বুধবার, ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৪:৪২

ঈর্ষা

রেহনুমা বিনত আনিস ::1
সা’দ চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দেখতে পেল মায়া ড্রয়িংরুমের জানালার সামনে উদাস ভঙ্গিতে বসে আছে- রাতের অন্ধকারের পটভূমিতে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় পরীর মত লাগছে ওকে। সোফায় বসে পা দু’টো একটা মোড়ার ওপর তুলে দেয়া, দু’বাহু পরস্পরকে জড়িয়ে মুকুটের মত ধারণ করে আছে ওর প্রিয় মুখটা, পাশে টেবিলের ওপর একটা বই খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। বৌটাকে এভাবে একা বসে থাকতে দেখে দুনিয়াদারী কাজকর্ম সব ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে সা’দের। একটা মাত্র বৌ, তাও নতুন- কত, সবেমাত্র পনেরো বছর হোল, ওর তো ইচ্ছে মায়ার সাথে অনন্তকাল কাটানোর- কিন্তু একসাথে থাকা হচ্ছে কই? কাজ থেকে অবসরই যে মিলেনা!
সা’দের শব্দ পেয়ে হাসিমুখে উঠে আসে মায়া, ‘আসসালামু আলাইকুম!’
এ কি? ওর মুখে হাসি কিন্তু চোখের কোণে চিক চিক করছে দু’ফোঁটা অশ্রু। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে সা’দের। সে অস্থির হয়ে ওঠে, ‘মায়া, আমি কি তোমাকে কোনভাবে কষ্ট দিয়েছি?’
‘সে কি? হঠাৎ এ’কথা কেন?’, অবাক হয় মায়া।
‘তোমাকে কেউ কিছু বলেছে?’
‘কে আবার আমাকে কি বলবে?’
‘কোথাও কোন দুঃসংবাদ পেয়েছ?’
‘তুমি হঠাৎ এমন জেরা করা শুরু করলে কেন? কোন সমস্যা?’, কিছুই বুঝতে পারেনা মায়া।
‘তোমার চোখে জল কেন?’
‘কি!’, আশ্চর্য হয় মায়া, আঙ্গুল দিয়ে চোখের কোণ পরখ করে লজ্জা পেয়ে যায়, ‘ও কিছু না, তুমি খেতে এসো’।
সা’দের মনের ভেতর খচখচ করে। খেতে বসে বার বার মায়াকে বলে, ‘অ্যাই কি হয়েছে বলনা! তুমি কাঁদছিলে কেন?’
মায়াও ভীষণ লজ্জা পেয়ে বার বার বলে, ‘আমি কাঁদছিলাম না’।
সা’দ জানে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে মায়ার ভীষণ আপত্তি। সে সবসময় পরিবারের সবাইকে ছায়া দিয়ে, মায়া দিয়ে বেঁধে রাখতে চায়, কিন্তু নিজের সমস্যাগুলো কারো সামনে তুলে ধরতে চায়না, ওর সামনেও না। তাই তো এতবার করে জিজ্ঞেস করা।

খাওয়ার পর দু’জনে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসে গল্প করার জন্য। এই সময়টুকু একান্তই ওদের নিজেদের। কোনদিন বাসায় মেহমান থাকলে কিংবা দাওয়াতে গেলে এই সময়টা মার যায়- খুব আফসোস হয় সা’দের। কিছুক্ষণ গল্প করল ওরা- সারাদিন কে কি করেছে, বাবামা কেমন আছেন, বাচ্চারা কি কি দুষ্টুমী করল, সা’দের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ওরা কিভাবে ঘুমিয়ে পড়ল ইত্যাদি। এত কথার ভিড়েও প্রশ্নটা আবার সা’দের মাথায় চেপে বসল, মায়ার চোখে জল কেন? ওকে সা’দ কখনো সাধারন মেয়েদের মত কাঁদতে দেখেনি, বরং সা’দ ভেঙ্গে পড়লে মায়াই সাহস আর সংকল্প দিয়ে ওকে টেনে তুলেছে বার বার। সে যে কাঁদতে পারে তাই তো সা’দ জানতোনা!
‘মায়া!’
‘হুঁ!’
‘তোমার চোখে পানি দেখলাম, ভাল লাগছেনা। বলবেনা  কি হয়েছে?
‘আমি তো প্রায়ই চোখের পানি ফেলি, তুমিই দেখতে পাওনা। আজ একদিন দেখে ফেলেই অস্থির হয়ে গেলে?’ দুষ্টুমী করে মায়া।
সা’দের চোখে আতঙ্ক দেখে দুষ্টুমী উড়ে পালায় মায়ার। নাহ, এ’লোক দুষ্টুমীও বোঝেনা!
‘আচ্ছা, বলছি। হাসবেনা কিন্তু’।
সামনের দিকে ঝুঁকে আগ্রহ প্রকাশ করে সা’দ।
‘মুস’আব রা.’র জীবনী পড়ছিলাম। কেন যেন চোখে পানি চলে এলো’।
হাসি পায়না সা’দের, একটা সুক্ষ্ণ ঈর্ষাবোধ খোঁচা দেয় মনের ভেতর, ‘ও! সেই হ্যান্ডসাম সাহাবী?’
মায়া আবেগের সাথে কথা বলতে থাকে যেন শুনতে পায়নি, ‘তিনি সেই সাহাবী যিনি ইসলামের জন্য সকলপ্রকার প্রাচুর্য আরাম আয়েশ ত্যাগ করেন, মদীনায় রাসূল সা.’র আগমনের পটভূমি রচনা করার দায়িত্ব পান, যিনি রাসূল সা. কে রক্ষা করার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছান, যার জীবনের শেষমূহূর্তে বলা কথাগুলো আল্লাহ কুর’আনের অন্তর্ভুক্ত করে দেন, যার মৃত্যু রাসূল সা.কে কাঁদায়।’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মায়া, ‘আমার ভীষণ ঈর্ষা হচ্ছে ওনার জীবনী পড়ার পর থেকে’।
এবার সা’দের অবাক হবার পালা, ‘কেন? শ্রদ্ধা বোধ হতে পারে, মায়া লাগতে পারে, কিন্তু ঈর্ষা কেন বুঝলাম না’।
‘আচ্ছা শোন। এটা একটা কথা হোল, আল্লাহ একটা মানুষকে একই সাথে জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা, ব্যাবহার, সৌন্দর্য, প্রাচুর্য সবকিছু দিয়ে দিলেন; আর উনিও সুন্দর সবকিছু তাঁর রাব্বের জন্য উৎসর্গ করে দিলেন! এই কম্পিটিশনে আমাদের টেকার কোন সম্ভাবনা আছে?’
সা’দ ভেবে দেখল, ‘হুমম। প্রথমত এই জিনিসগুলোর মধ্যে সবগুলো আমাদের নেই বা ঐ পরিমাণে নেই। দ্বিতীয়ত, যতটুকু আছে তার সবটুকুই আমরা খরচ করছি পৃথিবীর আরাম আয়েশের জন্য। এভাবে ভেবে দেখা হয়নি’।

‘তারপর দেখ, তিনি একটি নতুন জায়গায় অপরিচিত লোকজনের মাঝে ইসলাম প্রচার করার কাজ নিয়ে চলে যান এবং অল্প সময়ে পরিস্থিতি অনুকুলে নিয়ে আসেন। আমরা কি এমনকি আমাদের সন্তানদের ইসলামে প্রবেশ করার পেছনে এত সাধনা করি?’
‘তাই তো? সন্তানদের খাওয়াপরা, পড়াশোনা, ভবিষ্যত চিন্তা নিয়ে আমাদের ভাবনার অন্ত নেই কিন্তু তাদের আখিরাত নিয়ে তো আমাদের ভাবার সময় হয়না!’
‘তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে পলায়নপর যোদ্ধাদের বার বার আহ্বান করছিলেন, ‘আর মুহাম্মদ একজন রাসূল বৈ তো নয়! তাঁর পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়েছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে তোমরা পশ্চাদাপসরণ করবে? বস্তুতঃ কেউ যদি পশ্চাদাপসরণ করে, তবে তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাদের পুরস্কৃত করবেন’। ভাব তো, বিশৃংখল পরিবেশ, কেউ কেউ ধারণা করছে রাসূল সা হয়ত আর নেই তাহলে যুদ্ধ করে কি হবে, সব এলোমেলো, এর ভেতর একজন দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে আমরা আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করি, রাসূল সা. থাকুন বা না থাকুন ইসলামকে টিকিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব! আর তারপর তিনি রাসূল সা.কে রক্ষা করতে করতে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিলেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁর কথাগুলো তাঁর মহান বানীর অংশ হিসেবে গ্রহন করে নিলেন। এর সাথে তুলনা করলে আমরা কোথায় স্থান পাই বল তো?’
‘আসলেই তো! আমরা তো নিজেদের কোনকিছুতে এক চুলও ছাড় দিতে রাজী না আল্লাহর দ্বীনের জন্য। আগে আমাদের প্রয়োজন, আরাম আয়েশ ঠিক থাকা চাই, তারপর সুযোগ থাকলে দ্বীনের কাজ। মনে হয় যেন আমাদের জন্য দুনিয়াটা ফরজ আর আল্লাহর সন্তুষ্টি হোল একটা শৌখিন ব্যাপার, সময় থাকলে করা যাবে।’
‘হুমম, তাই ঈর্ষায় চোখে পানি চলে এসেছিল। তুমি তো জানো আমি ভীষণ কম্পিটিটিভ, হারতে পছন্দ করিনা মোটেই, তোমার কাছে ছাড়া। কিন্তু কিয়ামতের মাঠে এঁদের ডিঙ্গিয়ে যাবার উপায় তো নেইই, বরং এঁরা যে স্ট্যান্ডার্ড সেট করেছেন তারপর বিচারে ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এসব ভাবলেই কেন যেন চোখে পানি চলে আসে’, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মায়া।
সা’দকে ভাবনায় ডুবিয়ে দিয়ে বাচ্চাদের গায়ে কাঁথা ঠিক আছে কিনা চেক করতে চলে যায় মায়া।
মায়া অন্যান্য মেয়েদের মত নয়। সা’দের চোখ দিয়ে না দেখলে সে সুন্দরী নয়। সবসময় গুছিয়ে থাকলেও স্বামীর জন্য সাজগোজ করা ছাড়া সে হালফ্যাশনের কোন তোয়াক্কা করেনা। ওর রান্না কোনক্রমে খাওয়া যায় যদিও সা’দের মুখে ওটা অমৃত মনে হয়, কোন শৌখিন রান্নাবান্না করার চেয়ে সে পড়তেই ভালবাসে বেশি। তবু কেন যে বৌটাকে এত ভাল লাগে সা’দের! এজন্যই কি যে সে প্রতিদিন ভোরে সা’দকে কপালে টিপ দিয়ে প্রভুর সান্নিধ্যে যাবার জন্য আহ্বান করে? নাকি এজন্য যে সে প্রতিদিন সৃষ্টিকর্তার বানী থেকে কিছু অংশ নিজে পড়ে, তারপর বাসার সবাইকে শোনায়? এজন্য যে সে সা’দের বাবামায়ের প্রতিটি প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখে, তার সন্তানদের গড়ে তোলার ব্যাপারে যত্নশীল বলেই সা’দ নিশ্চিন্তে এত রাত পর্যন্ত বাইরে কাজ করতে পারে? নাকি এজন্য যে মায়া প্রতিদিন ওর আখিরাতের মাপকাঠিটাকে একটু উঁচু করে দেয় যেটা অর্জন করার জন্য ওকে আরেকটু বেশি মনোযোগী হতে হয়, আরেকটু বেশি সচেষ্ট হতে হয়, গতকাল সে যেখানে অবস্থান করছিল তার চেয়ে আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতে হয়? এই তো সেই সাথী যার সাথে একটি জীবন কাটালে তার যথাযথ মূল্যায়ন হয়না, যার সাথে থাকার জন্য প্রয়োজন অনন্তকাল!

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই

খতিব তাজুল ইসলাম: বিগত আড়াইশত বছর থেকে চলেআাসা ঐতিহাসকি একটি ধারাকে মুল ধারার সাথে যুক্তকরে ...