হামলার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি ভয় পেয়েছি, আশঙ্কা করেছি, এই বুঝি বলা হলো হামলাকারীরা ইসলামি জঙ্গি। দায় স্বীকার করে মাত্রই আইএসের টুইট এসেছে। শেষ পর্যন্ত তাই হলো, ফরাসী প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ এ হামলার জন্য আইএসকে দায়ী করেছেন। আমি জানি, প্রত্যেকবার এমন একেকটি হামলা হবে আর প্রত্যেকবার দায় আসবে ইসলামের ঘাড়ে। কলুষিত হবে ইসলামের মান। বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা বরাবরের মত আবারো হেনস্থার শিকার হবে।
ফ্রান্স আজ রক্তে রক্তে সয়লাব। প্যারিসের অন্তত ছয়টি জায়গায় সন্ত্রাসী হামলায় ১৫৩ জন মারা গেছে। সকালে ঘুম ভেঙে এ হামলার খবর দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। যে ১৫৩ জন নির্দোষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের জন্য গভীর বেদনা তো অনুভব করছিই; গভীরতর বেদনা অনুভব করছি শান্তির ধর্ম ইসলামের জন্যও। হামলার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি ভয় পেয়েছি, আশঙ্কা করেছি, এই বুঝি বলা হলো হামলাকারীরা ইসলামি জঙ্গি। দায় স্বীকার করে মাত্রই আইএসের টুইট এসেছে। শেষ পর্যন্ত তাই হলো, ফরাসী প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ এ হামলার জন্য আইএসকে দায়ী করেছেন। আমি জানি, প্রত্যেকবার এমন একেকটি হামলা হবে আর প্রত্যেকবার দায় আসবে ইসলামের ঘাড়ে। কলুষিত হবে ইসলামের মান। বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা বরাবরের মত আবারো হেনস্থার শিকার হবে।
এই অশুভ প্রবণতা শুরু হয়েছে ২০০০ সালের নাইন-ইলেভেনে সন্ত্রাসীদের অভিনব হামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গর্বের প্রতীক টুইনটাওয়ার ধ্বংশের পর। তারপর থেকে বিশ্বের যে প্রান্তে যখনই কোনো সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, কোনো অঘটন বা দূর্ঘটনা ঘটেছে, সঙ্গে সঙ্গে দোষ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে মুসলিম নামধারী কোনো জনগোষ্ঠির উপর। সন্দেহ করা হয়েছে মুসলমানদের বা নাম এসেছে মুসলমানদের অথবা দায় স্বীকার করেছে ইসলামি কোনো জঙ্গী সংগঠন। টুইনটাওয়ার হামলার পর থেকেই বিশ্বজুড়ে বিমানবন্দরে কড়াকড়ি। আর একেকটি হামলার পর এই কড়াকড়ি আরও বাড়ে। কারও নামের সঙ্গে আহমেদ, মুহাম্মদ, খান, চৌধুরী, সৈয়দ থাকলে তো আর কথাই নেই; তিনি চলে যান সন্দেহভাজনের তালিকায়। তিনি শাহরুখ খান বা এপিজে আবুল কালাম হোন না কেনো। কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে আহমেদ মোহাম্মদ নামে এক মেধাবী শিক্ষার্থী নিজের বানানো একটি ঘড়ি নিয়ে স্কুলে আসে সবাইকে চমকে দিতে। কিন্তু উল্টো চমকে যেতে হলো তাকেই। স্কুলের শিক্ষকরা ঘড়িকে বোমা ভেবে পুলিশে খবর দিল। পুলিশ এসে হাতকড়া পরিয়ে সেই স্কুলছাত্রকে থানায় নিয়ে যায়। স্কুলছাত্রটির আসল অপরাধ তার নাম আহমেদ মোহাম্মদ, সে একজন মুসলমান। এ নিয়ে পরে অনেক হৈচৈ হয়েছে। পুলিশের নিন্দা হয়েছে। এমনকি তার প্রতি এ অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাকে হোয়াইট হাউসে পর্যন্ত আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
