মানবজাতি একই উদর থেকে এলেও বসবাস-অঞ্চলের ভিন্নতা ধীরে ধীরে সৃষ্টি করেছে বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা। এটা শারীরিক, মানসিক, সামাজিক সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এই বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতার কারণে আবার জাতীয়তায় ভিন্নতা এসেছে। এসব বৈশিষ্ট্য, নৃতাত্বিক। একেক নৃ-গোষ্ঠীর রয়েছে একেক রকম সংস্কৃতি, একেক রকম সভ্যতা।
নৃতাত্বিক বৈশিষ্ট্য এতোটাই শক্তিশালী যে, অনেক সময় ধর্মীয় সভ্যতাতেও প্রভাব ফেলেছে। ধর্মের ভিন্নতা নিয়ে একত্রে বসবাস করা যতখানি কঠিন, তার চেয়ে বহুগুণে কঠিন হচ্ছে, নৃতাত্বিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা নিয়ে একত্রে বসবাস।
বাংলাদেশ। এতো অল্প ভূমিতে এতো বেশি জনসংখ্যা মানব-ইতিহাসে কোথাও কখনো ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা ছাড়া এই অঞ্চলে জাতিগত ফাটল ধরে নি কখনো। তার কারণ, একদিকে ধর্মীয় অঙ্গনে ফেরকাবাজির অনুপস্থিতি, অন্যদিকে নৃতাত্বিক বৈশিষ্ট্যের অভিন্নতা। নিজ নিজ ধর্ম, মতাদর্শ, চিন্তা-চেতনাকে কেউ অন্যের মুখোমুখি হতে দেয় নি।
দুঃখজনক হলেও সত্য; পৃথিবীতে অরাজকতা সৃষ্টি করে, জাতিতে জাতিতে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে যারা নিজেদের কর্তৃত্ব ফলাতে চায়, শাসনের নামে শোষণ করতে চায়, তারা বেশ ক’বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের মাস্টারপ্ল্যান করে যাচ্ছে। বাংলাদেশকে দুটি ভাগে বিভক্ত করতে অনেক ধরনের কার্ড ফেলা হয়েছে। সব কার্ডই খেলার বোর্ডে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
রাজনৈতিক বিরোধিতাকে জাতীয় বিভক্তিতে পরিণত করতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত সহ রাজনৈতিক দলকে প্রায়ই মুখোমুখি করে। কিন্তু ফল আসে না। দলীয় ভাবে উচ্চপর্যায়ে কিছু মতবিরোধ দেখা গেলেও তৃণমূলে জাতি একাকার। একই ঘরের এক দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর ছবি, তো অন্য দেয়ালে জিয়া। বাজারের রাজনীতি ঘরে ঢোকাতে পারে নি। তারপর “মুক্তিযুদ্ধ-চেতনা থিওরি” । এটাও অসার। এই ঔষধেও কাজ হচ্ছে না। মানুষ ব্যাক্তি-বিশেষে ঘৃণা বা শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ করলেও এই চেতনা ঘরে নিয়ে যেতে চায় না। দেখা গেছে, মুজিব-কোট পরে সারাবেলা জামাতের সকলকে বক্তব্যের মাধ্যমে পাকিস্তানে পাঠিয়ে রাতে এসে ভাইয়ের সাথে ভাত খায়, যে নাকি জামায়াতে ইসলামীর।
“আস্তিক-নাস্তিক থিওরি” তো মাঠে মারা গেল। যাদেরকে দিয়ে ডিভাইড করতে চেয়েছিল, তারা নিজেরাই এখন হাইড হয়ে আছে। যে ব্লগিংয়ের মাধ্যমে রেভুলেশন করতে চেয়েছে, সেই ব্লগিংটাই কলুষিত হয়ে গেছে। “ব্লগার” গালিতে রুপান্তরিত হয়ে গেছে। “হিন্দু/বৌদ্ধ-মুসলিম দাঙ্গা থিওরি”। এই বীজটাও শস্য দিচ্ছে না। মানুষ এটাকে স্থায়ী বিভেদ না করে রাজনৈতিক ইস্যু বলে এড়িয়ে যায়।
জাতিগত বিভক্তি করতে তাই এবার আমদানি করেছে, নতুন এক ফর্মুলার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটা বিদ্যমান থাকলেও বাংলাদেশে এই প্রথম। গেইম-প্ল্যানটা খুবই খতরনাক। একজনের ধর্মীয় কর্মে আঘাত। মুসলমানদের মাঝে হাজারো রকমের দলাদলি থাকলেও এখনো কেউ কোন মসজিদে, মাদরাসায় হামলা করে নি (দু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া, যা স্রেফ দেশীয় রাজনৈতিক)। এরকম চিন্তা-চেতনাই নেই বাংলাদেশের মানুষের।
শিয়া-সুন্নীর বিভীষিকা ঝলসে দিচ্ছে ইরাক থেকে ইরান,সিরিয়া থেকে পাকিস্তান সহ অনেক দেশে। এই বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে খুবই ঠান্ডা মাথায়। ঘরে ঘরে ঝগড়া না থাকলে মোড়ল থাকবে ভুখা, এজন্য বিশৃঙ্খলা লাগিয়ে রাখা। কয়েক বছর ধরে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার কেইস এনালাইসিস এবং ফিল্ড অবজারভেশন করলে প্রতীয়মান হয়, গত আশুরায় (24 শে অক্টোবর) ঢাকায় তাজিয়া মিছিলে হামলা এবং এই 26 শে নভেম্বরে বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলা কোনো মুসলমান নয় বরং যারা জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ফায়দা লুটতে চায়, তাদেরই সম্ভাব্য রুটিন ওয়ার্ক। “হামলায় সামান্য দু-চারজন মানুষ মরেছে” এই বলে হালকা ভাবে নেয়া মানে ঘোর অন্ধকারের দিকে পা বাড়ানো। কারণ, এখানে সংখ্যা নয় বরং একটি জাতির মূল্যবোধ জড়িত, যার কারণে অন্য মূল্যবোধকে আঘাত হানতে পিছপা হবে না। পৃথিবীতে ঘটছেও তাই।
অতএব, সরকারের উচিত খুবই সতর্কতার সাথে বিষয়টাকে আভ্যন্তরীণভাবে হ্যান্ডল করা। থার্ড পারসন প্ল্যোরাল নাম্বারকে যদি এটাতে জড়িত করা হয়, খাল কেটে ঘরে কুমির আনার মতো পরিস্থিতি হবে।