বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১০:৫৩
Home / আকাবির-আসলাফ / আলোর দিশারী : মাওলানা জমশেদ আলী

আলোর দিশারী : মাওলানা জমশেদ আলী

আসলাফ আকাবির (২)

Jomshed Ali Komashisha

শামসীর হারুনুর রশীদ ::

মাওলানা জমশেদ আলী যদি শহরে বা ঢাকায় থাকতেন, যেভাবে জ্ঞানতাপসরা শেষ সম্বল হিসেবে শহরে বিশেষ করে ঢাকাকে বেছে নেন। তাহলে যোগ্য কলমের খোচায় ইতিহাসের পাতায় তিনি জাতির এক দূর্লভ কান্ডারী হিসেবে স্থান করে নিতেন। যা হোক মাওলানার সাথে প্রথম কবে দেখা হয়েছে তা জানা না থাকলেও সর্বশেষ দেখা হয়েছে মাঘের আগে, ২০০৪ সালে শীতের পড়ন্ত এক বিকালে। মাওলানা তখন অসুস্থ। আসলে রোগ-ব্যাধি মাওলানার নিত্যসঙ্গী। সেই যে যৌবনের প্রারম্ভে জীবন ও মৃত্যুর, আলো ও আঁধারের দ্বৈরথ যুদ্ধে, জীবন প্রত্যাশী সামাজিক এ মানুষটি আঁধারের ভ্রুকুটি ছিন্ন করে ফিরে এসেছিলেন আলোর উজ্জ্বল বৃত্তে, তখন থেকেই অসুস্থতা কখনো পিছু ছাড়েনি তাঁর। এক অনুগত ভৃত্যের মত ছায়াসঙ্গী হয়েই লেগে ছিল অনুক্ষণ। এই নিরন্তর দ্বৈরথে কখনো সূচিত হয় জীবনের অবাধ জয়যাত্রা, আবার কখনো বা জীবনের ওপর ঘটে আঁধারের বিষন্ন ছায়াপাত।
মাওলানা জমশেদ আলী ছিলেন একজন সৃজনশীল হৃদয়ের সাদামাটা মানুষ। তার মননশীল চেতনায় সমকালীন সমাজ, পরিবেশ, প্রকৃতি, জীবনাচরণ, মূল্যবোধ জাগ্রত ছিল। সংশয়, দ্বন্ধ, বিশ্বাস, অবিশ্বাস অন্তরের মানবিকতাকে তাড়না দিত। বিপন্ন মনুষ্যত্ব তার মনোজগতে তীব্র আঘাত হানতো। কামনা-বাসনা, সদিচ্ছা হয়ে যেত বিব্রত। ঔচিত্যবোধ হয়ে যেত বেদনায় ভারাক্রান্ত। ফলে আবহমান জীবনে কষ্ট ক্লেশের মাধ্যমে মানুষ ও সমাজ সম্পর্কে তিনি তিক্ত ও মিষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। এজন্য তার মাঝে ছিল বৈচিত্রময় দানেশমন্দি। মাওলানা সাহেবের বাড়ি ও আমার বাড়ি একই গ্রামে হওয়ায় যখন থেকে মসজিদে যাওয়া শিখেছি, লালারচক জামে মসজিদের মিম্বরে জুমআর পূর্বে বেশিরভাগ সময়ে তাকে ওয়াজ করতে দেখেছি। এখনের মত চিৎকার সুরেলা ওয়াজ ও আজগুবি কেচ্ছা কাহিনী ছিলনা তার ওয়াজের উপজীব্য বিষয়। যে কারণে দেশের বিজ্ঞ আলেমরা ওয়াজ মাহফিল এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেন কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। তার ওয়াজে কন্ঠ ছিল ভরাট, ধীর স্থির কথা, কখনো আঞ্চলিক আবার কখনো শুদ্ধ ভাষা, দার্শনিক ব্যাখ্যা, চিন্তাশীল দৃষ্টিভঙ্গি, মমত্বপূর্ণ আহ্বান। সাধারণ মানুষ এতে খুব মজা পেত। শিক্ষিত সমাজ ও ওলামায়ে কেরামকে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁর বক্তব্য শুনতে দেখেছি। মাওলানা জমশেদ আলী ছিলেন আসলেই জ্ঞানতাপস ব্যক্তি। তিনি সত্য-মিথ্যা, ভাল-মন্দ সম্পর্কে খুব সতর্ক থাকতেন বিধায় তার অভিমত ও চিন্তাগুলো ছিল নিবিড় ভারসাম্যপূর্ণ। কাজগুলো ছিল সঠিক অনুধাবনের ওপর নির্ভরশীল। তার বক্তব্য ছিল বিষয়ভিত্তিক, পান্ডিত্যপূর্ণ, কুরআন-হাদীসের দলীল ও যৌক্তিক ব্যাখ্যায় উদ্ভাসিত। তিনি অত্যন্ত উঁচু মার্গের কথা বলতেন। তাঁর বক্তব্য থেকে তার পান্ডিত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটতো। আমি সুযোগ পেলেই তার কাছে যেতাম। নানা বিষয়ে আলাপ করতেন আমাদের সাথে। তিনি পঞ্চায়িতি বিচার ব্যবস্থায় সত্য ও ন্যায়ের মূর্ত প্রতিক ছিলেন। মোটকথা তিনি আমার দেখা এক পণ্ডিত আলেমে দ্বীন। আলোর দিশারী। জাতির কাণ্ডারী।