কিন্তু বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের হেনস্থা করার দায় কার? অবশ্যই প্রথম এবং সিংহভাগ দায় মুসলমান নামধারীদেরই। তালেবান, আল কায়েদা, আইএস থেকে শুরু করে বাংলাদেশের জেএমবি, হুজি, হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম- সব সন্ত্রাসী সংগঠনই ইসলামের নামে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত। এসব সংগঠন জোর করে বিশ্বে ইসলাম কায়েম করতে চায়। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে থাকলেও ইসলামের নামে গড়ে ওঠা এসব সংগঠন আসলে এক বিনি সুতোর মালায় গাঁথা। তারা মুখে ইসলামকে রক্ষা করার কথা বললেও কাজে ইসলামকে ধ্বংস করছে, সারা বিশ্বে ইসলামের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে, ইসলাম সম্পর্কে ভুল বার্তা পাঠাচ্ছে। ইসলাম শব্দের অর্থই শান্তি। অথচ এই সংগঠনগুলো এই শান্তির ধর্মকে সন্ত্রাসের সমার্থক বানিয়ে ফেলছে। তালেবানরা আফগানিস্তানে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা হাজার বছরের পুরনো প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস করেছে, পাকিস্তানে নারী শিক্ষা বন্ধ করতে মালালার ওপর হামলা করেছে, আইএস বিদেশিদের ধরে জবাই করে তার ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছে, সিরিয়ায় প্রাচীন শহর ধ্বংস করেছে, বাংলাদেশে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম মুক্তমনা লেখক-প্রকাশকদের হত্যা করছে। গত বছর ফ্রান্সে রম্য পত্রিকা শার্লি অ্যাবদো অফিসে হামলা করেছে সেও ইসলামের নামেই। তার মানে একটি গোষ্ঠী প্রমাণ করার চেষ্টা করছে ইসলাম ঐতিহ্যবিরোধী, প্রগতিবিরোধী, নারীবিরোধী, শিক্ষাবিরোধী, মত প্রকাশের স্বাধীনতাবিরোধী। কিন্তু যারা সত্যিকারের ইসলামের চেতনা হƒদয়ে ধারণ করেন, তারা জানেন এই ধারণাটা মোটেই ঠিক নয়; বরং উল্টো।
বাংলাদেশে ইসলাম মানেই সুফিবাদ; সাম্য, সৌহার্দ্য, ক্ষমাশীল, পরমতধর্মসহিষ্ণু। শুধু বাংলাদেশ নয়, ইসলামের মূল চেতনা এটাই। আসল শিক্ষা এটাই। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন সন্ত্রাস দিয়ে যে ইসলাম কায়েম করতে চায়, তা প্রকৃত ইসলাম নয়। ইসলামের নামে এ হয়ত ভিন্ন কোনো মতলব লুকিয়ে আছে এতে।
ইসলামের আসল শত্রু পশ্চিমা বিশ্ব নয়, এই মৌলবাদী জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোই। জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় গত মাসে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল তাদের পূর্বনির্ধারিত বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছে। একই সময়ে ঢাকা ও রংপুরে দুই বিদেশি হত্যায় বেশ কয়েকটি পশ্চিমা রাষ্ট্র বাংলাদেশে ট্রাভেল অ্যালার্ট জারি করেছে। জঙ্গি বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান খুব ইন্টারেস্টিং। ব্লগার খুন হলে পুলিশ বলে এটা জঙ্গিদের কাজ। র্যাব মাঝেমধ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে টুপি পাঞ্জাবী পরিয়ে ইসলামি লেবাসে অস্ত্র, বোমা, জিহাদী বই-ক্যাসেটসহ জঙ্গিদের ধরেও। প্রচারযন্ত্রের সাহায্যে তা ফলাও করে মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়। কিন্তু যখনই বিদেশিদের ট্রাভেল অ্যালার্ট প্রসঙ্গ আসে, তখন সাফ অস্বীকার করে বসে, বাংলাদেশে আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই। অস্বীকার প্রবণতা সরকারের একটি