ময়না বয়সে যুবক। মাসখানেক হয় একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকুরী ধরেছে। কাজের কোন অভিজ্ঞতা নেই তার্। অফিসের কাজ সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দিতে যেন হিমশিম খাচ্ছে। নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনীয় জ্ঞান, তথ্য, দক্ষতা, পারদর্শিতা, দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ ও কর্মকৌশল অর্জন করার জন্য অফিসের ম্যানেজার স্যার ট্রেনিং দিতে লাগলেন তাকে। বছর তিনেক চলে গেলো এভাবে।
সময় যত যাচ্ছে ময়না কর্মঠ হয়ে উঠছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনার পারদর্শিতা, কাজ আদায়ের কৌশল সব যেন এখন তার আয়ত্বে। চোখমুখ ফুঠে উঠেছে তার্। এখন সে সব চেনে, সব জানে। তার মাঝে স্বপ্ন আর স্বপ্ন। বেতন বাড়াতে চায়। প্রমোশন চায়। ম্যনেজারকে টপকে তার চেয়ার দখল করতে চায়।
একদিন ম্যানেজার স্যারকে তার স্বপ্নের কথা খুলে বললো। ম্যানেজার তার কথা শুনে কতক্ষণ চুপ থেকে একটু হাসলেন। তারপর দরদভরা সুরে বললেন –
– সব মানুষেরাই স্বপ্ন দেখে। তোমার স্বপ্ন দেখা অন্যায় নয়। তবে তুমি চাচ্ছো রাতারাতি বড় হয়ে যেতে। সমাজে যারা বড় হয়েছেন তারা ধীরে ধীরে বড় হয়েছেন। যারা রাতারাতি বড় হয়েছেন তারা শেষ জীবনে হোচট খেয়েছেন। যাক, বেতন বাড়ানোর বিষয়ে আমি চিন্তা করবো। তবে প্রমোশন এখনও না। তুমাকে আরো যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। আরো অনেক ট্রেনিং নিতে হবে। ভিবিন্ন ব্রাঞ্চে সফর করতে হবে। একজন দক্ষ অফিসার হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। এজন্যই তো তোমাকে তিল তিল করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। তুমাকে যে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে এই ট্রেনিং একদিন খুলে দেবে তোমার উন্নতির দুয়ার্। সাফল্য ও সৌভাগ্যের দুয়ার্। রাতারাতি বড় হওয়ার জন্য এতো হৈচৈ শুরু করলে হবে না। আরো একটু অপেক্ষা করতে হবে তোমাকে।
স্যারের কথা শুনে শক্ত হয়ে গেছে ময়নার মুখ। মনভাঙ্গা ভাব নিয়ে উঠে গেলো সে। মনে মনে ভাবতে লাগলো, এই কোম্পানিতে থাকলে ম্যনেজার স্যারকে টপকে যাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। আমাকে অন্য পথ খুজতে হবে।
চায়ের দোকানে একদিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হাসানের সাথে দেখা। বন্ধু ‘হাসান’ প্রায় অর্ধশত বছরের পুরনো অন্য একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকুরী করে। ময়না তার স্বপ্নের কথাগুলো বন্ধু ‘হাসান’কে খুলে বললো।
‘হাসান’ অফার করলো তার কোম্পানিতে। সে বললো –
– আমাদের কোম্পানিতে চলে এসো। এমডি স্যারের সাথে আলাপ করে তোমাকে একটি এরিয়া ম্যনেজার করে দিব। সেখানে চেয়ার আছে। গাড়ী আছে। বাড়ী আছে। সব সুবিধাই আছে।
লোভনীয় অফার ময়নার অন্তরে নাড়া দিলো। হাকিমপুরী জর্দা মিশিয়ে পান চিবাতে চিবাতে বলে উঠে সে –
– তোমাদের কোম্পানি তো আমার জন্মের আগের্। সারা দেশে মনে হয় তোমাদের ব্রাঞ্চ নেই? সেখানে গিয়ে আমি কতটুকু লাভমান হতে পারবো?
হাসান বলল –
– ঠিক বলেছ বন্ধু। আমাদের কোম্পানি অনেক পুরাতন। এ কোম্পানিতে চাকুরী করে অনেকেই নতুন কোম্পানি করেছেন নতুন চিন্তা ও চেতনা নিয়ে। অনেকেই সফল হয়েছেন। তোমাদের কোম্পানির মতো সব জায়গায় ব্রাঞ্চ নেই। যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তির খুব অভাব এখানে। তোমাদের কোম্পানি যেভাবে লোকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলে আমাদের এভাবে কোন কর্মসূচি নেই। বড়দের কোন পরিকল্পনা নেই। এজন্যই আমাদের কোম্পানিতে যোগ্য লোকের কদর বেশি। প্রমোশন সহ সব ধরণের সুবিধা পেতে বেশি বেগ পেতে হয়না।
– ঠিক আছে বন্ধু, তোমার এমডি স্যারের সাথে আলাপ করে দেখো আমাকে কতটুকু মুল্যায়ন করবেন।
এক সপ্তাহ পর ময়নাকে হাসানের ফোন।
– বন্ধু, এমডি স্যারের সাথে আলাপ করেছি। তোমার কথা শুনে স্যার দারুন খুশি। তুমি আগামী মাসেই জয়েন করতে পারবে। তোমাকে বিভাগীয় ইনচার্জ করে দেওয়া হবে। সময়ের ব্যবধানে আরো অনেক উপরে উঠতে পারবে, যদি তোমার অর্জিত দক্ষতা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগাতে পারো।
লোভে পড়ে গেলো ময়না। যে কোম্পানি তাকে যোগ্য ও দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তুলেছিলো সেই কোম্পানির অবদানকে যেন লোভনীয় অফার পাওয়ার সাথে সাথে ভুলে গেলো।
হাসানকে কথা দিয়ে দিলো যে, আগামী মাসেই জয়েন করবে।
পরের দিন ময়না অফিসে গিয়েই ম্যানেজার স্যারকে সাফ জানিয়ে দিল যে, সে আগামী মাস থেকে আর কাজ করবে না।
ময়নার কথা শুনে চমকে উঠেন ম্যানেজার স্যার্। তার ভেতরের সবকিছুই জ্বলছে। সবকিছু পাকিয়ে রূপ নিয়েছে এক বিরামহীন যন্ত্রনায়। দুর্বল ‘ময়না’ থেকে স্মার্ট ‘ময়না’র সব ইতিহাস ভেসে উঠলো তার চোখের সামনে।
নোট : এই গল্প কারো চরিত্রের সাথে মিলে গেলে আমি দুঃখিত।
লেখক : সংগঠক ও কলামিস্ট