শাহ নজরুল ইসলাম ::
ইসলাম পৃথিবীতে মহান আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলাম শান্তি শৃংখলা নিরাপত্তা ও মুক্তির ধর্ম। ইসলাম মানুষকে মধ্যপন্থা অবলম্বনে উৎসাহিত করে। সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা ও হঠকারিতার কোন স্থান ইসলামে নেই। মানবতা, ইহ-পরকালীণ কল্যাণ ও মুক্তি ইসলামের লক্ষ্য। ইসলাম কোনরূপ জবরদস্তি ও সীমালঙ্ঘনকে প্রশ্রয় দেয় না।
প্রত্যেক মানুষের কাছে প্রিয় ও মূল্যবান হচ্ছে তার দেহ ও প্রাণ। এই ব্যাপারে যে ব্যক্তি অন্যায় আচরণ করবে, তাকে সে কখনো নিজের আপনজন, ভাই বা বন্ধু বলে মনে করতে পারে না। তাই মানুষকে আঘাত করা ও রক্তপাত করা থেকে মুসলমানদেরকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সন্ত্রাস বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। এসবের মধ্যে মানুষকে শারীরিকভাবে আঘাত করা অন্যতম বিভৎস দিক। আর এসব নির্যাতন ইসলামে জোরালোভাবে নিষেধ করা হয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেও এর প্রতিরোধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আছে। সকল প্রকার সন্ত্রাস ও সহিংসতা ইসলামে যুলুম হিসেবে গণ্য। আর যালেমরা জাহান্নামী, এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, “জাহান্নাম তাদের আবাস; কত নিকৃষ্ট আবাসস্থল যালিমদের।” [সূরা আলে ইমরান ৩/১৫১]
যালিমরা আল্লাহর অপ্রিয়, মহান আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ যালিমদেরকে পছন্দ করেন না।” [সূরা আলে ইমরান ৩/৫৭] সদাচার করা এবং অশান্তি সৃষ্টি না করার আদেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, “তুমি অনুগ্রহ কর, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চেয়ো না। আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে ভালোবাসেন না।” [সূরা ক্বাসাস ২৮/৭৭]
মহান আল্লাহ বলেন, “আর আজ তোমাদের এই অনুতাপ তোমাদের কোন কাজেই আসবে না, যেহেতু তোমরা সীমালঙ্গন করেছিলে; তোমরা তো সকলেই শাস্তিতে শরীক।” [সূরা যুখরূফ ৪৩/৩৯] কারো শরীরে আঘাত করা, অঙ্গহানি করা অথবা কাউকে হত্যা করা ইসলামে গুরুতর অপরাধ। ইসলাম এর প্রতিরোধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান দিয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,“আমি তাদের জন্য এতে বিধান দিয়েছিলাম যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত, যখমের বদলে অনুরূপ যখম। অতঃপর কেউ ক্ষমা করলে তাতে তারই পাপ মোচন হবে। আল্লাহ যে বিধান নাযিল করেছেন তদনুসারে যারা ফায়সালা করে না, তারাই যালিম।” [সূরা মায়িদা ৫/৪৫]
এরূপ অপরাধী কারো দেহের যতটুকু ক্ষতি সাধন করবে, সমতার নীতি অনুযায়ী শাস্তিস্বরূপ তার দেহেরও ঠিক ততটুকু ক্ষতি করা হবে। [দেখুন বিধিবদ্ধ ইসলামী আইনের ভাষ্য-১ম খ-, ১ম ভাগ, পৃ.