কমাশিসা ডেস্ক ::
আজ শনিবার ১২ ডিসেম্বর ২০১৫। যুদ্ধ এবং শুধু যুদ্ধই চলছিল চারদিকে। ধ্বংস আর বিপর্যয়। বিজয়ের কোনো আশা ছিল না মনোবল হারা পাক বাহিনীর। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনী ঢাকাকে চতুর্দিক থেকেই ঘিরে রেখেছিল। দেশের বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়া পাকিস্তানি বাহিনীর বিচ্ছিন্ন ইউনিটগুলোর ঢাকায় ফেরার তখন আর কোনো উপায়ও ছিল না। এ অবস্থায় ঢাকাকে ঘিরে আত্মরক্ষার শেষ কৌশল গ্রহণ করতে চেয়েছিল পাক সেনাবাহিনী।
লে. জেনারেল নিয়াজিসহ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের মতে, মার্কিন সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরে উপস্থিতির কথিত আশ্বাস কিছুটা আশার সঞ্চার করেছিল। জানা যায়, এদিন মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগর থেকে ২৪ ঘণ্টা দূরত্বে পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে পৌঁছেনি। জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে ১২ ডিসেম্বর রাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শর্তসম্বলিত একটি প্রস্তাব প্রেরণ করেন। এ এতে তিনি বলেন, পাকিস্তান তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে, বাংলাদেশ সরকারের সাথে যুক্তিসঙ্গত আপস করলে তার দেশ পাক-ভারত যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব বিবেচনা করতে রাজি আছে। অন্যদিকে পাকিস্তানে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত এদিন পাক-সামরিক জান্তার সকল আশায় গুড়েবালি ঢেলে দিয়ে বলেন, চীনের কাছে বেশি কিছু আশা করা ঠিক হবে না।
এদিন জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দেয় দ্বিতীয়বারের মতো। কি‘সোভিয়েত ইউনিয়ন এতে ভেটো দেয়।
এদিন সকালেই মুক্ত হয়ে গেছে নরসিংদী। গত তিন দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় ভারতীয় বাহিনীর পাঁচটি ব্যাটালিয়ন, দুটি গোলন্দাজ রেজিমেন্ট ও ৫৭ ডিভিশনের টেকনিক্যাল হেডকোয়ার্টার মেঘনা অতিক্রম করে।
এদিন যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় জাতিসংঘে পাক-ভারত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করে। এ প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের কথাও বলা হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন পুনরায় ভেটো দেয়ার কারণে এ প্রস্তাব আর পাস হতে পারেনি। এদিন জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অত্যন্ত আবেগময় ভাষায় বক্তৃতা করেন। তবে তা কোন কাজে আসেনি। এদিকে ঢাকায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়।
এ বিষয়ে রাও ফরমান আলী লিখেছেন, ঢাকাকে রক্ষার গুরুত্ব যখন অনুধাবন করা হয় ততক্ষণে ফ্রন্ট লাইনগুলো থেকে ঢাকায় কিছু ট্রুপস (সেনাদল) পাঠানোর জন্য নবম ও ষোড়শ ডিভিশনের কাছে বার্তা পাঠানো হয়। কি‘ফেরির অভাবে এবং আকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কোন উদ্যোগ নেয়া যায়নি।
এদিন বৃটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর বিমানে করে বিদেশী নাগরিকদের ঢাকা থেকে অপসারণের কাজ শুরু হয়। ওদিকে লন্ডনের হাইড পার্কে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে হাজার হাজার বাঙালি জড়ো হয়। সমাবেশ শেষে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবী জানিয়ে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি প্রদান ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবী জানিয়ে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। ১৯৭১ সালের এদিনে সরিষাবাড়ী, আশুগঞ্জ, আদমদীঘি, ভাঙ্গা, কালিয়াকৈর, ভেড়ামারা, ডিমলা, গোপালগঞ্জ, ঘোড়াঘাট, গোবিন্দগঞ্জ, চান্দিনা, ডোমার, নরসিংদীসহ বিভিন্ন এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। সরিষাবাড়ী মুক্ত দিবস সরিষাবাড়ী (জামালপুর) উপজেলা সংবাদদাতা জানায়, আজ ১২ ডিসেম্বর পাক-হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সরিষাবাড়ী উপজেলাকে হানাদার মুক্ত করেছিলেন। উপজেলার আওনা ইউনিয়নের জগন্নাথগঞ্জ ঘাট এলাকায় ১৪৬ জন পাক হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পর মিত্র বাহিনীর কাছে তাদেরকে সোপর্দ করে সরিষাবাড়ীকে দখলমুক্ত করা হয়। ওই সময় মুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন কোম্পানি, রশিদ কোম্পানি ও লুৎফর রহমান কোম্পানি দখলমুক্ত করার পক্ষে নেতৃত্ব দেন। গোবিন্দগঞ্জ মুক্ত দিবস গোবিন্দগঞ্জ (গাইবান্ধা) উপজেলা সংবাদদাতা জানায়, ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক-হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ। পাকিস্তানী লুটেরা বেঈমানদের পঁচিশ বছরের শোষণ, নির্যাতন আর বিশ্বাসঘাতকতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে এই দিনে আনন্দে উৎফুল্ল আর জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছিল গোবিন্দগঞ্জবাসী। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাক-হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালালে সারা দেশের ন্যায় গোবিন্দগঞ্জেও স্বাধীনতাকামী শত শত ছাত্র-জনতা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং ২৭ মার্চ পাক-হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হয় মান্নান, বাবলু, বাবুসহ ৫জন। এর পর দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ১১ ডিসেম্বর বিকেলে গাইবান্ধা থেকে নাকাইহাট, বোনারপাড়া থেকে মহিমাগঞ্জ এবং হিলি থেকে আসা মিত্র বাহিনীর ত্রিমুখি আক্রমণে প্রায় ২শ’ পাক সেনা নিহত হয়। অন্যরা ইউনিফর্ম খুলে লুঙ্গি, গেঞ্জি পরে সাধারণ বেশে পালিয়ে যায়। পরদিন ১২ ডিসেম্বর সকালে জয়বাংলা শ্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মুক্তিকামী মানুষ স্থানীয় হাইস্কুল মাঠে সমবেত হয়ে লাল-সবুজ জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে।
একাত্তরের এই দিনে মুক্তিবাহিনী ঢাকার ডেমরা দখলমুক্ত করেছিল। রংপুর ও সৈয়দপুরের দু’টি ক্যান্টনমেন্ট ছাড়াও বৃহত্তর রংপুর অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ফরিদপুরের ভাটিয়াপাড়া ও সিলেটের হরিপুরে মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনাদের ওপর চূড়ান্ত আক্রমণ চালায়।
একাত্তরের এদিন টাঙ্গাইলের অব্যবহৃত বিমানবন্দর ব্যবহার করে নামানো হয় ভারতীয় সেনা। ঢাকার চারদিক ঘিরে ফেলে মুক্তিসেনারা ঢাকা দখলের জন্য অবস্থান নেয়। এ সমৎয় ঢাকা রক্ষার শেষ চেষ্টাও পাকিস্তানী শাসকদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
তথ্য সহায়তা. উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই।