তারেকুল ইসলাম ::
এই মূহূর্তে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রশক্তির বিপরীতে সবচে ডমিন্যান্ট বা শক্তিশালী ভূমিকায় রয়েছে কওমি আলেম-ওলামা তথা ইসলামপন্থীরা। এরপর রয়েছে কোণঠাসা ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী শক্তি। কিন্তু গণ-আন্দোলনমুখী তৎপরতায় ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থী—উভয় পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা ও সন্ধি না হওয়ার ফলে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের অনেক সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। খেয়াল করুন, তাদের উভয়ের লড়াইয়ের ঐক্যের জায়গাটা শুধুমাত্র হাসিনা-রেজিমের বিরুদ্ধেই না, একইসাথে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধেও বটে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথেষ্ট স্মার্ট যে, তিনি এই ঐক্যের জায়গাটা খুব ভালোই বুঝতে পেরেছেন। আর সেজন্যই হেফাজতের সাম্প্রতিক দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে, কওমি স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়ে এবং আলেম-ওলামাবান্ধব হওয়ার চেষ্টা করে তিনি কৌশলে সেই ঐক্যে ফাটল ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করতে ইতোমধ্যে সক্ষম হয়েছেন। তাই, এইমূহূর্তে ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী শক্তির উচিত সাম্প্রতিক দূরত্ব মোচন করে ইসলামপন্থীদের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতা ও সন্ধি করা (ASAP); অন্যথায় এদেশে ফ্যাসিবাদ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের অগ্রযাত্রা কোনো পক্ষই একা রুখতে পারবে না।
বাংলাদেশে বর্তমান পরিস্থিতিতে এবং তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক রাজনীতিতে নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনা দেখি একমাত্র দেওবন্দী ধারার কওমি সম্প্রদায়ের মধ্যেই। প্রশ্ন করতে পারেন কেন আমি কওমি সম্প্রদায়কেই এক্ষেত্রে একমাত্র সম্ভাবনা ধরে নিচ্ছি। তার একটাই কারণ, ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগতভাবে দেওবন্দী কওমিরা দখলদার ঔপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামী। এখন পর্যন্ত তাদের এই অবস্থান লক্ষণীয়ভাবে বজায় রয়েছে। এমনকি তাদের ঈমান-আকিদার শেকড়প্রাণ চেতনার দরুন নব্য সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশবাদের গোলাম এই জালিম রাষ্ট্রের দাসত্বও তারা মেনে নেয়নি। এর স্বীকৃতির পরোয়াও তারা করে না। তবে হেফাজত, ইসলামী আন্দোলন, জমিয়ত, খেলাফত মজলিস—এই দলগুলোকে প্রতিপক্ষ ও সহায়ক পক্ষগুলোর সাথে রাজনৈতিক দরকষাকষি ও কৌশল গ্রহণের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নাই।
আমি বিশ্বাস করি, সাম্প্রতিককালে আলোচিত কওমি শিক্ষা সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ফয়সালাও হবে নেতিবাচক। তেল আর জলের মধ্যে কখনোই সন্ধি হয়না। ঈমান আকিদা ও হকপন্থীদের সাথে এই জালিম লুটপাটকারী পুঁজিবাদী ইসলামবিরোধী রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্মাণ—একটি অলীক কল্পনা মাত্র! এখন যা ঘটছে, তা পরিস্থিতির প্রভাবে হচ্ছে। অর্থাৎ এই জালিম ভঙ্গুর রাষ্ট্রের মেরুদণ্ডহীন বেহায়া ভূমিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াস্বরূপ এইসব অস্বাভাবিক ইস্যুগুলো তৈরি হচ্ছে মাত্র। আদতে এসব সাময়িক। এসবের কোনো সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যত নেই। ফ্যাসিস্ট শক্তির পতন ঘটলেই গণেশ উল্টে যাবে, ইনশাআল্লাহ। বাংলাদেশে আগামী দিনের রাজনীতি একাট্টা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে এদেশের ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থীদের দ্বারা—তাদের যৌথ সমঝোতামূলক ঐক্যবদ্ধ তৎপরতার গুণে। এতে অন্তত আমার কোনো সন্দেহ নাই। তবে উভয় পক্ষকে অবশ্যই জনগণের ব্যাপারে এবং আন্দোলনমুখী রাজনৈতিক তৎপরতায় আরো প্রতিশ্রুতিশীল ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
তাছাড়া বাংলাদেশের আর সব রাজনৈতিক ও আদর্শিক মতপন্থীরা অন্তত ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বা বাস্তব ভূমিকায় কোনো-না-কোনোভাবে কলোনিয়াল লিগ্যাসির বাহক। এমনকি এটাও আজ স্পষ্ট দৃশ্যমান যে, এদেশের বিদ্যমান কমিউনিস্ট প্রগতির বরকন্দাজরাও সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ ও ব্রাহ্মণ্যবাদের খুল্লাম খুল্লা দালালি করছে। তারা দিল্লির সাউথব্লক ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হুকুমবরদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ। এই কলোনিয়াল স্লেভারি মানসিকতার কারণেই তাদের সমূহ সম্ভাবনা বিশ বাঁও জলে পতিত হয়েছে। একইসাথে এরা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
যাই হোক, যা বলছিলাম, একটি নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনা পরিণতি পাবে—যদি কওমি ঘরানার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও দলগুলো জনগণের উদ্দেশে তাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনা ও জনকল্যাণমূলক ভাবনাচিন্তাগুলো জাতীয়ভাবে নতুন ভাষা ও বয়ানে উপস্থাপন করতে পারে। একইসাথে ডানপন্থী জাতীয়তাবাদীদের উচিত প্রভাবশালী কওমি ইসলামপন্থীদের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতা ও সন্ধির প্রক্রিয়া সেরে ফেলা। বোঝাপড়ার জায়গায় এখনই উভয়পক্ষ মিটমাট করে নিলে আন্দোলনমুখী রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণে তাদের সুবিধাই হবে বৈকি! এই রাজনৈতিক কর্মপন্থা মূলত বিদ্যমান ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রোডম্যাপ। এই আন্দোলনের রোডম্যাপ বাস্তবায়নে জনগণই তাদের একমাত্র ট্রোজান হর্স। তাই, তাদের প্রধান করণীয় হলো, যতটা সম্ভব গণমুখী রাজনৈতিক চরিত্রে প্রত্যাবর্তন করা।