ফাহিম বদরুল হাসান ::
নভেম্বরের মাঝামাঝিতে আকস্মিক ফেসবুকসহ কয়েকটি সোস্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। কারণ হিসেবে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী শ্রদ্ধেয়া তারানা হালিম বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শব্দে যে সব কথা বলে আসছেন তার মর্মার্থ হচ্ছে, দুষ্কৃতীকারীদের বিশৃঙ্খলা এবং রাষ্ট্রবিরোধীদের দুষ্কর্ম থেকে জনগণকে নিরাপদ রাখতে এই ঐতিহাসিক, দূরদর্শী এবং অত্যন্ত যুগোপযুগী (?) সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জান বাঁচানোর জন্য অভিমানী দুঃখ প্রকাশও করলেন সেদিন। সরকারের এই মহান সিদ্ধান্তের পক্ষে নিজ-দলীয় কিছু লোক ছাড়া কেউই সহমত নন। কারণ, এরকম সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কোথাও কোনো সরকার সুফল পেয়েছে কিংবা সফল হয়েছে, এমন নজির নেই।
ফেসবুকের কথাই যদি বলা যায়, এই সাইটটির ব্যবহারকারীরা মূলতঃ তিন ধরনের:
১- একধরনের লোক আছেন, যারা ফেসবুকে খুব আসক্ত। এটা যেনো তাদের নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তাদেরকে আইন দিয়ে কি থামানো সম্ভব?
মানুষের আসক্তিকে আইন দিয়ে দমিয়ে রাখার প্রচেষ্টার একটি উদাহরণ হচ্ছে, উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে আমেরিকান গভর্নমেন্টের মদ নিষিদ্ধকরণ। সরকারের সেই সিদ্ধান্তের কয়েকদিন যেতে না যেতেই আমেরিকানদের মধ্যে মারাত্মক কিছু ব্যাধি দেখা দিল! তদন্তে বেরিয়ে আসল, মদের ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেয়ায় মানুষ নিজ নিজ ঘরে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকরভাবে মদ তৈরি করে সেবন করতে গিয়ে আগের চেয়ে আরো অধিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। অধিকহারে মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থায় পড়ে USA গভর্নমেন্ট পূণরায় সকল ফ্যাক্টরী খুলে দিয়েছিল।
২- আরেক প্রকার মানুষ আছেন, যারা ফেসবুকে নিজেদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় আদর্শ নিয়ে নিয়ে লেখালেখি করেন। খুব সম্ভব সরকারের টার্গেট হচ্ছে, সরকার বিরোধী আদর্শভিত্তিক ব্যবহারকারীদেরকে শেকল পরানো। এখানেও প্রশ্নবোধক চিহৃ আসে। বিরোধী শিবিরকে এভাবে আটকানো আদৌ কি সম্ভব?
যদি (সরকারের ভাষায়) এদেরকে দুষ্কৃতীকারী কিংবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে ধরা হয়, তাহলে এটাও জানা দরকার যে, মানব ইতিহাসে কেউ কখনো আইনি বৈধতা নিয়ে কিংবা জায়েয তরিকায় দুষ্কৃতী করে না। হালাল পয়সা দিয়ে সরকারের সকল রুল-রেগুলেশন মেইন্টেইন করে আগ্নেয়াস্ত্র কিনে কেউ সন্ত্রাস করে না।
আর যদি বলা হয়, এই ডিস্কানেকশন শুধুই বিরোধীদের টুটি চেপে ধরার জন্য, তাহলেও ইতিহাস দেখা দরকার। তুর্কি সরকার টুইটার বন্ধ করার পর খোদ টুইটারই বিকল্প পথ বাতলে দিয়েছিল। মিশরে ফেসবুক বন্ধ করেও রেভুলেশন আটকানো যায় নি। প্রয়োজন কখনো আইন মানে না।
৩- আরেক প্রকার লোক আছেন, যারা খুবই সাদামাটা। এরা শুধু দেশে-বিদেশে থাকা বন্ধু-বান্ধব এবং সুজন-স্বজনের সাথে সামাজিক যোগাযোগ করতেই ফেসবুক ব্যবহার করে। সত্য কথা বললে, সরকারের এই হীন অমানবিক সিদ্ধান্ত শুধু সেই নিরব, নিরপরাধ এবং আইনের গণ্ডিতে থাকা মানুষগুলোই মূলতঃ কষ্ট করছে। অস্বস্তিতে আছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে তারা হয়তো প্রিয় মানুষের সাথে ভাইবার, হোয়াটসআপ কিংবা কোনো সাইটে কথা বলতো, আজ হয়ত তারা তা পারছে না।
শেষে শুধু একটাই প্রশ্ন, কারা হবে জয়ী? বিরোধী শিবিরে যারা, তারা? নাকি তারানা?
লেখক : প্যারিস প্রতিনিধি। সাংবাদিক, কলামিস্ট।