জন্ম:

মাওলানা জমশেদ আলী জন্মেছিলেন ১৯১৬ সালে বৃটিশ ভারতে। কানাইঘাট উপজেলার একেবারে পশ্চিম প্রান্তে গোলাপগঞ্জের নিকটস্থ রাজাগঞ্জ ইউনিয়নের সুরমা তীরের লালারচক নামক নিভৃত পল্লিতে। এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তার পিতার নাম হাজী আব্দুল কাদির প্রপিতার নাম হাজী তোরাব আলী।
শিক্ষাজীবন: জ্ঞানের ভারে ন্যুজ¦ ছিলেন মাওলানা জমশেদ আলী। খুবই পড়–য়া ছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছেন। নিজের জানার- ক্ষুধার প্রয়োজন মেটাতে তাকে সব ধরনের জ্ঞান-ভান্ডারের অন্বেষণ করতে হয়েছে। তার সাথে আলাপচারিতায় জ্ঞানের গভীরতা উপলব্ধি করা যেত। মাওলানার জ্ঞানের আনুষ্ঠানিক দৌড়টা শুরু হয়েছে নিজ গ্রামের উত্তরবাড়ী সংলগ্ন হাফিজী মাদরাসা থেকে।
গ্রামের পাঠশালায় কিছুদিন লেখাপড়া করে ৯ বছর বয়সে মাতা-পিতার কাঙ্খিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে এবং জ্ঞান পিপাসা মিটাতে গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাঘা ইউনিয়নস্থ নানাবাড়ীতে চলে যান। সেখানে গৌরবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। নানাবাড়ি থেকেই লেখাপড়া করে পঞ্চম শ্রেণিতে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে বৃত্তিলাভ করেন। আনন্দের সীমা নেই যেন তার শিক্ষাগুরু ভারত বাবুর। তিনি নিজেই কলকাতা থেকে মাওলানার বৃত্তি আনেন। তখনের বৃত্তি কলকাতা থেকে লাভ করতে হতো।
মাওলানা জমশেদ রাহ.’র মেধা খুবই ভাল থাকায় প্রাইমারির শিক্ষকরা তাকে সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। সেখানেও কৃতিত্বের সাথে ষষ্ট ও সপ্তম শ্রেণীতে লেখাপড়া করেন। সম্ভবত দারিদ্রতার কারণেই পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে চলে আসেন এবং গোলাপগঞ্জের ফুলবাড়ি আজিরিয়া ফাযিল মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানের শিক্ষায়ও তেমন তৃপ্ত হতে পারছিলেন না বিধায় প্রখ্যাত আলেম মাওলানা তাহির আলী তহিপুরী রাহ.’র কাছে প্রাইভেটবাবে আরবী গ্রামার, হেদায়াতুননাহু, কাফিয়া ইত্যাদি পড়তেন। ফুলবাড়ি মাদরাসায় এক বছর পূর্ণ করে নিজ উপজেলার সর্বপ্রাচিন শিক্ষা প্রতিষ্টান ঝিঙ্গাবাড়ী ফাযিল মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে দাখিল ও আলিম শ্রেণী অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। ঐ সময় থেকেই পড়া শুনার সাথে সাথে তার চিন্তা-গবেষণার মেজাজটা ধরা পড়ে। তখন তাকে অত্যন্ত ভাবগম্ভীর দেখা যেত বলে কথিত আছে।
ঝিঙ্গাবাড়ী মাদরাসায় সর্বোচ্চ ক্লাস আলিম সমাপ্ত করে উচ্চতর দ্বীনি শিক্ষা অর্জনের জন্য ইলমুল ওহীর প্রাণকেন্দ্র জগদ্বিখ্যাত ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় দারুল উলূম দেওবন্দে পাড়ি জমান। দারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তি হয়ে ফযিলত ও হাদীসের ক্লাসগুলো সমাপ্ত করেন। অতঃপর হাদীস, তাফসীরসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাখাসসুস বা অনার্স-এ কিছুদিন লেখাপড়া করেন।

আধ্যাত্মিক জীবন:

মাওলানা জমশেদ আলী দারুল উলূম দেওবন্দে ছাত্র থাকাকালিন অবস্থায় আধ্যাত্মিক স¤্রাট, শায়খুল ইসলাম স্বীয় উস্তাদ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.’র কাছে বাইআত হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও ছাত্রত্ব তাতে বাধ সাধে। বাহ্যিক জ্ঞানার্জনে অন্তরায় হতে পারে বলে মাদানী তার বাইআত নাকচ করেন। অতঃপর দেওবন্দ থেকে চলে আসেন। কিন্তু যে করেই হোক তাকে আধ্যাত্মিকতার স্বাধ গ্রহণ করতে হবে। সুতরাং পীরে কামিল হযরত মাদানীর সুযোগ্য খলিফা শায়েখ আব্দুল গফফার মামরখানীর হাতে বাইআত গ্রহণ করেন। স্বীয় মুর্শিদের সান্নিধ্যে থেকে কঠোর পরিশ্রম ও মুজাহাদার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির স্তরসমূহ অতিক্রম করে স্বল্প সময়েই খেলাফত লাভে ধন্য হন।

