কোন দলের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তাই কোন দলের সাথে আমার কোন হিংসা বা মহব্বত নেই। এই ফালতু ছবিগুলোর ব্যাপারে আমি কথা না বললেও পারতাম। তবু যখন গায়ে কাঁদা লাগিয়ে ফেলেছি, তাই বিবেক বলছে একটি কৈফিয়ত লিখতে যে, আমি কেন এই বিষয়ে গায়ে কাঁদা লাগালাম? প্রকৃত অর্থে কোরবানির পশুর মতো গলায় মালা লাগিয়ে এই ছবিগুলো যখন ‘জমিয়তের পয়গাম’ নামক ফেইসবুকে প্রচার করে আমার ফেইসবুক দেওয়ালে ট্যাগ করা হলো, তখন মনে মনে খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম ইসলামি একটি গ্রুপের মূর্খতা বা জেহালতি দেখে। অনেক সময় নিয়ে ভাবলাম, মন্তব্য করবো কি না সেই বিষয়ে। অতঃপর মন বললো, এভাবে কুরবানির গরুমার্কা ছবি তোলার বিরুদ্ধে নিন্দা জানানো প্রয়োজন। বিবেক থেকে লিখলাম, মাফ করবেন আমাকে। কেন জানি আমার কাছে তা কুরবানির হাট মনে হচ্ছে।
আপনাদের আকাবিররা নেতা নির্বাচিত হলে এমন করেন নি বলে আজও তারা সমাজে সম্মানিত। আর আপনারা রঙিন চশমা চোখ থেকে সরিয়ে দেখুন আপনাদের স্থান কুরবানির হাটের কোথায়। আবারও মাফ চাচ্ছি। সাইফুল নামক জনৈক ব্যক্তি এতে বললেন, ‘জনাব মবনু, আলেম-উলামাদের বিষয়ে মন্তব্য করার ভাষা কি আপনাকে কেউ শিক্ষা দেয় নি। আপনার মতলব খারাপ।’ আমি তখন উত্তরে লিখলাম, আমার মনটা বড় বেয়াদব হয়ে গেছে আকাবিরদের সংস্পর্শে। আমি যে আকাবিরদের কাছ থেকে শিখেছি, তাদের শিক্ষায় নেতা নির্বাচিত হলে তারা এভাবে কুরবানির হাটের গরুর মতো গলায় মালা দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতেন না। আপনি প্রশ্ন করেছেন, আমাকে কি কেউ আলেমদের শানে কীভাবে কথা বলতে হয় তা শিখায়নি? আমি উত্তরে বলেছি, অবশ্যই শিখাইছেন। আমাকে শিখানোওয়ালা শিক্ষকদের মধ্যে শায়খে কৌড়িয়া রাহ., শায়খে কাতিয়া রাহ., শায়খে গাজিনগরী রাহ, দরগার ইমাম সাহেব রাহ., শায়খে বর্ণভী রাহ., শায়খে ঢলমন্ডলী রাহ., শায়খে চকরিয়া রাহ., শায়খে সিকন্দর আলী রাহ., শায়খে গহরপুরী রাহ., শায়খে হেমু রাহ., মাওলানা শামসুদ্দিন কাসেমী রাহ. সহ আরো অনেক। তবে শায়েখদের তরিকতে এইসব কোরবানির হাট নেই। অতঃপর জমিয়তের পয়গাম থেকে আমাকে উপদেশ দেওয়া হলো, ‘আসলে মবনু ভাই, আপনি আপনার চিন্তার পাঠশালা নিয়ে ব্যাস্ত থাকা ভালো। ঐ দিকটা ছেড়ে দিন না।’ আমিও ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এই উপদেশকে সম্মান করে। কিন্তু সাইফুল ইসলাম নামক ব্যক্তি এসে মন্তব্য করলেন, ‘মবনুর লেবাস দেখে মনে হল জামাতের লোক! তাকে পরিহার করা দরকার।’ তখন আমার একটি মালাওয়ালা কোরবানির ছবি পোষ্ট করা ছাড়া আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই বলে মনে হয়।