২৯৪-২৯৫, ইফা প্রকাশনা] মহান আল্লাহ বলেন,“সুতরাং যে কেউ তোমাদেরকে আক্রমণ করবে, তোমরাও তাকে অনুরূপ শাস্তি দাও এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রেখো যে, আল্লাহ অবশ্যই মুত্তাকীদের সাথে আছেন।” [সূরা বাকারা ২/১৯৪] আল্লাহ বলেন, “যদি তোমরা শাস্তি দাও তবে ঠিক ততখানি শাস্তি দিবে যতখানি অন্যায় তোমাদের প্রতি করা হয়েছে। তবে তোমরা ধৈর্য ধারণ করলে ধৈর্যশীলদের জন্য তাই উত্তম।” [সূরা নাহাল ১৬/১২৬] সহিংসতা মন্দকর্ম প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, “কেউ মন্দ কাজ করলে সে কেবল তার কর্মের অনুরূপ শাস্তি পাবে।” [সূরা মুমিন ৪০/৪০] সন্ত্রাস যুলুম অত্যাচারের পরিণাম প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, “অত্যাচারীরা শীঘ্রই জানবে কোন জায়গায় (জাহান্নামে) তারা প্রত্যাবর্তন করবে।” [সূরা শু‘আরা ২৬/২২৭] হত্যার ভয়াবহতা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, “যে কাউকে হত্যা বা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করা হেতু (আইনের বিধান) ব্যতীত কাউকে হত্যা করলো সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকেই হত্যা করল; আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলো সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করলো।” [সূরা মায়িদা ৫/৩২] হত্যাকারী জাহান্নামী “কেউ ইচ্ছা করে কোন মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা করলে, তার শাস্তি জাহান্নাম। সেখানে সে স্থায়ী হবে। এবং আল্লাহ তার উপর ক্রুদ্ধ হবেন, তার উপর অভিশাপ বর্ষণ করবেন এবং তার জন্য বড় আযাব প্রস্তুত করে রাখবেন।” [সূরা নিসা ৪/৯৩] হত্যাকারীর শাস্তি বৃদ্ধি হতেই থাকবে, এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ আরো বলেন,“এবং তারা আল্লাহর সাথে কোন ইলাহকে ডাকে না, আল্লাহ যার হত্যা নিষেধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করেনা। যে লোক এসব কাজ করে সে তার অপরাধের শাস্তি ভোগ করবে। কিয়ামতের দিন তার শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে এবং তাতে হীন অবস্থায় চিরদিন থাকবে।” [সূরা ফুরকান ২৫/৬৮-৬৯]
সীমালঙঘন প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, “যে আল্লাহর সীমালঙ্ঘন করে সে নিজের উপরই অত্যাচার করে।” [সূরা তালাক ৬৫/১] কারণ সীমালঙ্ঘনের পরিণাম নিজেকেই ভোগ করতে হবে। আনাস ইবনে মালিক রা. ও আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. এর বর্ণনা। তাঁরা বলেন,‘ রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,‘সমগ্র সৃষ্টিকুলই আল্লাহর পরিবার। অতএব যে আল্লাহর পরিবারের সাথে সদয় ব্যবহার করে সে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয়।’ [আত্-তুহফাতুল মুকাদ্দাসিয়্যাহ-১/৪১] সুতরাং প্রত্যেক সৃষ্টির সাথে সদাচার করা উচিৎ। বিশেষ করে মানুষের সাথে সদাচারণ করা ইসলামের শিক্ষা। আমরা বাস্তব জীবনে তা মেনে চলবো এবং মানুষের মাঝে প্রচারের চেষ্টা করবো আমাদের আলেমগণ আমাদের এ শিক্ষাই দিয়ে থাকেন।
