‘লোকে বলে, বলে রে, ঘর-বাড়ী ভালা না আমার
কী ঘর বানাইমু আমি, কী ঘর বানাইমু আমি
শুন্যেরও মাঝার, লোকে বলে, বলে রে
ঘর-বাড়ী ভালা না আমার ….’
গলির মোড়ের পান দোকান থেকে যখন এক প্যাকেট বেনসন লাইট কিনছিলাম ঠিক তখনই রেডীও থেকে গানটা ভেসে আমার কানে এলো। সময় তখন সকাল আটটা। রাস্তায় ভদ্রলোকদের মাঝে অফিস যাওয়ার ভয়াবহ তাড়াহুড়া। সবার মধ্যেই ‘ওই ফুল ফোটে বনে, যাই মধু আহরণে, দাঁড়াবার সময় তো নাই’ ভাব!
আমিই একমাত্র লোক যার কোন তাড়াহুড়া নেই। হাতে অফুরন্ত সময় আছে, এমন ভাব করে নতুন প্যাকেট ভেঙ্গে আগাগোড়া সাদা একটা সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে টানতে লাগলাম, আর নির্বিকার ভাবে বড় রাস্তার গাড়ী আসা যাওয়া দেখতে লাগলাম। প্রতিটা ধূমপায়ীই জানেন ইনটেক প্যাকেট ভেঙ্গে সিগারেট ধরাতে যে মজা বা আনন্দ তাকে আর কোন আনন্দের সাথে তুলনা করা চলে না। যাকে বলে একেবারে মধু!
আয়েশ করে মাত্র সিগারেটে একটা টান দিয়েছি, ঠিক তখনই কে যেন আমার মাথার ভিতরে বসে গানটা বেসুরে গেয়ে উঠল। ‘লোকে বলে, বলে রে, ..।’ তখন থেকেই গানটা আমার মাথার মধ্যে আঁটকে পড়া ভ্রমরের মত ঘুরতে লাগল। আমি বাস্তববাদী এবং ঘর-সংসার করা বিষয়ী একজন মানুষ কিছু সময়ের জন্য ‘বাউলা’ হয়ে গেলাম! জীবনের আর একটা অদেখা দিক যেন হঠাৎ করেই আমার সামনে খুলে গেল। ভয়াবহ একধরনের উদাসিনতা ঘিরে ধরল আমাকে। মনে হতে লাগল, ‘সত্যিই তো, সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে বাড়ী বানাব, আর সেই বাড়ী দেখে অন্যেরা ‘আহা-উহু’ করবে, এর কোন মানে হয়?
আমি ঘর ছাড়া মানুষ, এই বেশ ভাল আছি। ঘর-বাড়ী সুন্দর না। কী দরকার সুন্দর করে? সব অহেতুক, একেবারেই অহেতুক! না আছে, না থাক। আমার লাগবে না। আমি এমনিতেই ভাল আছি, বলুক, লোকের যা খুশি বলে বলুক। কুছ পরওয়া নেই। আমি স্বাধীন, মুক্ত বাতাসের মত। আমাকে আটকাবে কে?’
আমি ঘোর লাগা আচ্ছন্নতা নিয়ে বাসায় ফিরলাম। সম্পূর্ণ মূক হয়ে গেছি। ঠোঁট নয়, আমার মন কথা বলছে আজ! সে বড় চঞ্চল হয়ে গেছে! আয়শা দরজা খুলে অবাক হয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার? ফিরে এলে কেন? তোমার না আজ যায়গাটা বাউন্ডারী দিতে যাওয়ার কথা? যাবে না?’