আগেই বলেছি, আমি কোন দল করি না। তবে জামিয়তের ইতিহাস জানি এবং বুঝি। শ্রদ্ধা করি জমিয়তের আধ্যাত্মিক রাহবার, ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী রেশমি রোমাল আন্দোলনের নেতা শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান রাহ.কে। তাও জানি, শায়খুল হিন্দের জমিয়তের নাম ছিলো- জমিয়তে আনসার। শায়খুল হিন্দের ইন্তেকালের পর পাকিস্তান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শায়খুল হাদিস আল্লামা শিব্বির আহমদ উসমানি রাহ.’র নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের পক্ষে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং কুতবে আলাম সৈয়দ হোসাইন আহমদ মাদানি রাহ.’র নেতৃত্বে ভারতের পক্ষে জামিয়তে উলামায়ে হিন্দ।
জামিয়তে উলামায়ে হিন্দে শায়খে কৌড়িয়া, শায়খে ফুলতলি প্রমূখের নেতৃত্বে বেশিরভাগে ছিলেন সিলেট অঞ্চলের আলেম সমাজ। আল্লামা সহুল উসমানি যেহেতু তখন ঢাকায় থাকতেন, তাই ঢাকাসহ বাকী বাংলাদেশে বেশির ভাগ আলেম সমাজ আল্লামা সহুল উসমানি, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, মাওলানা আতহার আলি সিলেটি প্রমূখের নেতৃত্বে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামে ছিলেন। আজকের জমিয়তের নেতা মাওলানা মুহিউদ্দিন খান মূলত শিব্বির আহমদ উসমানির জমিয়তে উলামায়ে উসলামের লোক। এই ভাগটা পাকিস্তানের জমিয়তেও ছিলো।
মুফতি মাহমুদ সাহেবের নেতৃত্বে ভারতপন্থী জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ আর মুফতি শফির নেতৃত্বে পাকিন্তানপন্থী জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। একাত্তরের স্বাধিনতা যুদ্ধের সময়ও এই ভাগ অনেক কাজ করেছে। মুফতি মাহমুদ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের পক্ষে আর মুফতি শফি সাহেব ছিলেন পাকিস্তান সেনা শাসকের পক্ষে। পাকিস্তান হওয়ার পর ভারতপন্থী জমিয়ত দুর্বল হয়ে যায় এবং এই গ্রুপের সবাই আস্তে আস্তে পাকিস্তানপন্থী জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্লাট ফরমে এসে দাঁড়ান।
একাত্তরের পর আবার পাকিস্তানপন্থী জমিয়ত দুর্বল হয়ে যায় এবং ভারতপন্থী জমিয়ত শক্তিশালী হতে থাকে এবং তা শায়খে কৌড়িয়া বেঁচে থাকা পর্যন্ত ছিলো। শায়খের মৃত্যুর পর এই গ্রুপের নেতৃত্ব কিছুটা গ্রুপিং-এর কারণে দুর্বল হয়ে যায় এবং চারদলীয় জোটের রাজনীতিতে নির্বাচনে সুযোগ লাভের আশায় মাওলানা মুহিউদ্দিন খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানপন্থী জমিয়তিদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। সিলেটের তরুণ এবং অর্থনৈতিকভাবে সবল নেতারা নির্বাচনের দৌঁড়ে আটকে যান মাওলানা মুহিউদ্দিন খানের কব্জায়। বিশেষ করে সিলেটে মাওলানা শাহিনুর পাশা এবং লন্ডনে মাওলামা শোয়াইব এই গ্রুপকে সিলেট অঞ্চলে শক্তিশালী করায় মূল ভূমিকা পালন করেন। বিশাল জৌলুসের নীচে হারিয়ে যায় জামিয়তে উলামায়ে হিন্দের ধারার নেতৃত্ব। এসব ইতিহাস এতই তীক্ষ্ণ যে, জমিয়তের ইতিহাস পূর্ণাঙ্গরূপে না জেনে কেউ তা