হত্যা করা কুফরী, এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘মুসলমানকে গালি দেয়া বড় গুনাহ আর তাকে হত্যা করা কুফরী।’ [সহীহ বুখারী, মুসলিম-আবদুল্লহ ইবনে মাসঊদ রা.] সর্বোত্তম মুসলিম প্রসঙ্গে অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা. কে প্রশ্ন করলো এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল! সর্বোৎকৃষ্ট মুসলিম কে? জবাবে রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, ‘যার মুখ ও হাতের অনিষ্ট থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ। [সহীহ মুসলিম ১/১৩০] কাউকে ভীত সন্ত্রস্ত করা জায়েয নয় এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, “কোন মুসলমানের জন্য কোন মুসলমানকে ভয় দেখানো জায়েয নয়।” ইসলাম মানুষকে যুলুম থেকে বিরত থাকতে এবং সকল প্রকার সহিংসতা ও নির্যাতন থেকে দূরে থাকতে শিক্ষা দেয়। হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা অত্যাচার করা থেকে বিরত থাক। কারণ অত্যাচার কিয়ামতের দিন অন্ধকারের কারণ হবে। কৃপণতা ও সংকীর্ণমনা থেকে মুক্ত থাক। এটা তোমাদের পূর্বেকার লোকদের ধ্বংস করেছে, কারণ তা তাদের রক্তপাত ঘটাতো ও নিষিদ্ধ কাজে প্ররোচনা দিত।’ [সহীহ মুসলিম]
তিনি বলেছেন, মযলূমের বদ দু‘আ থেকে বাঁচো ‘হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা মযলূমের আর্তনাদ থেকে আত্মরক্ষা কর। কারণ সে আল্লাহর কাছে নিজের অধিকারই প্রার্থনা করে। আর আল্লাহর নিয়ম এটাই যে তিনি কারো অধিকারে বাধা প্রদান করেন না।’ [মিরকাত ১৪/৪৫১] মর্মার্থ : প্রত্যেকটি যুলুমের বদলা নেয়া হবে। একটি বেতের আঘাতের জন্যও কিয়ামতের দিন প্রতিশোধ নেয়া হবে। হাদীস শরীফে আছে ‘প্রত্যেক কৃতকর্মের আদান প্রদান দ্বারাই (যুলুমের) প্রতিশোধ নেয়া হবে।
হযরত আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি এক ব্যক্তিকে বলতে শুনলেন যে যালিম কেবল নিজেরই ক্ষতি করে। এর জবাবে আবূ হুরায়রা রা. বললেন, সে তো নিজের ক্ষতি করেই; আল্লাহর কসম! যালিমের যুলুমের কারণে সুরখাবও (পাখী) তার বাসায় দুর্বল হয়ে মারা যায়। [সুনানে বায়হাকী ৩/১১৪] মমার্থ : যুলুম ও সহিংসতার ক্ষয়ক্ষতি যালিম পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে না। মানবতার সীমানা ভেদ করে প্রাণীকুলকেও বিপন্ন করে। যুলুমের কুফল স্বরূপ বিভিন্ন প্রকারের মুসিবত অবতীর্ণ হয়ে থাকে, কখনো বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়, খরা চলতে থাকে, পশু-পাখী মাঠ ও জঙ্গলে দানা-পানি পায় না। শেষ পর্যন্ত ধুকে ধুকে নিজ বাসায়ই মারা পড়ে। সে কথাই আলোচ্য হাদীসে উঠে এসেছে।
রক্ত, সম্পদ ও সম্মান পবিত্র : বিদায় হজ্জের ভাষণে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লক্ষ জনতাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সম্মানকে তোমাদের জন্য সম্মানার্হ ও াদাপূর্ণ করেছেন যেভাবে আজকের এই দিন, এই মাস ও এই শহরকে মর্যাদাপূর্ণ করেছেন।’ [সহীহ বুখারী] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর কাছে একজন মুসলমানের নিহত হওয়ার তুলনায় সারা দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাওয়া অনেক হালকা ব্যাপার।’ [সুনানে তিরমিযী ৫/২৭৫] হত্যাকাণ্ডের পরিণাম সম্পর্কে হাদীস শরীফে এসেছে, ‘মুমিন দ্বীনের দিক দিয়ে প্রশস্ততার মধ্যে অবস্থান করে যতক্ষণ না অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যার অপরাধ করে। হত্যাকা-ের গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করবেন না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ সম্ভবত সকল গুনাহই মাফ করে দিবেন। তবে যে লোক মুশরিক অবস্থায় মারা গেছে অথবা কোন মুমিন ব্যক্তিকে ইচ্ছা করে হত্যা করেছে, তাকে নয়।’ [সুনানে আবূ দাউদ, ইবনে হিব্বান, হাকিম] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিদায় হজ্জের ভাষণ পৃথিবীর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ভাষণ হিসেবে স্বীকৃত। সে ভাষণের এক পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয় প্রত্যেক মুসলমান মুসলমানের ভাই। আর সকল মুসলমানই ভাই ভাই। কোন ব্যক্তির জন্যেই তার ভাইয়ের সম্পদ বৈধ নয়, যা সে স্বেচ্ছায় আন্তরিকভাবে দান করে তা ব্যতীত। আর তোমরা যুলুম করো না, আর আমার পরে তোমরা আবার কুফরীতে ফিরে যেও না যে একে অন্যের গর্দান উড়াতে থাকবে।’ [বিদায় হজ্জের খুৎবা]
কুরআন মাজীদের আলোচ্য আয়াত ও হাদীস শরীফে সন্ত্রাস সহিংসতা নির্যাতন খুনাখুনি চরমপন্থা অবলম্বন সম্পূর্ণরূপে হারাম করা হয়েছে। এর জন্য দুনিয়া আখিরাতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশের মাদরাসা শিক্ষা বিশেষত কওমী মাদরাসা শিক্ষা দেশের মানুষকে এই আসমানী শিক্ষা ও মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত করে যাচ্ছে। তাদের দায়িত্ব সচেতন করছে যেন সকল প্রকার সন্ত্রাস অশান্তি নিপীড়ন নির্যাতন থেকে মানুষ মুক্ত থাকে, দেশের জনগণকে এ জঘন্য অপরাধ থেকে মুক্ত রাখা এবং নিজেরা কখনোই এ অপরাধ না করা এটা আলেমদের অঙ্গীকার। সুতরাং কওমী মাদরাসা এদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা, মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ এবং সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও নির্মূলে ব্যাপক অবদান রেখে চলেছে।
অন্যায়, অসত্য, জুলুম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ কিংবা স্বাধিকার আন্দোলন সন্ত্রাস নয়, ইসলামে একে জেহাদ বলা হয়েছে। জেহাদের অনেক স্তর, শর্ত ও পর্যায় আছে। যারা ইসলামের জেহাদকে সন্ত্রাস বলে প্রমাণ করতে চান তারা জ্ঞানপাপী নতুবা মূর্খ। পৃথিবীর অসত্য অন্যায় ও জালিমের বিরুদ্ধে মজলূমের লড়াই এবং তাবৎ সন্ত্রাস নির্মূলে কিয়ামত পর্যন্ত জেহাদ চলবে বলে কালোত্তীর্ণ ঘোষণা দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যারা জেহাদকে সন্ত্রাস বলে চালিয়ে দিতে চান তাদের মতলব খারাপ। সন্ত্রাস কখনোই জেহাদ নয় আর জেহাদ কখনোই সন্ত্রাস নয়। যারা সন্ত্রাস করে জেহাদ নাম ব্যবহার করেন তারা নাদান। তাদের বিরুদ্ধে এ দেশের আলেম সমাজ ঐক্যবদ্ধ।
এদেশের আলেম সমাজ তথ্য সন্ত্রাসের শিকার, মজলুম। কারণ তাঁদের হাতে মিডিয়া নেই। আফসোসের বিষয় যে আমাদের অধিকাংশ গণমাধ্যম দেশ ও জাতির সেবায় নিয়েজিত আলেমদের কোন অবদান দেখতে পায় না। অথচ এদেশের আলেমরা বিনামূল্যে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা জনগণকে দিয়ে যাচ্ছেন। আলেমরা শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা চালু করেননি। বিশেষ করে এদেশের কওমী মাদরাসার আলেমগণ সবচেয়ে কম সুবিধাভোগী হয়ে সবচেয়ে বেশি সেবা দিয়ে যাচ্ছেন জাতিকে। তাঁরা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন এ পথে। জাতিকে সৎপথের দিশা দেয়া অন্যায় অসত্য থেকে বাঁচানো, হিদায়াতের রাজপথ প্রদর্শন ও মানুষকে নৈতিক ও চারিত্রিক বলে বলিয়ান করা এবং মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত করার মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দিচ্ছেন আলেম সমাজ। স্রষ্টা ও সৃষ্টির হক আদায়ে তাঁরাই আমাদের উদ্বুদ্ধ করেন। এ মহান সেবা বিনামূল্যে পেয়ে যাওয়ায় আমরা এর মূল্য বুঝি না। বাতাস বিনা মূল্যে পাই এ জন্য বাতাসের মূল্য বুঝি না। আলেমরা অশ্লীলতার বিরুদ্ধে কথা বললেও অনেকের কাছে এটা মৌলবাদ আর জঙ্গিবাদ হয়ে যায়; কিন্তু বন্ধুরা চিন্তা করেন না যে, আলেমদের এই বাধা নিষেধ না থাকলে মানব জন্মের পবিত্রতা থাকবে না, সকলে লালসার গোলাম হয়ে গেলে জারজ সন্তানে ভরে যাবে দেশ, সামাজিক শৃঙখলা বালির বাঁধের মত ভেসে যাবে। কুরআন হাদীসের কথা বলে জাতিকে সতর্ক করা আলেমদের ফরয দায়িত্ব। এতে যারা নাখোশ হন তাঁরা প্রকৃত অর্থেই অপরাধী। কারণ আলেমরা আজীবন মাদকের বিরুদ্ধে কথা বলে আসছেন, এতে মাদক ব্যবসায়ী, মাদকাসক্ত ও মাতাল এবং চোরাকারবারীরা বেজার হতেই পারে। আলেমরা বেহায়াপনা, উলঙ্গপনা, অবাধ যৌনাচারের বিরুদ্ধে হরহামেশা কথা বলেন, এতে চরিত্রহীন, বদমাশ ও লম্পটেরা নারাজ হতেই পারে, আলেমরা জুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলেন, এতে জালিমরা অসন্তুষ্ট হবে এটা স্বাভাবিক।
ইসলাম, কুরআন, নবী-রাসূল, অলি-আল্লাহ বা স্বয়ং আল্লাহর শানে কেউ অশালীন কথা বললে, বেআদবী করলে যাদের মনে ঈমানের লেশ আছে তাঁদের চেতনায় লাগবে, তাঁরা আহত হবেন, এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন এটা খুবই স্বাভাবিক। যারা এহেন প্রতিবাদকেও জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদের সাথে তুলনা করেন, কিংবা আলেমদের সরলতাকে পুঁজি করে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নিয়ম মাফিক প্রতিবাদকে সহিংসতার দিকে উস্কে দেন, ভুল করেন। নবী রাসূল ও স্রষ্টার বিরুদ্ধে কথা বললে বা লিখলে মুসলমান মাত্রেই আহত হবেন। সুতরাং কেউ যেন এহেন কাজ না করে সেজন্য ব্যবস্থা থাকা দরকার। কারণ একজন মুসলমান তাঁর স্রষ্টা এবং নবীজীকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে। সুতরাং কোন লোক যদি আল্লাহ ও তাঁর নবীর মর্যাদা হানি করে কিছু বলে বা লিখে ঈমানদার আহত হবে এটাইতো স্বাভাবিক। সমাজের মানুষকে আহত উত্তেজিত করে কেউ সমাজ ও দেশকে অস্থিতিশীল করতে না পারে সে ব্যাপারে আমাদের সকলকে সচেতন থাকতে হবে।
এদেশের আলেমগণ দেশপ্রেমিক। নিজ দেশের সেবা করেন প্রচার বিমুখ হয়ে। এদেশের আলেমদের জীবন মরণের ঠিকানা প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। দেশের জনগণের খুব কাছের মানুষ আলেমগণ। জনগণের চোখের সামনেই তাঁদের সকল কার্যক্রম। আলেমদের কোন গোপন এজেন্ডা বা কর্মকা- নেই। জনগণের সুখ-দুঃখের ও জীবন-মরণের সাথী আলেমগণ। এজন্য আলেম ও কওমী মাদরাসা বিরোধী হাজারো অপপ্রচার, অপবাদ কোন কাজেই আসছে না। নাটক সিনেমায় আলেমদের চরিত্র হননের মত নিকৃষ্ট ঘৃণ্য অপকর্ম কোন প্রভাব ফেলছে না। কারণ দেশের মানুষ এসবে বিশ্বাস করে না। কওমী মাদরাসাগুলো জনগণের