বলো না আবু হানিফার মত বরং বলো, এটা হাদিসের মর্ম ও ব্যাখ্যা।
১১)ইমাম আবু ইউসুফ রহঃ বলেন- হাদিসের মর্ম সম্পর্কে আবু হানিফার চেয়ে বড় জ্ঞানী কাউকে দেখিনি।
(ইবনে আবুল আওয়াম, ফাযাইল নং যথাক্রমে ৩৮,১০৩, ১০৯, ১১৫,১১৬, ১৫০,১২১ )
এ তো গেল ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)’র ব্যাপারে বিভিন্ন কালের, বিভিন্ন স্তরের মনীষীদের মন্তব্য।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কি একা একাই হাদিস সংগ্রহ করে গবেষণা করেছেন যে, তাঁর ডজনে ডজনে ভুল হয়েছে?
আমাদের অনেকেই জানি না, ইমাম আবু হানিফা ছাড়াও স্কুল অব হানাফী’র “শরীয়ত গবেষণা ক্যাবিনেট”এ আরো চল্লিশ জন ইমাম ছিলেন। তাঁদের মধ্যে এমনও ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যাঁদের মেমোরিতে (সংখ্যার ভিত্তিতে) কয়েক ডজন সহীহ বোখারির সমপরিমাণ হাদিস ছিল। যারা ইসলাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ সম্পর্কে জ্ঞাত, তারা অবশ্যই বুঝবেন এইসব ইমাম যাঁদের লক্ষ লক্ষ হাদিস সনদসহ মুখস্থ ছিল, তাদের নজর ফাঁকি 12’শ বছর পর সহীহ হাদিস বের হওয়া সম্ভব কী না।

talkislam_2268_6695392877হানাফি ফিকহ’র গবেষণা ক্যাবিনেট’র সদস্যবৃন্দ

ইমাম যুফার রহঃ (১৫৮ হিঃ), ইমাম মালেক ইবনে মিগওয়াল রহঃ (১৫৯ হিঃ), ইমাম মালিক ইবনে নাজির তাঈ রহঃ (১৬০ হিঃ), ইমাম মিনদাল ইবনে আলী রহঃ (১৬৮ হিঃ), ইমাম নযর ইবনে আব্দুল করীম রহঃ (১৬৯ হিঃ), ইমাম হাম্মদ ইবনে আবু হানিফা রহঃ (১৭০ হিঃ), ইমাম আমর ইবনে মায়মূন রহঃ (১৭১হিঃ), ইমাম হিব্বান ইবনে আলী রহঃ (১৭২ হিঃ), ইমাম আবু ইসমা রহঃ (১৭৩হিঃ), ইমাম যুহাইর ইবনে মু’আবিয়া রহঃ (১৭৩ হিঃ), ইমাম কাসিম ইবনে মা’আন রহঃ (১৭৫ হিঃ), ইমাম সায়্যাজ ইবনে বিসতাম রহঃ (১৭৭ হিঃ), ইমাম শরীফ ইবনে আব্দুল্লাহ রহঃ (১৭৮ হিঃ), ইমাম আফিয়া ইবনে ইয়াযিদ রহঃ (১৮০ হিঃ), ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারাক রহঃ (১৮১ হিঃ), ইমাম আবু ইউসুফ রহঃ(১৮২ হিঃ) , ইমাম আবু আসিম নাবিল হামীদ রহঃ (১৮২ হিঃ), ইমাম মুহাম্মদ ইবনে নূর রহঃ (১৮৩ হিঃ), ইমাম হায়সাম ইবনে বশীর রহঃ (১৮৩ হিঃ), ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া রহঃ (১৮৪ হিঃ), ইমাম আসাদ ইবনে ওমর রহঃ (১৮৮ হিঃ), ইমাম ইউসুফ ইবনে খালিদ রহঃ (১৮৯ হিঃ), ইমাম আলী ইবনে মুসাহির রহঃ (১৮৯ হিঃ), ইমাম মুহাম্মদ রহঃ(১৮৯ হিঃ), ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে ইদ্রীস রহঃ (১৯২ হিঃ), ইমাম ফজল ইবনে মুসা রহঃ (১৯২ হিঃ), ইমাম আলী ইবনে যিরয়ান রহঃ ( ১৯২ হিঃ), ইমাম ফুযাইল ইবনে গিয়াস রহঃ (১৯৪ হিঃ), ইমাম আফস ইবনে গিয়াস রহঃ (১৯৪ হিঃ), ইমাম হিশাম ইবনে ইউসুফ রহঃ (১৯৭ হিঃ), ইমাম শু’আইব ইবনে ইসহাক রহঃ (১৯৭ হিঃ), ইমাম অকি ইবনুল জারাহ রহঃ (১৯৮ হিঃ), ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ রহঃ (১৯৮ হিঃ), ইমাম আবু হাফস ইবনে আঃ রহমান রহঃ (১৯৯ হিঃ), ইমাম মতী’বলখী রহঃ (১৯৯ হিঃ), ইমাম খালিদ ইবনে সুলাইমান রহঃ (১৯৯ হিঃ), ইমাম আব্দুল হামিদ রহঃ (২০৩ হিঃ), ইমাম হাসান ইবনে যিয়াদ রহঃ (২০৪ হিঃ), ইমাম হাম্মাদ ইবনে দালিল রহঃ (২১৫ হিঃ), ইমাম মক্কী ইবনে ইবরাহীম রহঃ (২১৫ হিঃ) ।

ফিকহুল হানাফীর উৎস এবং ভিত্তি

১) কিতাবুল্লাহ তথা কুরআন মাজীদ । এটি ইসলামি শরিয়তের প্রধান উৎস ।
২) সুন্নাতে রাসূলঃ তথা রাসূলে কারীম সাঃ এর হাদিস । ইসলামি শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস ।
৩) আকওয়ালে সাহাবাঃ তথা সাহাবায়ে কিরামের অভিমত ও ফাতওয়া । এটি ফিকহে হানাফির তৃতীয় উৎস ।
৪) ইজমাঃ তথা যে কোন যুগে শরিয়াতের নতুন কোন হুকুমের ব্যাপারে মুজতাহিদ্গণের ঐক্যমত পোষণ করা ।
৫) কিয়াসঃ তথা কুরআন হাদিসে সরাসরি উল্লেখ নেই এমন বিষয়ের সমাধান কুরআন হাদিসের অন্য মৌলিক দলিলের আলোকে বের করা । কিয়াস ইসলামি শরিয়াতের প্রামাণ্য দলিল । আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সকল ইমামগণই কিয়াসকে ইসলামি শরিয়াতের উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছেন ।
৬) ইসতেহসানঃ বিশেষ কোন মাসআলার ক্ষেত্রে শক্তিশালী দলিলের ভিত্তিতে কিয়াসে জলির স্থানে কিয়াসে খফি গ্রহণ করাকে ইসতেহসান বলে ।
৭) উরফঃ হানাফি ফিকহে উরফ ইসলামি শরিয়াতে সহকারী উৎস হিসাবে স্বীকৃত ।অর্থাৎ শরিয়াতের মূল উৎস কুরআন-হাদিস,ইজমা-কিয়াস দ্বারা সমস্যার সমাধান না করা গেলে সেখানে ইসতিহসান বা উরফ এর আলোকে মাসআলার সমাধান করা হয় ।

লেখক : তরুণ আলেম, অনলাইন এক্টিভিস্ট

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...