বুঝতে পারবে না। এবার যারা জমিয়তের নেতৃত্বে আসেছেন, তারা মূলত পাকিস্তানপন্থী জমিয়তি নেতাদের উত্তরসূরী। যদিও তারা দাবী করেন তাদের আকাবির শায়খুল ইসলাম সৈয়দ হোসাইন আহমদ মাদানী। মাওলানা মুহিউদ্দিন খান সাহেবের আজীবনের সম্পর্ক মুফতি শফি ও তাঁর ছেলে মুফতি তক্বী-মুফতি রফি প্রমূখের সাথে। একসময় পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশ থেকে লেখাপড়ার জন্য ভর্তি হতে যে ক’জন আলেমের সুপারিশ পাকিস্তান এম্বেসি গুরুত্ব দিতো, তার মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন মাওলানা মুহিউদ্দিন খান। এসব ছাড়া আরও অনেকগুলো বিষয় আছে। খান সাহেব দীর্ঘদিন জমিয়তের বাইরেও থেকেছেন শুধু মাদানীপন্থী জমিয়তিদের সাথে মতানৈক্যের কারণে। শেষ পর্যন্ত চারদলীয় রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব বৃদ্ধিতে আসনের প্রশ্নে তরুণরা তাঁর হাতকে শক্ত করলেও আকাবিরদের পালে আর বাতাস লাগে না। এখন আকাবির হলো শুধু শ্লোগানে, আদর্শে নয়। আদর্শ হলো জোট আর মহাজোট।
আমি কোন দল করি না আগেও বলেছি। পারিবারিকভাবে জমিয়তের আলেম-উলামাদের সাথে আমাদের আত্মার সম্পর্ক। বিশেষ করে আমার বাবার সাথে সবার সম্পর্কটা অত্যন্ত গভীরে ছিলো। প্রায় সবাই আসতেন আমাদের বাসায়। যারা সিলেট শহরের বাইর থেকে আসতেন, তারা কেউ কেউ আমাদের বাসায় থাকতেনও। ইংল্যান্ডেও আমি দেখেছি, তারা গেলে আমার বাবার খুঁজে যেতেন এবং কেউ কেউ থাকতেনও।
এভাবেই এই বুজুর্গদের সাথে আমার সম্পর্ক হয়ে যায়। বিশেষ করে শায়খে কৌড়িয়া রাহ., যাঁর শাহাদত আঙ্গুলে ধরে আমি ছোটবেলা বৃহত্তর সিলেট ঘুরে ঘুরে দেখেছি। আজও সেই বুজুর্গদের অনেকই বেঁচে আছেন যাদের সংস্পর্শে আমি গিয়েছি শায়খে কৌড়িয়ার আঙ্গুল ধরে। শায়খে কৌড়িয়া আমাকে স্নেহ করতেন বলে এই বৃহত্তর সিলেটের বেশিরভাগ আলেম তখন আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। আজও যারা বেঁচে আছেন, তারা স্নেহ করেন। তাদের স্নেহ-ভালোবাসা আজও আমাকে বেঁধে রেখেছে আকিদার অনেক গভীরে। শুধু বাংলাদেশে নয়, এই ধারার পাক-ভারতের বড় বড় অনেক আলেমের সংস্পর্শে আল্লাহপাক আমাকে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। আমি তাদের কারো মধ্যে এমন চরিত্র কোনদিন দেখিনি, যা এবার জমিয়তের নেতারা নেতা নির্বাচিত হয়ে দেখালেন। এখন চলছে ফান্টাসির যুগ, জমিয়তেও ফান্টাসী চলছে, এতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু জিনিষটি যদি আমার কাছে কোরবানির হাটের গরুর মতো মনে হয়, তা কি আমি প্রকাশ করবো না! আর জুনায়েদ আল হাবিব! জমিয়তে এই মানুষটা একেবারেই বেমানান।
আমি যে আকাবিরদের সংস্পর্শে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে দেশ-বিদেশে দেখেছি, তাদের কাউকে নেতা হওয়ার পর এরকম করে নির্লজ্জ খুশি প্রকাশ করতে কোনদিন দেখিনি। গ্রুপিং হয়েছে, বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি হয়েছে, কিন্তু আলোচ্য বিষয় থেকেছে ঈমান ও আকিদা। কোথাও অহংকারকে জাহিলদের মতো এভাবে প্রকাশে নিয়ে আসা হয়নি। এবার বড়ই নির্লজ্জের মতো কাজটি হয়েছে।
এবারে যারা নেতৃত্ব লাভ করেছেন, তাদের মধ্যে অনেক তো আমার বন্ধু পর্যায়েই আছেন। তাদের কারো সাথে আমার কোন বিরোধ নেই। তবে জুনায়েদ আল হাবিবকে আমার কাছে আব্দুল্লাহ বিন উবাই বিন সলুলের মতো মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কাসেমি সাহেব সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা এখনও নেই। তবে একটা কারণে আমার কাছে মনে হয়েছে তিনি কিছুটা সরল মানুষ। বাকী মুফতি ওয়াক্কাস সাহেব তো এরশাদের মন্ত্রী, অবশ্য এতেও আমার কোন আপত্তি নেই। মানুষের জীবনে ভুল হয়, মানুষ আবার তাওবাহ করে। এই আলেমরাও মানুষ। তারা অবশ্যই নবী-রাসুল-সাহাবা নন, তাদেরও ভুল হবে। তবে ভুলকে যদি কেউ অহংকারে নিয়ে কুতর্কে জড়িয়ে যান, তবে মানব সৃষ্টির ইতিহাসে পড়ে নিতে হবে ইবলিসের ধ্বংসের কারণ। তারা নেতা হয়ে খুশি প্রকাশ করে শুধু আকাবিরদের নীতির খেলাফ করেছেন বলে আমার কষ্ট, তা কিন্তু নয়। বরং তা হযরত নবী করিম সা.’রও নীতির খেলাফ। স্মরণ রাখতে হবে, হযরত রাসুলুল্লাহ সা.’র ঘোষণা,- ‘আল্লাহর শপথ, যে ব্যক্তি নিজে কোন পদ লাভ করার ইচ্ছা প্রকাশ করবে কিংবা কোন পদের প্রতি লোভ প্রদর্শন করবে, তাকে আমি কখনই কোন পদে নিযুক্ত করব না’। (বোখারী-মুসলিম)।
অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সা.. বলেন, -‘যে নিজের জন্য পদ দাবী করে, তাকে পদ দান করা যাবে না’।আরেক হাদীসে রাসুলুল্লাহ সা. বলেন,- ‘তোমাদের মধ্য থেকে যে লোক এই দায়িত্ব ও গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার জন্য নিজ থেকে আগ্রহী হবে, পেতে চাইবে, চেষ্টা করবে আমার মতে সে তোমাদের মধ্যকার সব চাইতে খিয়ানতকারী ব্যক্তি’। রাসুলুল্লাহ সা.’র এই স্পষ্ট ঘোষণা থেকে আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে, ইসলামের দৃষ্টিতে নির্বাচনে নিজে প্রার্থী হওয়ার জন্য চেষ্টা করা, প্রার্থী হওয়ার জন্য লবিং করা, দেওয়ালে দেওয়ালে নিজের চামচা দিয়ে লেখানো ‘অমুককে’ আমরা আগামীতে প্রার্থী চাই ইত্যাদি হারাম। আর যদি তা হয় ইসলামী কোন দলের নেতৃত্ব নিয়োগ, তবে অবশ্যই নেতা হওয়ার চেষ্টা, নেতা হওয়ার খায়েশ, নেতা হওয়ার জন্য টাকা খরচ, নেতা হয়ে এভাবে ফুলের মালা গলায় দিয়ে খুশি প্রকাশ, সম্বর্ধনা সভা করা ইত্যাদি হারাম।আমি আশা করবো, তারা এই মালাওয়ালা গলার ছবিগুলো সরিয়ে দিবেন আকাবিরদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে।
লেখক : কবি ও গবেষক
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কমাশিসা-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কমাশিসা কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।