কমাশিসা ডেস্ক :: অন্যদের ফাঁসাতে গিয়ে এবার নিজেই ফেঁসে গেলেন আবদুল হক। মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর তেজগাঁও থেকে তাকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। যিনি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মুনতাসির মামুন, সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যার হুমকির নেপথ্য কারিগর। বুধবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে এমনই তথ্য দেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম। তিনি জানান, দেশের বিশিষ্টজন ও রাজনীতিবিদদের হত্যার হুমকির ঘটনায় তদন্তে নেমে পুলিশ হুমকি রহস্যের আদ্যোপান্তের সন্ধান পায়। মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘স্পুফিং’ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সাংবাদিক ও কলামিস্ট মিজানুর রহমান খানকে হত্যার হুমকি ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশের অব্যাহত অভিযানে তাকে আটক করা সম্ভব হয়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা মনিরুল জানান, ব্যক্তিগত শত্রুতা মেটাতেই আবদুল হক প্রযুক্তির ব্যবহার করে বিভিন্ন জনের মোবাইল নাম্বার ক্লোন করে দেশের বিশিষ্টজনের মোবাইলে হত্যার হুমকি পাঠাতেন। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকায় তিনি ফায়যুর রহমান, মাওলানা সাদ উদ্দিন ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সালেহ আহমদ ফুয়াদসহ বিভিন্ন জনের নম্বর থেকে হুমকিবার্তা দিয়েছিলেন।
এর আগে আনিসুজ্জামানকে হত্যার হুমকির ঘটনা প্রসঙ্গে ১৬ই নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক জানিয়েছিলেন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে যে নম্বর থেকে হুমকি দেয়া হয়েছিল, ওই নম্বর ব্যবহারকারীকে আটকের পর পুলিশ নিশ্চিত হয় মোবাইল ক্লোনিং করে হুমকিবার্তা গেছে অন্য আরেকজনের কাছ থেকে। সে আরেকজনই হলেন আবদুল হক।
আনিসুজ্জামানের কাছে যে নম্বরটি থেকে হুমকিবার্তা যায় একসময় সে ফোন নম্বরটি (০১৭৩৮-৭২৫৮১৫) ব্যবহার করতেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদিসের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সালেহ আহমদ ফুয়াদ। তবে এক যন্ত্রণার কারণে সে নম্বরের সঙ্গ ত্যাগ করেছিলেন তিনি। কীভাবে জানি তার মোবাইলে পরিচিতজনের কাছে আজেবাজে এসএমএস যেতে থাকে। কোন কিছুতেই যেন সমাধান পাচ্ছিলেন না। বাধ্য হয়ে গ্রামীণফোনের অফিসে গিয়ে ২০১৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর সিমটি বন্ধ করে দেন সালেহ ফুয়াদ। প্রিয় নম্বরটির সঙ্গে সেই তার সম্পর্কের শেষ।
গত ১১ই নভেম্বর ক্লাসে যাওয়ার আগ মুহূর্তে সালেহ ফুয়াদ চোখ বুলাচ্ছিলেন পত্রিকায়। দৈনিক প্রথম আলোয় ছাপা হওয়া অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে হত্যার হুমকির সংবাদে তার চোখ আটকে যায়। অভিযোক্ত নম্বরটি তার চোখে পড়ে। এটি তার বন্ধ করে দেয়া নম্বর। এ নম্বর থেকেই হত্যার হুমকি গেছে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাছে। আতঙ্কে হিম হয়ে যায় সালেহ ফুয়াদের শরীর। কী সর্বনাশ! একটু ধাতস্থ হয়ে ফোন দেন সিলেটে তার এক পরিচিতজনের কাছে। যিনি এমন ‘সর্বনাশে’র শিকার হয়েছিলেন।
হাফিজ ফায়যুর রাহমান। দু-দুবার আটক হয়েছিলেন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এসএমএসে হুমকির অভিযোগে। প্রথমবার আটক হন ২০১৩ সালের ১৪ই জুন অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ ছয় সংসদ সদস্যকে হুমকির অভিযোগে। প্রায় ৪ মাস কারাভোগ শেষে বেরিয়ে আসার পর ২০১৪ সালের ৩০শে জুন আবারও র্যাবের হাতে আটক হন তিনি। এবারও অভিযোগ, আইনমন্ত্রীর মোবাইলে হত্যার হুমকি দিয়ে খুদে বার্তা প্রেরণ। মসজিদে খতমে তারাবিহ পড়িয়ে আসা ফায়যুরের দু-দুটো রমজান কাটে কারাগারের অন্ধকারে। দুবার হুমকির অভিযোগে আটক হলেও ফায়যুরের দাবি তিনি ঘটনাগুলোর সঙ্গে মোটেও সংশ্লিষ্ট নন। তিনি আদালত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রমাণও দিয়েছেন তার সংশ্লিষ্ট না থাকার।