অর্থায়নে চলে, তাদের হাজারো খোলা চোখের সামনে। এজন্য এসব মাদরাসার বিরুদ্ধে সর্বগ্রাসী অপপ্রচার শুরু হবার পর জনগণের আগ্রহ অনুরাগ দান-অনুদানের মাত্রা কওমী মাদরাসার প্রতি আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। জনগণ বুঝে গেছে এসবই হচ্ছে দেশ ও জাতিবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ। যে সব গণমাধ্যম অবাস্তব মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করেছে তারা মিথ্যাবাদী হিসেবে মানুষের কাছে চিহ্নিত হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা, এই দেশের স্বাধীনতা ও ঐক্য রক্ষায় এবং দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ কামনায় আলেমরা শেষ রাতে উঠে মালিকের দরবারে হাজিরা দেন। অথচ একটি স্বার্থান্বেষী মহল এসব আলেমকেই দেশ বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করতে মরিয়া। আলেমরা এ দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটির হেফাজতে জীবন দানে তাঁদের ছাত্রদের প্রস্তুত করছেন। কোন সময় এ বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হলে তা শতভাগ প্রমাণিত হবে। তাঁরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় কাজ করছেন। কারণ প্রকৃত কোন ধার্মিক সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াতে পারে না। সুতরাং এদেশের আলেমগণ দেশ ও দেশের জনগণের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। তাই অপপ্রচার নয়, আসুন! জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সকলে মিলে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাই। নায়বে নবী আলেমদের সাথে থাকি, তাঁদের পাশে দাঁড়াই; তাঁদের কথা মানি এবং সহযোগিতা করি। কবি মোজাম্মেল হক তাঁর এক কালজয়ী কবিতায় বলেছেন-
পরধন দেখি, লোভে বাড়াও না হাত,
কাহার শরীরে, কভু করনা আঘাত।
কাহাকেও মন্দ কথা বল না কখন,
সকলের প্রিয় হতে করহ যতন।
মানীর সম্মান সদা রাখিবে যতনে,
তুষিবে সকলে অতি মিষ্টি সম্ভাষণে।
নীচ ভাবি মনে ঘৃণা কর না কাহারে,
সকলি আল্লাহর সৃষ্টি জানিও সংসারে।
দেশের আলেমগণ জনগণকে অব্যাহতভাবে এ মহৎ শিক্ষা (যা কুরআন হাদীস থেকেই উৎসারিত) দিয়ে যাচ্ছেন। স্রষ্টার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মানবতার কল্যাণে তাঁরা তা করেই যাবেন।
অনেক বন্ধু মাদরাসা শিক্ষাকে আন্প্রোডাকটিভ (অনুৎপাদনশীল) খাত বলে মন্তব্য করেন। তাদের এ মন্তব্য একেবারেই অবিবেচনাপ্রসূত। কারণ কওমী মাদরাসা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আর লক্ষ্য হচ্ছে সুনাগরিক তৈরী করা, মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলা। মানুষের আচরণে কাঙ্খিত পরিবর্তন সাধন করা। বাহ্যত উৎপাদন এ শিক্ষার লক্ষ্য নয়। তারপরও উন্নয়ন উৎপাদনে এ শিক্ষার গৌরবজনক অংশিদারিত্ব রয়েছে। দেশের ভেতরে কোন আলেম বেকার নন। লক্ষ লক্ষ আলেম কর্মব্যস্ত কল্যাণমুখী মহৎ জীবন অতিবাহিত করছেন। সকলেই কোন না কোন মহৎ কাজে উন্নয়ন উৎপাদনে অবদান রেখে চলেছেন। পরামর্শ দিচ্ছেন; দু‘আ করছেন।
