স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৩২৪টি পৌরসভার মধ্যে ২৩৪টি পৌরসভার নির্বাচন সম্পন্ন করতে এক শত কোটি টাকার বাজেট ধরে তফসিল পৌর নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ২০১১ সালে বাজেটের এ বাজেট ছিল ছয়ত্রিশ কোটি টাকা যা এর তুলনায় তিনগুন বেশী। বিশাল আকৃতির এই বাজেটের পৌর নির্বাচনে ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে চলতি মাসের ৩০ ডিসেম্বর। ইতোমধ্যে প্রার্থি যাছাই বাছাইও শেষ হয়েছে। শুধু প্রতিক পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন প্রার্থীরা।
পৌরসভা নির্বাচন আসন্ন। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতে হলে নির্ধারিত তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প নেই। অন্যথায় জাতি হিসেবে আমরা আরো বৃহত্তর সংকটের দিকে ধাবিত হবে। তাই আমাদের আন্তরিক আকাঙ্খা যে, সংশ্লিষ্ট সবাই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন এবং ঘোষণামতো নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে তাদের করণীয় করবেন।
সৎ ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থী চাই : পৌর নির্বাচনকে ঘিরে পৌরসভায় বসবাসকারী নাগরিকদের প্রত্যাশা নির্বাচনে যাতে সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থীরাই নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পান।
আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, নাগরিক হিসেবে আমরা সন্ত্রাসের গডফাদার, কালোবাজারি, কালো টাকার মালিক, দুর্নীতিবাজ, স্বার্থান্বেষী, প্রতারক, দখলদার, নারী নির্যাতনকারী, যুদ্ধাপরাধী, উগ্রবাদী, ধর্ম ব্যবসায়ী, দলবাজ ও ফায়দাবাজদের পৌরবাসীর স্বপ্নপূরণের চেয়ারে দেখতে চাই না। আশা করা যায় যে, এ সকল ব্যক্তিরা নির্বাচনী অঙ্গন থেকে বিদায় নিলে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন ঘটবে এবং আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুসংহত হওয়ার পথ সুগম হবে।
সজ্জনরা নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ না পাওয়া আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়। উৎসবের আমেজে প্রতি পাঁচ বছর পর পর ট্রান্সপারেন্ট ব্যালট বক্সে ভোট প্রদানও গণতন্ত্র নয়। নিরাপত্তা বাহিনী পরিবেষ্টিত হয়ে অবাধে ভোট প্রদানের অধিকারকেও গণতন্ত্র বলা যায় না।
বস্তুত নির্বাচন গণতান্ত্রিক যাত্রাপথের সূচনা মাত্র। নির্বাচিতরা যদি ক্ষমতার অপব্যবহার না করেন, সততা-স্বচ্ছতা-সমতা-ন্যায়পরায়ণতা ও দায়বদ্ধতার সঙ্গে কাজ করেন, জনমত-মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, শাসন প্রক্রিয়ায় জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন এবং ব্যক্তি ও কোটারি স্বার্থের পরিবর্তে সমষ্টির স্বার্থ সমুন্নত রাখেন, তাহলেই গণতন্ত্র ও সুশাসন কায়েম হবে। কিন্তু আমাদের আশংকা যে, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নির্বাচিত হলে, তারা গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি মেনে চলবেন না এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শাসনকার্যও পরিচালনা করবেন না।
বিতর্কিত ব্যক্তিরা নির্বাচিত হওয়া মানে রাষ্ট্রের ভবিষ্যত বিনষ্ট করা। কারণ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যদি দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন থেকে নিজেদের দূরে রাখতে না পারেন, তাহলে ইজারাতন্ত্র – অর্থাৎ লুটপাটের নিরঙ্কুশ অধিকার আবারো প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এমনি পরিস্থিতিতেই দ্বন্ধ, হানাহানি ও বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি হয় এবং উগ্রবাদের বিস্তার ঘটে ও রাষ্ট্রের কার্যকারিতাই দুর্বল হয়ে পড়ে।
পরিশেষে, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রেখে এটিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় এবং রাষ্ট্রে সুশাসন কায়েম করতে হলে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত নির্ধারিত তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোন বিকল্প নেই। নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও অর্থবহ করার মাধ্যমে আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গুণগত মানে পরিবর্তন ঘটানোর এবং আমাদের সমাজ ও রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করার ক্ষেত্রে সরকার, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল এবং সচেতন নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
তবে, এক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক দলের সদাচরণ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। দুর্বৃত্ত ও বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত বিতর্কিত ব্যক্তিরা নির্বাচিত হয়ে যেন গণতন্ত্র ও দেশের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করতে না পারে, এজন্য তাদেরকে ব্যালটের মাধ্যমে জবাব দিয়ে সৎ, দক্ষ ও জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিদের ভোট প্রদান করে পৌরবাসীর সেবা করার সুযোগ করে দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আশা করি, সংশ্লিষ্ট সকলেই এ ব্যাপারে যথাযথ ভূমিকা পালন করে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সামনে এগিয়ে নেবেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট