সোমবার, ৩০ নভেম্বর ২০১৫, রাত ১১টা ৫০।
রশীদ জামীল, আমেরিকা থেকে :: দুইদিন সরকারি বন্ধ ছিল আমেরিকায়। ২৬ নভেম্বর বৃহষ্পতিবার ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’, পরদিন শুক্রবার ‘ব্লাক ফ্রাইডে’ এবং আজ ছিল ‘সাইবার মানডে’। যে দেশে উঠতে-বসতে-শুইতে ‘থ্যাংক য়্যূ’ বলা হয়, সেদেশে আলাদা করে একটা ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’ কেনো লাগে, আমি বলতে পারব না।
ব্যবসায়ীদের দোকানে সারা বছর ধরে জমা হওয়া কাপড়-চোপড় বেচা-বিক্রির জন্য ‘ব্লাক ফ্রাইডে’ একটি ভাল আবিষ্কার। এই দিনে সকল মার্কেটে হাফ মূল্যে বা তারচে’ও কম মূল্যে পণ্য বিক্রি হয়। তাই আগের রাতেই লোকজন গিয়ে লাইনে দাঁড়ায়। বছরের এই দিনে, এই একদিনে আমেরিকায় রিটেইল মার্কেটে সেলসের পরিমাণ সারা বছরের তুলনায় শতগুণ বেড়ে যায়, পুরো বছরের লোকসান পুষিয়ে নেন ব্যবসায়ীরা। লালকালি দিয়ে লেখা লোকসানের খাতা ঐ দিন সকাল থেকেই লেখা হতে থাকে কালো কালি দিয়ে, তাই দিনটির নাম ‘ব্লাক ফ্রাইডে’। তবে ইদানীং আবেগ-প্রবণ আমেরিকানরা চালাক হয়ে গেছে। (আমেরিকান বলতে সাধারণ জনগণ বোঝানো হচ্ছে) তারা বুঝে গেছে ব্লাক ফ্রাইডেতে কোনো লেটেস্ট মাল বা লাক্সারি পণ্য সেইলে রাখা হয় না। সারা বছরের অবিক্রিত মালগুলোই শুধু—-। তাই আগের তুলনায় কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে মানুষের আগ্রহে। তারপরেও এলাহি কাণ্ড!
আজ সোমবার ছিল ‘সাইবার মানডে’। প্রযুক্তিক আমেরিকায় সবকিছুই সাইবার রেঞ্জের ভেতরে। রাস্তা-ঘাট, অফিস-আদালত, বাসা-বাড়ি; সবকিছুই আন্ডার মনিটর। কম্পিউটার-ইন্টারনেট এখানকার সার্বিক ব্যবস্থাপনারই অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই সরকারি বন্ধ না থাকলেও আজ ‘সাইবার মানডে’র আমেজ কোনো অংশেই কম ছিল না। আইটি সংশ্লিষ্ট পণ্যাদি ছিল আজ বিশেষ ডিসকাউন্টে।
মাওলানা যুবায়ের আহমদ আনসারী আপডেট শিরোনামের শুরুটায় আমেরিকান কালচার নিয়ে কথা বলার মানে যে, ‘আনসারী ভাল আছেন’, সেটা কি বোঝা যাচ্ছে? যাওয়ার তো কথা। মানুষ যখন রিলাক্স মাইন্ডেড হয়, তখনই ধান ভানতে গিয়ে শীবের গীত গাইতে শুরু করে।
গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন হল, গতকাল থেকে তিনি স্বকণ্ঠে কথা বলতে শুরু করেছেন। গলায় তেজ আসতে সময় লাগবে তবে যখন থেকেই কথা বলতে পারছেন, থামতে চাইছেন না। কথায় আছে না, ‘ইঁদুর বেশিদিন কিছু কাটার সুযোগ না পেলে তার দাঁত ভোঁতা হয়ে যায়’, বক্তাদেরও হয়েছে সেই অবস্থা। কথা বলার সুযোগ পেলে সামনে মাইক থাকুক আর না থাকুক…এখনো গলায় স্বাভাবিক জোর ফিরে আসেনি কিন্তু এরই মধ্যে ব্যাখ্যা করে বোঝানোর চেষ্টা করছেন কীভাবে কী হল…
”বুঝলেন? প্রথমে তো পা থেকে হাড় কেটে নিল… তারপর বুক থেকে গোশত নিয়ে…আমি তো…
============
গতরাতে দেখতে গিয়েছিল অনুজ বন্ধু আবু রাশেদ। উনাকে উনার ফাইভ-এস মডেলের আই ফোন এখনো হাতে দেয়া হয়নি। এখনো সময় আসেনি। রাশেদ ভাইয়ের ফোনে কথা বললাম এক মিনিট। সালাম করার পরই বয়ান শুরু করার আলামত টের পেলাম। খুতবা তো প্রায় শুরুই করে দিলেন; ‘আলহামদুলিল্লাহ আজ তো… বাড়িতে কথা বললাম কাল …বুচ্ছেন…’!
থামিয়ে দিয়ে বললাম, এখনই সব বোঝানোর দরকার নাই। আস্তে-ধীরে বোঝালেই হবে। আর খুব একটা বোঝানোরও দরকার নাই। আমরা জানি। বরং আপনি যখন সেন্সলেস ছিলেন, যখনকার অবস্থা আপনি জানেন না, আমরা সেই সময়ের অবস্থাও জানি।
বললেন, আচ্ছা ঠিকাছে!
আর মনে মনে বললাম আহা বেচারা! তিন সাপ্তাহ ধরে পেটের ভেতর কথা জমা হয়ে আছে। কথাগুলো বাইরে বেরুবার জন্য কিলবিল করছে কিন্তু কেউ সেভাবে শুনতে চাচ্ছে না। যে মানুষের কথা শুনত সবাই, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, সেই মানুষ এক মিনিটের বেশি কথা বলতে চাইলে শ্রোতা থামিয়ে দিচ্ছে। বলছে, থাক, চুপ করে শুয়ে থাকুন। রেস্ট নিন। আপনার রেস্ট দরকার। কেউ বেশিক্ষণ কথা বলতে দিতে চায় না, এমনকি উনার আপন সন্তানের আপন মা পর্যন্ত। আজ সকালে ভাবি জানালেন,
অপারেশনের পর গতকাল প্রথম কথা বলেছেন বাড়িতে। ভাবি সূত্রে জানা গেল, হযরতের আহলে বয়তের মধ্যে উনার সবচে’ বেশি ভালোবাসা উনার সাত বছরের মেয়ে লুবাবার জন্য। মেয়ে যখন কাল সালাম দিল, বাবা শুরু করলেন অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। নমুনা-
মা! তোমার চুল তো খুব সুন্দর করে কেটেছো! কে কেটে দিল!
বাবা-মেয়ের সংলাপ দীর্ঘ্যস্থায়ী হতে পারেনি মেয়ের মায়ের কারণে। মা ফোন কেড়ে নিলেন… ‘আগে বাবা ভালো হয়ে উঠুক, তারপর অনেক কথা বলো, এখন বাবাকে রেস্টে থাকতে দাও’।
আনসারীর সন্তানদের মধ্যে এই মেয়ে একটু বেশিই পাঁকা! বক্তা আনসারী দেশে-বিদেশে কথা দিয়ে লক্ষ মানুষকে বশ করতে পারলেও এই মেয়ের সাথে কথায় পেরে ওঠেন না। প্রায়ই নাকি ধরা খান। এই যেমন বাবা-মেয়ের ফোনালাপ-
আনসারীঃ আমার মা কেমন আছে?
লুবাবাঃ মা ভাল আছে।
আনসারীঃ মা কি আমার জন্য দোয়া করছে?
লুবাবাঃ না করে তো উপায় নাই। ছেলে মাকে ভুলে যেতে পারে কিন্তু মা ছেলেকে কখনো ভুলতে পারে না।
এবার বুঝুন কোন ক্যাটাগরির মেয়ে।
মেয়েটি বেড়ে উঠুক দুধে-ভাতে।
==========
আনসারী নতুন করে কথা বলতে শিখছেন। অবশ্য মুখের জড়তা দূর হওয়ার জন্য কথা কিছু বলাও দরকার। আবার তিনি যে পরিমাণ কথা বলতে চাইছেন, সে পরিমাণ কথা বলাও ঠিক না। আর ফোনে কথা বলা তো এমনিতেই যে কোনো সুস্থ মানুষের জন্য ক্ষতিকারক। তাই ডাক্তারের পরামর্শ হল, ফোনে কথা না বলা।
এখানে একটি তথ্য জানিয়ে দেয়া যায়। নিউরো সাইন্টিস্টরা জানিয়েছেন, মোবাইল ফোন স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি। তারা বলেছেন, ‘কেউ যদি প্রতিদিন ৩০ মিনিট মোবাইল ফোনে কথা বলে আর এটা দশ বছর কন্টিনিউ করে, তাহলে তার ব্রেইন টিউমার হবার সম্ভাবনা ৯০%! কী ভয়াবহ ব্যাপার! আর একটু চিন্তা করলে যারা ডাক্তার না, তাদেরও ব্যাপারটি চট করে বুঝে ফেলার কথা। কোনো ওয়ার ছাড়া হাজার হাজার মাইল দূরের শব্দ শব্দ-তরঙ্গের মাধ্যমে সেকেন্ডের মধ্যে ক্যাচ করে নিয়ে আসছে; তাহলে কী পরিমাণ রেডিয়েশন এক্সপ্লোডেড হচ্ছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। অথচ কিছু মানুষ দুই মিনিটে শেষ করা যায়; কথাও কায়দা-কানুন করে বিশ মিনিট লাগিয়ে বলছে! তারা যদি স্বচক্ষে দেখতে পারত এর প্রভাব, তাহলে…
ছোট্ট একটি পরামর্শও সাথে থাকুক। যথাসম্ভব মোবাইল ফোনসেট কান থেকে দূরে রেখে কথা বললে ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশেই কমে আসে। সে ক্ষেত্রে হেডফোন বা এয়ারফোন ব্যবহার করা যায়। তবে ব্লুটুথ ডিভাইস কানে লাগানো ঠিক না। কারণ তাতে আর সরাসরি ফোন কানে লাগানোয় খুব একটা তফাত নেই।
==============
আজ নিউইয়র্ক থেকে দেখা করতে গেছেন মাওলানা রফিক আহমদ সাহেব এবং ইকবাল মাহমুদ। সাথে আছেন জামাল আখঞ্জি। আহমদ রশীদ সাহেবেরও যাওয়ার কথা ছিল। তিনি আর যাননি। যদিও বলেছেন উনার মেঝো মেয়ের ডক্টর এপয়েন্টমেন্ট আছে। তবে হতে পারে আগে থেকেই ভাবিকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার প্লান ছিল, লজ্জার কারণে সেটা বলতে পারেননি। আল্লাহ মালুম।
===============
বাংলাদেশ থেকে উলামায়ে কেরাম বা যাদেরই ইউরোপ-আমেরিকা আসার ইরাদা আছে, তাদের জন্য একটি নেক পরামর্শ হল, প্লিজ, ইংরেজিটা শিখে আসুন। তা নাহলে আপনি যতবড় মাপের মানুষই হোন, আপনি আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়িত হবেন না। ভাষাগত দুর্বলতার কারণে পদে পদে নানা বিড়ম্ভনার শিকার তো আর হবেনই। একজন বড় মাপের আলেমের কথা জানাই। নাম বললে অনেকেই চিনে ফেলবেন তাই নাম বলছি না। দেশে বোখারি পড়িয়েছেন দীর্ঘ্যদিন। অনেক যোগ্য আর মেধাবি আলেম তিনি। মাত্র ২৭ দিনে কোরআনে কারীম হিফজ করেছিলেন। তাহলে বুঝুন অবস্থা। অথচ এখানে আসার পর বোখারি পড়ালেও তিনি যে মাপের উস্তাদ, ছাত্রদের কাছে সে অনুযায়ী কদর পাচ্ছেন না কারণ, তিনি ক্লাসে ইংলিশে লেকচার করতে পারছেন না! যে কারণে ক্লাসের ছাত্র এবং উনার মধ্যে ভাষাগত একটি দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে!
ভাষাগত সাবলিলতা যে কত বেশি দরকার, দেশের বাইরে না বেরোলে কেউ বুঝতে চান না। প্রাসঙ্গিক একটি খণ্ডচিত্র শেয়ার করি।
গত পরশু ডিউটি নার্স ড আব্দুল মালিক সাহেবকে ফোন করে জানালো, রোগি ট্রিটমেন্ট নিতে চাইছেন না! বিস্ময়কর ব্যাপার! এমন তো হবার কথা নয়! ডাক্তার সাহেব একটু বিজি ছিলেন। ফোন করলেন মীর হোসাইন সাহেবকে। যান তো, একটু দেখে আসুন গিয়ে কী ব্যাপার? তিনি গেলেন। কথা বললেন আনসারীর সাথে। সমস্যার সমাধান হল। ঘটনা ছিল-
নতুন নার্স। নতুন নতুন জয়েন করেছে। সকাল বেলা সে এসছিল মুখের ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে প্রতিস্থাপিত অংশে ওয়েন্টমেন্ট জাতীয় কিছু লাগিয়ে দিতে। মজার ব্যাপার হল তিনি ইংরেজি বলতে পারেন না আর বেচারি বাংলার ‘ব’ও বুঝে না। তিনি তাকে বাঁধা দিয়ে ইশারা-ইঙ্গিতে বুঝাতে চেয়েছিলেন,
‘আমাকে করতে দাও। আমি নিজে নিজেই করতে পারব। আর সেটাই ভাল হবে কারণ, মুখ আমার, আমি ভাল জানি কোন সাইটে ব্যথা বেশি’।
কয়েকবার চেষ্টা করে সে যখন বাঁধাপ্রাপ্ত হল তখন ভাবল কোনো কারণে রোগি চাইছেন না ট্রিটমেন্ট নিতে। সে ফোন লাগালো ডাক্তারকে।
=======
রেডিয়েশন স্পেশালিস্ট, কেমো থেরাপিস্ট, ওরাল ডিপার্টমেন্ট… আজ সব বিভাগের ডাক্তাররা টেস্ট করলেন। আগামী কাল রিপোর্ট দেবেন তারা অপারেশন করা সার্জনদের কাছে। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে রেডিয়েশনেই চলবে নাকি কেমো লাগবে। তবে যাই লাগুক, কালকের পরপই হসপিটাল ছাড়পত্র দিয়ে দেবে। তারপরের কয়েক সাপ্তাহ রাখবার চেষ্টা করা হচ্ছে ড আব্দুল মালিক সাহেবের ছায়ায়। রোগী আনসারী প্রশ্নে আমরা দশজন সমান একজন ড আব্দুল মালিক।
=======
তিনি ভাল আছেন। তিনি ভাল হয়ে উঠছেন। অপ্রত্যাশিত কোনো সমস্যা না ঘটলে দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবেন তিনি। দোয়া অব্যাহত থাকুক।