আকাবির আসলাফ- ১৪
হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উন্নতির যুগে বিশ্ববাসীর সামনে মানবজাতির ইহ ও পরকালীন কল্যাণের গ্যারান্টি ইসলামি দর্শন উপস্থাপন করেছিলেন, তা বাস্তবায়নের কেন্দ্র রূপে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্ববিখ্যাত দারুল উলূম দেওবন্দ। এই প্রতিষ্ঠান যে ক’জন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ মুসলিম জাতির সেবক ও সংস্কারকরূপে জন্ম দিয়েছিল তাদের অন্যতম একজন, শায়খুল হাদীস আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী রাহ.। তিনি ছিলেন যেমন একজন যুগশ্রেষ্ঠ শায়খুল হাদীস তেমনিভাবে মুফাসসির, মুফতি, সাহিত্যিক ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেনও বটে।
জন্ম ও বাল্য শিক্ষা
হযরত মুশাহিদ বায়মপুরী রাহ. ১৩২৭ হিজরি মোতাবেক ১৯০৭ ঈসায়ি সনের মুহাররাম মাসে বায়মপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ক্বারী আলিম উদ্দীন ও মাতা হাফিজা সুফিয়া বেগম। উভয়ই ছিলেন অত্যন্ত দ্বীনদার ও পরহেজগার। অতি অল্পবয়সেই আল্লামা মুশাহিদ পিতৃহারা হন, ফলে মায়ের অভিভাবকত্বেই তিনি লালিত পালিত হন। মাতা মুহতারামা বাংলা, উর্দূ ভাষায় শিক্ষিত ছিলেন। শৈশবে মা-ই ছিলেন তার উস্তাদ। মাত্র সাত বছর বয়সে মরহুম আল্লামা কুরআন শরীফ সহ উর্দূ ও বাংলা ভাষা আয়ত্বে আনতে সক্ষম হন। গুণবতী নারীর পরিচালনা ও দোয়ার বদৌলতে আল্লামা মুশাহিদ রাহ.-এর ভবিষ্যতে জীবনের ভিত্তি সূপ্রতিষ্ঠিত হয়। সাত বছর বয়সে মরহুম মাওলানা গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি হন এবং দশ বছর বয়সে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তৎকালীন কানাইঘাট ইসলামীয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। সে মাদরাসায় তিনি অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে সাত বছর অধ্যয়ন করেন। ঐ সময় হতে শুরু হয় পড়াশোনার সাথে তাঁর চিন্তা ও গবেষণা। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় যে, এ বয়সেই আল্লামাকে অত্যন্ত ভাবগম্ভীর দেখা যেত। সারারাত জেগে জেগে পড়াশোনায় মগ্ন থাকতেন। ইসলামীয়া মাদরাসা অধ্যয়ন শেষে তিনি কিছুদিন লালারচক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তিনি ছিলেন জ্ঞানের পাগল। সুতরাং ঐ চাকুরীতে তাঁর মন টিকলনা। কোথায় কিভাবে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করা যায় এই চিন্তায় সবসময় তার মনে জাগরুক ছিল।
উচ্চ শিক্ষালাভে বিদেশে গমন
চাকুরী পরিত্যাগ করে তিনি ভারতের যুক্ত প্রদেশের রামপুর আলীয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে পাঁচ বছর ইলমে হিকমত অধ্যয়ন করেন এরপর হাদিস অধ্যয়নের জন্য রামপুর থেকে চলে যান মিরাটে। সেখানে প্রখ্যাত শায়খুল হাদিস আল্লামা মশিয়াতুল্লাহ সাহেবের কাছে দুই বছর হাদিস অধ্যয়ন করেন এবং স্বীয় উস্তাদের আদেশে কাফিয়ার উর্দূশরাহ ইযাহুল মাতালেব এবং আরও দুটি কিতাব রচনা করেন। যা তার উস্তাদের নামে প্রকাশিত হয়।
দেশে ফিরে কানাইঘাট রহমানিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। প্রায় দুই বছর সেখানে শিক্ষক ছিলেন। তারপর জ্ঞান পিপাসায় পরিতৃপ্ত না হওয়াতেই তিনি জ্ঞানের সন্ধানে আবার দেশ ত্যাগ করেন। ১৩৫৬ হিজরিতে (১৯৩৬ইং) তিনি বিশ্ববিখ্যাত বিদ্যাপীঠ দারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তি হন। সেখানে তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ শায়খুল ইসলাম মুজাদ্দিদে মিল্লাত কুতবুল আলম হযরত আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর ব্যক্তিগত সান্নিধ্যে থেকে প্রায় দেড় বছর সেখানে লেখাপড়া চালিয়ে যান এবং দাওরায়ে হাদীসের সমাপনী পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। এই কৃতিত্বের জন্যেই তিনি শায়খুল ইসলাম আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ. কর্তৃক প্রশংসনীয় স্বীকৃতি লাভে সক্ষম হন।
দেশে ফিরে তিনি বিভিন্ন ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের জন্য কর্ম জীবনে আত্মনিয়োগ করেন। কর্ম জীবনে তিনি সিলেট সরকারি আলীয়া মাদরাসা, আসামের বদরপুর, গাছবাড়ী মাদরাসা উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে তিনি অত্যন্ত সুনামের সহিত হাদিসের খেদমত আঞ্জাম দেন। তাঁর ন্যায় হাদিস বিশারদ ইসলামি প-িত তখনকার বিশ্বে ছিল বিরল। আল্লামা বায়মপুরী মক্কাশরীফে হজ্ব পালনে হরম শরীফের খতীব সাহেবের আলোচনায় ভুল প্রমাণিত করে শায়খুল ইসলাম উপাধিতে ভূষিত হন। সর্বশেষ তারই লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দারুল উলূম মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। সেই মাদরাসার হাদীসের মসনদে বসে কুরআন হাদীসের শিক্ষাকে বিস্তার করে যান মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এবং তার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার মহাপরিচালক এবং শায়খুল হাদিসের দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। কানাইঘাট দারুল উলূম মাদরাসাকে কেন্দ্র করে পূর্ব সিলেটের প্রায় ১০০টি মাদরাসা নিয়ে গঠিত করেন পূর্ব সিলেট কওমী মাদরাসা বোর্ড। যাতে বর্তমানে দেড় শতাধিক মাদরাসা রয়েছে।
তিনি ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ আলোচক
ইলমে হাদিস খেদমতের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেরর বিভিন্ন সভা সেমিনারে আলোচক হিসাবে যোগদান করেন। তন্মধ্যে ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে কমিউনিজম আওর ইসলাম শীর্ষক সেমিনারে পান্ডিত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদদের মধ্যে যুগশ্রেষ্ঠ আলোচক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন।
তিনি ছিলেন একজন যুগ শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ। দারুল উলূম দেওবন্দের আকাবিরদের সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্তকৃত রাজনৈতিক সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের একজন সক্রিয়কর্মী ছিলেন।
তাঁর স্বীয় উস্তাদ শায়খুল ইসলামের হাত ধরে তিনি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। যার ফলশ্রুতিতে তদানিন্তন জাতীয় পরিষদের এম এল এ (মেম্বার) নির্বাচিত হন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশ নেন। তিনি বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসাবে ১৯৪৭ সালে ইসলামের নামে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ইসলামী রাজনীতির গাইডবুক ফাতহুল করীম ফিসিয়াসাতিন নাব্যিয়্যিল আমীন রচনা করেন।
যুগশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক
মরহুম তার জীবনকে শুধু দরস তাদরিসও রাজনীতির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি ছিলেন একাধারে বাংলা, উর্দূ, আরবী সাহিত্য জগতের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। সাহিত্যের প্রতিফলন গঠেছে তার রচনাবলীতে। বিশেষ করে ইসলামী রাজনীতির গাইড বুক ফাতহুল কারীম, তাসাওউফের উপর আল ফুরকান, বাতিলের বিরুদ্ধে সত্যের আলো ১ম ও ২য় খন্ড এবং ইযহারে হক প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া হাদীস, তাফসীর ও ফিক্বহ ইত্যাদি ফনে অনেক রচনা রয়েছে। যার অধিকাংশ এখনো অপ্রকাশিত।
চরিত্র ও ব্যবহারিক জীবন
পবিত্র কুরআনের বাণী হে নবী আপনি অতী উত্তম চরিত্রের অধিকারী। হাদীসের বাণী চরিত্রের পূর্ণতা দান করার জন্যেই আমাকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে। এর মাপকাঠিতে যাচাই করে দেখতে নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হয় যে, মাওলানার চরিত্র, সেই চরিত্রের আদর্শেই গড়ে উঠেছিল। বাহ্যিক ও রূহানী উভয়ক্ষেত্রেই। তিনি ছিলেন সুন্নতে নববীর প্রতিচ্ছবি। কি ইবাদত, কি অথিতি পরায়ণ, কি ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এবং অধ্যাপনার মসনদে সুন্নতে রাসূল ও আদর্শে সাহাবার প্রতিচ্ছবি। এ জন্য তার প্রাণপ্রিয় উস্তাদ শায়খুল ইসলাম মাদানী রহ. তাকে যে বিশেষ সার্টিফিকেট প্রদান করেছিলেন ইহা তার জীবনের প্রায় সকল দিকেই আলোচিত হয় এবং গর্ভনমেন্টের প্রিন্সিপাল আব্দুল আজিজও সে প্রশংসাপত্র দিয়েছিলেন ইহাও তাহার জীবনে বাস্তবিক প্রতিফলন ঘটেছে।
ওফাত
১৩৯০ হিজরি ১৯৭১ ঈসায়ি সালের ঈদুল আযহার রাত্রিতে শত সহস্র ছাত্র শিক্ষককে শোকসাগরে ভাসিয়ে যুগের শ্রেষ্ঠ ফখরে মিল্লাত শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুশাহিদ রহ. আমাদের কাছ থেকে চির বিদায় নিলেন।
উপসংহার
তার সংগ্রামী জীবন ছিল একটি বঙ্গোপসাগর। তার জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা যদি সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারি তবে কবি কণ্ঠে বলতে পারব, ‘ইযা জামা’ আতনা ইয়া জারিরুল মাজামিউ’। সংগৃহীত
আরও পড়ুন আকাবির আসলাফ-১৩ : মাওলানা শায়খ কাজী আবদুস সুবহান রাহ.