কোন উপায় পেতে সেই ফায়যুর রহমানকেই ফোন দেন সালেহ ফুয়াদ। ফায়যুর তাকে আশ্বস্ত করে বলেন, পুলিশের সাহায্য নিলে প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করা যাবে। ফায়যুর যোগাযোগ করেন সিলেট ডিবি অফিসে। কিন্তু কর্মকর্তারা ব্যস্ত থাকায় বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেননি। তবে পরে দেখা করার অনুমতি নিয়ে রাখেন।
এদিকে, নম্বরের সূত্র ধরে পুলিশ ট্র্যাক করছিল সালেহ ফুয়াদকে। সালেহ ফুয়াদের সঙ্গে কথোপকথনের সূত্রে ট্র্যাকিংয়ের আওতায় পড়েন ফায়যুর রহমানও। ওইদিনই পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে সিলেটে নির্দেশনা আসে ফায়যুরের সঙ্গে যোগাযোগের। ডাক পড়ে ফায়যুরের। বিকাল ৫টায় সিলেটে ডিবি কার্যালয়ে পৌঁছেন ফায়যুর রাহমান। ঢুকতেই প্রশ্ন ছুটে আসে, সালেহ ফুয়াদের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? সালেহ ফুয়াদের নম্বর থেকে হুমকি গেছে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাছে, এটা তিনি জানেন কিনা। ফায়যুর জানান, সে কথা জানিয়ে প্রতিকার চাইতেই তিনি এখানে এসেছেন। পুলিশ যোগাযোগ করে সালেহ ফুয়াদের সঙ্গে। ফুয়াদ পুলিশকে বলেন, তিনিও আসছেন। তৎক্ষণাৎ কুষ্টিয়া থেকে রওনা হন সালেহ ফুয়াদ। হাজির হন সিলেট ডিবি কার্যালয়ে। প্রমাণ দেন হুমকির ঘটনায় নিজের সম্পৃক্ত না থাকার।
ফায়যুর রাহমান ও সালেহ ফুয়াদ দুজনেই পুলিশের নজরে থাকেন। হেডকোয়ার্টার থেকে নির্দেশ পেয়ে ১৪ই নভেম্বর তাদের নিয়ে ঢাকায় রওনা হন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। পরদিন মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হন দুজন। নিজেদের সম্পৃক্ত না থাকার কথা দুজনেই জোর গলায় বলেন। তবে নিজেদের একটা সন্দেহের কথা জানান পুলিশের কাছে। সামনে আসে আরও একটি নাম। আবদুল হক। যিনি ফায়যুর ও ফুয়াদের সঙ্গে ‘মুক্তস্বর’ সাংস্কৃতিক ফোরামের সাহিত্য আসরে আসতেন। সালেহ ফুয়াদের সহকর্মী হিসেবে জকিগঞ্জের একটি মাদরাসায় কম্পিউটার শিক্ষকতাও করেছেন।
আবদুল হকের নাম আলোচনায় এসেছিল ফায়যুর রহমান প্রথম যখন আটক হয়েছিলেন তখন থেকেই। ফায়যুর রহমানের পরিবারের অভিযোগ, এসএমএস জালিয়াতি করে আবদুল হকই ফাঁসিয়েছিলেন ফায়যুর রহমানকে। ফায়যুর এককালে তার প্রতিবেশী আবদুল হকের বন্ধু ছিলেন। তবে পারিবারিক বিরোধের কারণে দুজনের সম্পর্কে ফাটল ধরে। পরিবারের অভিযোগ, সেই শোধ তুলতেই তিনি ফায়যুরকে বারবার ফাঁসিয়েছেন এসএমএস সন্ত্রাসের মাধ্যমে।
পরে আরও কয়েকটি এমন অভিযোগ উঠে আবদুল হকের বিরুদ্ধে। তারই কারসাজিতে হত্যার হুমকিবার্তা পান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আইনূর আক্তার পান্না ও ছাতক থানার ওসি শাহজালাল মুন্সি। শেখ সেলিমকে হত্যার হুমকির ঘটনায় ফেঁসেছিলেন আবদুল হকের মাদরাসার সহকর্মী মাওলানা সাদ উদ্দিন। আর ছাতকের ইউএনও এবং ওসিকে হুমকির দায়ে ফাঁসেন আবদুল হকের গ্রামের বাসিন্দা মোখলেসুর রহমান।
দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে পুলিশ অনেকটাই নিশ্চিত হয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাছে হুমকিবার্তা গেছে আবদুল হকের মাধ্যমেই। বিভিন্ন জায়গায় নিরন্তর অভিযানের পর অবশেষে পুলিশের খাঁচায় বন্দি হন আবদুল হক।
এটাও পড়তে পারেন
কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ
খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...