দেশের বাইরে হাজার হাজার আলেম সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে আছেন। তাঁরা প্রত্যেকে বহিঃর্বিশ্বে সম্মানজনক একাধিক কাজ করে যাচ্ছেন। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ভূমিকা রাখছেন। বাংলাদেশের আলেমদের চাহিদা আছে সারা দুনিয়াতে। সারা দুনিয়া এমনকি সৌদী আরবে পর্যন্ত বাংলাদেশের হাজার হাজার আলেম ইমাম হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। একান্তভাবে দেশের ভেতর যারা মসজিদ মাদরাসায় দায়িত্ব পালন করছেন উন্নয়ন উৎপাদনে তাঁদেরও ভূমিকা রয়েছে। কারণ যারা সরকারী সুযোগ সুবিধা ভোগ করে ফাইলে স্বাক্ষর দিয়ে মনে করেন দেশের উন্নয়ন উৎপাদনে খুব অবদান রাখছেন, তাদের বিপরীতে সরকারের কোন সুযোগ-সুবিধা না নিয়ে জনগণের কাছে থেকে, জনগণকে সাথে নিয়ে উন্নয়ন উৎপাদন, ফসল বৃদ্ধি, ফসলে বরকতদান, খরা, বন্যা, শিলাবৃষ্টি, ঝড়-তুফান থেকে ফসল রক্ষার জন্য যারা মালিকের কাছে জনগণের আবেদন-আবদার পেশ করছেন তাঁদের অবদান অনেক বেশি।
সুতরাং, বাংলাদেশের কোন শ্রেণী পেশার মানুষের চেয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নে আলেমরা পিছিয়ে আছেন একথা সত্য নয়। দেশে কওমী মাদরাসা শিক্ষার সরকারী স্বীকৃতি না থাকায় তাঁরা সরকারী চাকুরী করতে পারছেন না কিন্তু উন্নয়ন উৎপাদনে ভূমিকা রাখার জন্য সরকারী চাকুরী করা দুনিয়ার কোথাও শর্ত নয়। এরপরও কওমী মাদরাসা থেকে ডিগ্রী নিয়ে হাজার হাজার আলেম পুনরায় আলিয়া মাদরাসা বা স্কুল কলেজ এবং ইউনিভার্সিটিতে পড়ে সুনামের সাথে ডিগ্রী নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতা দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন এবং সরকারের বিভিন্ন বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন।
অনেকে কওমী মাদরাসা শিক্ষাকে তুচ্ছজ্ঞান করে কওমী শিক্ষার্থীদেরকে অর্ধশিক্ষিত বলেন। তাদের অভিযোগ এরা বাংলা ইংরেজি কিছুই জানে না। তারা হয়তো জানেন না যে, কওমী মাদরাসায় পাঁচটি ভাষার চর্চা হয়। বাংলা, আরবী, উর্দূ, ফার্সী ও ইংরেজী। বাংলা ভাষা চর্চায় বর্তমানে মাদরাসা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে বাংলাভাষার নেতৃত্ব একটা সময়ের ব্যবধানে আলেমদের হাতে চলে আসতে পারে। সুতরাং বাংলাচর্চা কওমী মাদরাসায় হয় না এটা সত্য নয়। বাংলায় উর্দূ, ফার্সী, আরবী, ও হিন্দী সাহিত্যের অনুবাদ এখন আলেমদের হাতে। ইংরেজী চর্চায় আলেমরা দেরীতে এসেছেন একথা সত্য হলেও কওমী মাদরাসায় মোটেই ইংরেজী চর্চা নেই একথা সত্য নয়। ইংরেজী চর্চা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ইংরেজী সাহিত্যে বেশ কিছু দক্ষ আলেম তৈরী হয়েছেন। আলেমরা ইংরেজী শিখছেন অর্থোপার্জনের জন্য নয়। বরং বিশ্বব্যাপী দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার জন্য ইংরেজী শিক্ষা করা জরুরী মনে করছেন। সুতরাং বাংলাদেশের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা ও উন্নয়ন উৎপাদনে দেশের কওমী মাদরাসাগুলোর ভূমিকা ও অবদান অপরিসীম। এ শিক্ষার স্বীকৃতি নিশ্চিত হলে এবং সরকারী সহযোগিতা যুক্ত হলে এসব মাদরাসা আরো বেশি অবদান রাখতে পারবে। জাতীয় কল্যাণে নিয়োজিত দেশের কওমী মাদরাসা কতৃপক্ষকে তাই অশেষ কৃতজ্ঞতা।
লেখক: গবেষক ও বহু গ্রন্থপ্রণেতা।