বড় সমস্যা। প্রশ্ন ফাঁস? অস্বীকার। ভেজাল খাদ্য আমদানি? অস্বীকার। নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি? অস্বীকার। কিন্তু অস্বীকারে সমাধান খোঁজে কাপুরুষেরা। কোনো রকমে এরা গা বাঁচাতে চায়। সত্যিকারের সাহসীরা সমস্যা মোকাবিলা করে, এড়িয়ে যায় না। বাংলাদেশে জঙ্গি নেই, এটা যেমন সত্যি নয় আবার জঙ্গিরা বাংলাদেশের দখল নিয়ে নিয়েছে, এমনটাও বাস্তব নয়। দুর্বল হলেও জঙ্গিরা আছে। কম হলেও জঙ্গিরা এ দেশে আছে। তবে এর জন্য বাংলাদেশে কোনো কিছুই থেমে নেই। ট্রাভেল অ্যালার্টকে পাত্তা না দিয়ে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দল বাংলাদেশে খেলে গেছে। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল আসার সাহস না পেলেও ফুটবল দল আসছে। আরও অনেক কিছু হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে।
এটা মানতে হবে, বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদ একটি বড় সমস্যা। এটা শুধু ফ্রান্সের নয়, যুক্তরাষ্ট্রের নয়, অস্ট্রেলিয়ার নয়, যুক্তরাজ্যের নয়, বাংলাদেশের তো নয়ই। জঙ্গিবাদের ঝুঁকি বিবেচনা করলে বাংলাদেশের নাম পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশের পরেই থাকবে। এটা নিশ্চিৎ বলা যায়। ফ্রান্সের ব্যাপারে তো কোনো ট্রাভেল অ্যালার্ট ছিল না। ঘটনার দিন জার্মানি-ফ্রান্স বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচ চলার সময়ই স্টেডিয়ামের বাইরে হামলা হয়েছে। এখন তো নিশ্চয়ই ফ্রান্স ভ্রমণের ব্যাপারে কেউ ট্রাভেল অ্যালার্ট জারি করবে না। ফ্রান্সের এ হামলার পর প্রমাণিত হয়েছে, অ্যালার্ট না থাকা মানে নিরাপদ নয়, আবার অ্যালার্ট থাকা মানেই ঝুঁকিপূর্ণ নয়। জঙ্গিবাদ যেভাবে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে। ট্রাভেল অ্যালার্ট দিয়ে বাংলাদেশের মতো একটি উদীয়মান ভাইব্র্যান্ট রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করা কোনো কাজের কথা নয়। আর ট্রাভেল অ্যালার্ট দিয়ে নন্দদুলালের মতো ঘরে বসে থাকাটাও কোনো সমাধান নয়।
আপনি বাংলাদেশে আসবেন না, তো কোথায় যাবেন? ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য? সেখানে যে জঙ্গিরা হামলা করবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে? আইএস তো রাশিয়ায় রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে ক্রেমলিনের দখল নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তাহলে কি ট্রাভেল অ্যালার্ট দিয়ে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে হবে? সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করতে হবে বৈশ্বিকভাবেই। আর জঙ্গিবাদ মানে জঙ্গিবাদ, একে ধর্মের ব্র্যাকেটে ফেলে একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে কোণঠাসা করা বা একটি নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষকে হেনস্থা করার কোনো মানে হয় না। সব ধরনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সবাই মিলে লড়তে হবে। সন্ত্রাসীদের কোনো জাতি নেই, ধর্ম নেই, বর্ণ নেই, দেশ নেই। বিশ্বের কোথাও আমরা সন্ত্রাস চাই না। ফ্রান্সে তো নয়ই। আমরা বিশ্বজুড়েই বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ চাই; রক্তের গন্ধ নয়, চাই সাম্য ও নিরাপদ বিশ্ব।