অনলাইন ডেস্ক :: ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুক্ত সীমান্ত নীতি বজায় রাখাটা এখনও কতটা যুক্তিযুক্ত, সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল আগেই। সিরিয়া থেকে আসা শরণার্থীদের ঢল সামলাতে জেরবার ইউরোপীয় দেশেরা যখন একের পর এক দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে আশ্রয়প্রার্থীদের মুখের ওপর, তখন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলেছিলেন, ই ইউ যদি একটা সুসংহত শরণার্থী নীতি না নিতে পারে, তা হলে শেঙ্গেন চুক্তি পুনর্বিবেচনা করা দরকার। ১৯৯৫ সালে স্বাক্ষরিত যে চুক্তি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশদের মধ্যে সীমান্ত খোলা রাখা এবং নিয়মিত সীমান্ত পাহারা তুলে দেওয়ার নয়া নিয়ম চালু করেছিল। সিরীয় শরণার্থীদের চাপ সব থেকে বেশি সামলেছিল জার্মানি, সুইডেন এবং ফ্রান্স। এখন শোনা যাচ্ছে, সেই বদান্যতারই সুযোগ নিয়েছে আই এস জঙ্গিরা। প্যারিসে হামলা করার উদ্দেশে তারা ফ্রান্সে ঢুকেছে শরণার্থীর ভিড়ে মিশে। এর পর ইউরোপের কোনও দেশ শরণার্থীদের জন্যে তার দরজা খোলা দূরে থাক, খোলা মনে এ ধরনের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবে, এমন আশা করাও ভুল হবে। প্যারিসের হামলার পরই সেই ভিন্নস্বর শোনা যাচ্ছে। এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাপে পড়েই আমেরিকা কিছু সিরীয় শরণার্থীকে নিজের দেশে জায়গা দিতে রাজি হয়েছিল। প্যারিসের ঘটনার পরই মার্কিন কংগ্রেস সদস্য টেড ক্রুজ দাবি তুলেছেন, এখনই এ ধরনের কোনও পরিকল্পনা স্থগিত রাখা উচিত সরকারের। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই কোনও সিরীয় শরণার্থীকে আমেরিকার মাটিতে পা রাখতে দেওয়া উচিত নয়। মানবিক হওয়ার থেকেও এখন বেশি দরকার বাস্তববাদী হওয়া। একটু চাঁচাছোলা ভাষাতেই টেড বোঝাতে চেয়েছেন, ভিনদেশী কারা থাকার জায়গা পাচ্ছে না, খেতে পাচ্ছে না–র থেকেও এটা ভাবা বেশি জরুরি যে নিজের দেশের লোক নিরাপদে থাকছে কিনা।
টেড ক্রুজ এদিন আরও একটা জরুরি প্রসঙ্গ তুলেছেন যে, সম্প্রতি মিশরের সিনাইয়ে রুশ যাত্রীবিমান ধ্বংস এবং তার পর প্যারিসের এই পরিকল্পিত হামলা থেকে স্পষ্ট হচ্ছে, আই এস জঙ্গিরা স্রেফ সিরিয়া বা ইরাকেই নিজেদের উপদ্রব সীমাবদ্ধ রাখছে না। অন্য দিকে আইএসএ’র ক্রমশ বেড়ে চলা দাপটের মুখে আল কায়েদা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে, জোট বেঁধে না পারলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে পশ্চিমি দেশগুলোতে নাশকতা ছড়ানোর ডাক দিয়েছে। এই অবস্থায় প্রতিটি দেশের নিজের নিরাপত্তা নিয়ে সতর্ক হওয়া উচিত, বলেছেন টেড। ঠিক যে কথাটা এতদিন নানা প্রসঙ্গে ভাবছেন, বলছেন ইওরোপীয় নেতারাও। কারণ, শুধু শরণার্থীর চাপ না সামলাতে পেরেই নয়, এর আগে যতবার নাশকতা, হামলার ঘটনা ঘটেছে, এই নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলেই এর আগে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সীমান্তে অবাধ যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করার দাবি তুলেছে। এ বছরই আমস্টারডাম–প্যারিস এক্সপ্রেসে যাত্রীদের তৎপরতায় এক বন্দুকবাজ ধরা পড়ার পর ই ইউ সদস্য সব দেশ কার্যত স্বীকার করেছিল, শেঙ্গেন চুক্তি সংশোধনের সময় হয়েছে। যে দাবি অনেক আগেই তুলেছিল সদস্য দেশ স্পেন, ২০০৪ সালে মাদ্রিদের রেল স্টেশনে বিস্ফোরণ হামলার পর। কারণ শরণার্থীদের সঙ্গে সঙ্গে আনুষঙ্গিক বিপদ হিসেবে হাজির হয় আইন–শৃঙ্খলা রক্ষার সমস্যা। ২০১১ সালে উত্তর আফ্রিকা থেকে শরণার্থীর ঢল নামার পর ফ্রান্স এবং ইতালি ফের বলেছিল শেঙ্গেন চুক্তির পুনর্মূল্যায়ণ দরকার। শার্লি এবদো পত্রিকার আপত্তিকর কার্টুন নিয়ে প্যারিসে এ বছর জানুয়ারিতে তিন বন্দুকবাজের তাণ্ডবের পর সারা ইউরোপ থেকেই সেই দাবি আরও জোরদার হয়। কিন্তু এবারের হামলা সম্ভবত আরও কোনাে দ্বিতীয় চিন্তার সুযোগ খোলা রাখছে না।
এর পাশাপাশি রয়েছে আশ্রয়দাতা দেশের জনজীবনে আশ্রিতদের মিলমিশ না হওয়ার সমস্যা। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সব সময় স্বভাবতই চায় বহিরাগতরা নিজেদের সংস্কৃতি, প্রথা এবং ঐতিহ্য ভুলে নতুন সমাজের রীতিনীতি সাগ্রহে বরণ করে নেবে। ফলে আইন–শৃঙ্খলার সমস্যার কথা তুলে যখন মুসলিম মহিলাদের হিজাব নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় ফ্রান্সে, তখন সেই সংকটের আদত চেহারাটা সমাজের এক বড় অংশের কাছে অধরাই থেকে যায়। আবার অন্যদিকে মাথা–মুখ ঢাকা পোশাক যে সত্যিই নিরাপত্তার সমস্যা তৈরি করতে পারে, সেটাও বুঝতে পারে না, বা বুঝতে চায় না সামাজিকভাবে নিজেদের বিচ্ছিন্ন বোধ করা এক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। ফলে দূরত্বটা ক্রমশই বাড়তে থাকে। এমন এক অসহিষ্ণুতার পরিবেশে এধরনের জঙ্গি হামলা শুধু পারস্পরিক অনাস্থা আর অবিশ্বাসকেই আরও মজবুত করে।
সেই প্রেক্ষিতে, প্যারিসের এই হামলার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের উন্মুক্ত সীমান্ত ফের নজরদারি আর বিধিনিষেধের আগল তুলে বন্ধ করে দেওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিতভাবেই প্রবল হয়ে উঠল।
সূত্র: আজকাল