এতগুলা বাস্তব প্রশ্ন আমার আচ্ছন্নতাকে একটু হালকা করে দিল। তবে, হালকাই হল শুধু। কেটে গেল না। আমি আমার স্ত্রীর কাছে রহস্য আরও বাড়িয়ে তুললাম। চল্লিশোর্ধ সুন্দরী স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে গেয়ে উঠলাম, ‘লোকে বলে, বলে রে, ঘর-বাড়ী ভালা না আমার, কী ঘর বানাইমু আমি শুন্যেরও মাঝার, লোকে বলে, বলে রে…’
বাস্তবতার বুদবুদে বাস করা স্ত্রী আমার উপর অত্যন্ত বিরক্ত হলো। ভুরু কুঁচকে বলল, ‘ও আবার কী গান? বাউল হলে নাকি?’ আবার প্রশ্ন। বার বার প্রশ্ন।
আমি দার্শনিকের মত ভাবছি, ‘প্রশ্ন শুনে শুনে এবং তার উত্তর দিয়ে দিয়ে মানুষের জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটে যায়। তাই আজ থেকে আমি কোন প্রশ্নের উত্তর দিব না। আজ থেকে আমি ‘বাউলা’ হয়ে গেলাম। কঠিন ‘বাউলা’। মনে মনে বললাম, ‘তোমরা শুনো, আজ থেকে আমি ‘বাউলা’ হয়ে গেলাম। আমাকে ক্ষমা কর। যাবতীয় বৈষয়িক ব্যাপার থেকে আজ আমি ছুটি নিলাম। হে বৈষয়িকতা, আমাকে ক্ষমা কর, আমাকে পরিত্রান করে দাও এই মায়া থেকে, ভ্রম থেকে। আমি জানি, তুমি মায়া-মোহ আর অন্য সব কিছুর এক মিশ্র অদ্ভুৎ চেহারার যুক্তিপূর্ণ লোভ। হে যুক্তিপূর্ণ লোভ, আমাকে ত্যাগ কর, আমি তোমার যোগ্য নই। আমার এক ছেলে আর এক মেয়ে। এরাই আমার সম্পদ। আমি আলাদা করে আর কোন সম্পত্তি চাই না। আমি এই সম্পদরে মাঝেই বেঁচে থাকতে চাই। সম্পত্তির বোঝা বয়ে বেড়ানো ভারবাহী গাধা হতে চাই না। হে সম্পদ, তুমি আমাকে গ্রহণ কর। হে সম্পত্তি, তুমি আমাকে ত্যাগ কর!’
মাথার মধ্যে অদ্ভুত সব কথা ঘুরতে লাগল। আমি একে নিয়ন্ত্রন করতে পারছি না। হাসন রাজা আমাকে তার একটা অদ্ভুত সুন্দর গানের বিনিময়ে কিনে নিলেন। ‘হে মহান হাসন রাজা, আমি আপনার গানের হয়ে গেলাম। আমাকে গ্রহন করুন।’
আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম অদ্ভুত সব কথারা দল বেঁধে আমার মস্তিস্কে হানা দিতে শুরু করেছে। আমি এখন কী করব? ভেসে যেতে লাগলাম, গানের প্রতিটা কথায়, প্রতিটা অক্ষরের প্রতিটা ফাঁক-ফোকরে মিশে যেতে লাগলাম। ঠিক যেভাবে সাদা নিলচে ধোঁয়া বাতাসে মিশে যায়। এ এক অদ্ভুৎ মিশে যাওয়া! লয় নেই, ক্ষয় নেই, শুধুই ভেসে ভেসে মিশে যাওয়া। ‘হে মহান হাসন রাজা, আমি আমার যাবতীয় সম্মান আপনার প্রতি অর্পণ করলাম। আপনি গ্রহণ করে কৃতজ্ঞ করুন সামান্য এই আমাকে। আপনার মহান গানে মিশে যেতে দিন।’ মুখে কিছুই না টলোমলো চোখ নিয়ে আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার হাভভাবে ও মনে হয় একটু ভয় পেয়ে গেছে। আমার বুকে ভালবাসাপূর্ণ একটা হাত পরম আদরে রেখে চিন্তিত সুরে বলল, ‘ওগো কী হয়েছে তোমার? তুমি এমন করছো কেন? শরীর খারাপ করছে? একটু শুয়ে দেখবে নাকি?’
