ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালে দেশের সমগ্র বাঙ্গালি ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ বিজয় অর্জন করেছেন। এ বিজয় সবার। এটি শুধু মুখের কথা, বাস্তবে নয়। প্রচলিত বাস্তব হলো, আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয় শুধুমাত্র দুই লাখ তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ও ৪১ জন বীরাঙ্গনার। তারাই এককভাবে সংগ্রাম করে দেশকে স্বাধীন করেছেন। অন্য কারো কোনো ভূমিকা বা অবদান নেই। খোদ বঙ্গবন্ধুও মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত নন। অর্থাৎ স্বাধীনতা ও বিজয়ে বঙ্গবন্ধুরও কোনো অবদান নেই। এছাড়া ‘৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি, তাদের ত্রিশ লাখ শহীদ, দুই লাখ সম্ভ্রমহার নারী, লাখ লাখ শরণার্থী, পাকিস্তানে অবরূদ্ধ লাখ লাখ অসহায় বাঙ্গালি এবং দেশে অবস্থানরত যুদ্ধবিধ্বস্ত কোটি কোটি সংগ্রামী বাঙ্গালি কেউই মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত নন। স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের কোনো প্রচেষ্টা বা আত্মত্যাগ নেই। প্রকৃত সংগ্রামী বা আত্মত্যাগী শুধুমাত্র দুই লাখ তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ও ৪১ জন বীরাঙ্গনা। বিজয় ডিসেম্বর শুধু এ তালিকাভুক্তদেরই, অন্যদের নয়।
‘৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির বিপরীতে মাত্র দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা ও ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে তালিকাভুক্ত করায় দেশের স্বাধীনতা ও বিজয়ের ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। তাতে বঙ্গবন্ধুসহ সাড়ে সাত কোটি সংগ্রামী বাঙ্গালির অবদান অস্বীকার করা হয়েছে। খোদ বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর মহান অবদানকে বিদ্রুপ করা হয়েছে। যেমন, ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চে বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মী ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে পাকবাহিনীর হাতে ধরা দিয়েছিলেন। আদৌ কি তাই? কখনো নয়। সেদিন জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল বা ব্যারিষ্টার আমিরুলদের মতো বঙ্গবন্ধুও যদি আত্মগোপনে যেতেন, তাহলে কসাই পাকবাহিনী শুধু বঙ্গবন্ধুকে খুঁজতে দেশের কোটি কোটি সাধারণ বাঙ্গালিকে নির্দয়ভাবে হত্যা করতো। বাঙ্গালি দরদী পিতা এ বিষয়টি চিন্তা করে সেদিন নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করেছিলেন এবং পাক বাহিনীর কাছে আটক হয়েছিলেন। কত মহান ছিল তাঁর চেতনা! অথচ এমন মহান চেতনা ও ভূমিকার পরও বঙ্গবন্ধুর নামটি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নেই। তাঁর এ মহান ভূমিকাও মুক্তিযুদ্ধের বিরূদ্ধে ছিল বলেই প্রতিয়মান হয়েছে।
একইভাবে প্রতিয়মান হয়েছে, যুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধুর ন্যায় পাকিস্তানে অবরূদ্ধ লাখ লাখ বাঙ্গালিও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ছিলেন। ত্রিশ লাখ শহীদ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেই শহীদ হয়েছেন। দুই লাখ সম্ভ্রমহারা নারী ইচ্ছাকৃতভাবে পাকবাহিনীকে তাদের সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়েছেন। প্রায় এক কোটি বাঙ্গালি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষ হিসেবেই শরণার্থী হয়েছিলেন। আর দেশে অবস্থানকারী যুদ্ধাক্রান্ত কোটি কোটি অসহায় বেসামরিক বাঙ্গালিও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী বা পাকবহিনীর সহযোগী ছিলেন। তা না হলে পাকবাহিনী তাদেরকে হত্যা করতো। তাই তারা ছলে-বলে-কৌশলে রাজাকারি করেই পাকবাহিনীর হাত থেকে আত্মরক্ষা করেছেন। এ সকল সংগ্রামী, শহীদ ও আত্মত্যাগী কেউই মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত নন। অতএব, বিজয় ডিসেম্বর কখনোই তাদের বা তাদের সন্তান-সন্তুতিদের নয়।
বিজয় ডিসেম্বর শুধু তালিকাভুক্ত দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা, গেজেটভুক্ত ৪১ জন বীরাঙ্গনা এবং তাদের সন্তান-সন্তÍতি ও নাতি-নাতনিদের। তারা মুক্তিযোদ্ধা কোটাভুক্ত। তারাই বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। দেশের সকল চাকুরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, চিকিৎসা, ভাতা ও সম্মানিসহ সকল বিশেষ সুযোগ-সুবিধা শুধু তাদেরই। তাদের চাকুরি প্রাপ্তি ও পেনশনের মেয়াদও বেশি। এ সবই তাদের প্রাপ্য। বিজয় ডিসেম্বরও তাদেরই। অন্য কারো নয়। বঙ্গবন্ধুসহ উল্লেখিত যুদ্ধবিরোধী বা তাদের সন্তান-সন্তÍতিদের নয়। বিজয়ের কুচকাওয়াজ শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধা কোটাভোগিদের, অন্যদের নয়। এমনকি খোদ বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও নয়।
অতএব, বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, দয়া করে অন্তত বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত করুন। তিনিই স্বাধীনতার স্থপতি। তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বাইরে রেখে বিজয় পালন হয় না। আর বিজয় ডিসেম্বরকে সার্বজনীন করতে ‘৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করুন। বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটা বাতিল করুন। ষোল কোটি নাগরিক সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তান হিসেবে ঘোষণা করুন। তবেই হবে, বিজয় ডিসেম্বর দেশের সবার।
লেখক : এ্যাডভোকেট, ঢাকা।