আবার প্রশ্ন! চক্রাকারে প্রশ্নরা বার বার ফিরে আসছে রূপ বদল করে। আমি কোন উত্তর দিলাম না। মোহগ্রস্থের মত ভাবতে লাগলাম, ‘জীবনও কি ঠিক তাই? একই জীবন যেন বার বার করে ফিরে আসছে রুপ বদল করে। কে বলে দেবে? এ কি শুধুই মায়া, ভ্রম নাকি অন্য কিছু? পরদাদা থেকে দাদা, দাদা থেকে বাবা, বাবা থেকে আমি, আমার থেকে আমার সন্তানরা। তারপর আবার একই ধারাবাহিকতা, আবার, তারপর আবার। অদ্ভুৎ এক চক্রাকারে ঘূর্ণায়মান জীবন! যেন আমিই বার বার করে ফেরত আসছি আমার ভিতর দিয়েই। শুধু মঞ্চ আর কুশিলবরা যেন বদলে গেছে কোন এক অদ্ভুৎ বিচিত্র প্রক্রিয়ায়। কেন? কেন?’
পাগলা ক্ষ্যাপার মত নিজেকে ঝাঁকিয়ে আমি প্রশ্ন করছি, ‘কেন? কেন?।’ কে দেবে উত্তর, জানা নেই। মন কাঁদে, নোনা পানিতে ভেঁসে যায় আমার মনের অদৃশ্য চোখজোড়া। গুমরে গুমরে কাঁদে অজানা প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার আকাঙ্খায়। আমি শান্ত স্বরে স্ত্রীকে বললাম, ‘নাহ্, কিছুই হয়নি। শরির-মন দুইই ভাল। আমি ঠিক আছি। তুমি তো জানোই, আমি একটু এমনই। মাঝে মাঝে হেয়ালী আর ভাবের নোনা পানিতে ভেসে যাওয়া এক অসহায় মানুষ। যার আসলে কোন ক্ষমতা নেই। যোগ্যতা নেই। শুধুই বোবা হয়ে সব কিছু দেখা ছাড়া।’ স্ত্রী আমার বুকে মাথা রেখে এ কথায় কেঁদে উঠে বলল, ‘আমি জানি। তারপরও ভয় হয়। তুমি ছাড়া কেউ নেই যে আমার!’
আমি নিরবে ভাবতে লাগলাম। ভাববার মতই বিষয় কী না! সত্যিই তো, এ কেমন কথা! আমি ছাড়া কেউ নেই তার! কী ভীষণ ভয় ধরানো কথা! সংসারে চল্লিশ বছর পার করে ছানা-পুনা তৈরী করে এখন বলে কেউ তার নেই এখানে শুধু এক আমি ছাড়া! এর থেকে অদ্ভুত কথা আর কী হতে পারে? এও কি এক ধরনের মায়া বা ভ্রম? ঠিক যেমন ইট জুড়ে জুড়ে একটা বাড়ী! যাকে ঘিরে তৈরী হয় হাজারো স্বপ্ন আর ভালবাসা। কাঁচা মাটি থেকে ইট, ইট থেকে বাড়ী আবার বাড়ী থেকে কাঁচা মাটি। এক অদ্ভুত চক্রাকার খেলা।’
আমি ভাবতে লাগলাম, ভীষণভাবে ভাবতে লাগলাম। ঘোর লাগা ঘোলা চোখে আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মনে মনে ওকে বললাম, ‘তুমিও আমার সাথে আজ ভাব আর কাঁদতে কাঁদতে দেখো এক অদ্ভুত দৃশ্য
, কাঁচা মাটি থেকে ইট, ইট থেকে বাড়ী। সেই বাড়ী ফের কাঁচা মাটি, আবার ইট, ফের ইট থেকে…