কর্মজীবন:

মাওলানা জমশেদ আলী দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে দেশে ফেরার সাথে সাথে প্রস্তাব আসে স্বীয় গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ইমদাদুল উলূম লালারচক মাদরাসার পরিচালকের পদ গ্রহণ করার। তিনি তার সহপাঠী ও সিনিয়র আলেমদের সাথে ব্যাপারটি নিয়ে পরামর্শ করেন, তারাও তাকে মুহতামিম হয়ে মাদরাসার খেদমত করার অনুরোধ করেন। অবশেষে প্রয়াত মাওলানা ফজলে হক্ব পাত্রমাটী রাহ.’র প্রতিষ্ঠিত ইমদাদুল উলূম লালারচক মাদরাসার মুহতামিম পদে নিযুক্ত হয়ে পরিচালনার সাথে সাথে শিক্ষকতা শুরু করেন। এক নাগাড়ে ক’টি বছর মাদরাসা পরিচালনা ও শিক্ষকতা সুনিপুণ দক্ষতার সাথে আঞ্জাম দেয়ায় সময়কালিন বড় মাপের আলেমদের নজর কাড়তে সক্ষম হন। ধীরে ধীরে তার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে আযাদ দ্বীনি এদারা বৃহত্তর সিলেট বোর্ড-এর জেনারেল সেক্রেটারীর পদে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় তাকে নির্বাচিত করা হয়। আমৃত্যু তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। এদারা বোর্ডে দীর্ঘদিন অডিটর হিসেবেও যথেষ্ট সুনামের সাথে কাজ করে গেছেন। বিরল প্রতিভার অধিকারী এ মানুষটি তার শিক্ষকতার জীবনে অনেক জ্ঞানী গুণী তৈরি করে গেছেন, যাদের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ।
কর্মতৎপরতা, সাধনা, বোর্ডের দায়িত্ব পালনে কি পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তার একটি ঘটনা উল্লেখ করলেই পাঠক মহল তাকে জান্তে ও অনুভব করতে পারবেন।
গত ২০১২ সালে আযাদ দ্বীনি এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশ বোর্ড কর্তৃক ৩০ সালা দস্তারবন্দী উপলক্ষে যে স্মারক বের হয়, তার প্রাথমিক কিছু কাজে হযরত মাওলানা মুখলিসুর রহমান রাজাগঞ্জীর সাথে আমিও অংশগ্রহণ করেছিলাম। বোর্ড সংশ্লিষ্ট কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে ধারাবাহিক ক’টি রাত বিভিন্ন জায়গায় উনার সাথে সফর করতে হয়েছে। সম্মেলনের মাসখানেক আগে, বৃটিশ ভারতে সিলেটের দরগা সংলগ্ন শাহজালাল প্রেসের মালিক জিন্দাবাজারের আলহাজ¦ তারু মিয়া সাহেবের বাড়িতে গেলাম। রাত তখন প্রায় দশটা বাজে। তখন এদারা বোর্ডের বই-পুস্তকসহ যাবতীয় ছাপার কাজ তার প্রেসেই ছাপা হত। তখন তিনিই একমাত্র সিলেটে প্রেসের মালিক। পরে অবশ্য জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম কর্তৃক হাওয়াপাড়া মসজিদ সংলগ্ন অপর আরেকটি প্রেস আসে।
সালাম-মোসাফাহার পর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আপনার বাড়ি? আমি বললাম, লালারচক। তিনি হতবাক হয়ে বললেন, কোন লালারচক? আমি বললাম, রাজাগঞ্জ-লালরচক। বয়োবৃদ্ধ তারু মিয়া সাহেব সোফা থেকে লাফ দিয়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, মাওলানা জমশেদ আলী লালারচকীর কারণে লালারচক গ্রামটিকেই আমি অন্তর দিয়ে ভালবাসি। তিনি তার ঘরের বারিন্দা ও পরিত্যক্ত একটি ঘর এখন অবশ্য তা এ অবস্থায় নয় দেখিয়ে বললেন, এখানে বস্তা আর চট বিছিয়ে এদারার কাজ করতেন, রাত কাটাতেন মাওলানা জমশেদ আলী এবং জমিয়তের নেতারা তো আছেনই।
তখনকার আলেমদের দ্বীনের কাজে সিলেট আসলে রাত্রি যাপনের কষ্টের কথা উল্লেখ করে তারু মিয়া সাহেবের অশ্রু চলে আসে। আমরাও খুব বিচলিত হই। কিছু সময় পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন, এদারা বোর্ড সম্পর্কে তার জানা ইতিহাস বলতে শুরু করেন। আমরা আন্দাজ করতেই পারিনি তিনি এদারাবোর্ড ও জমিয়তের ইতিহাস সম্পর্কে এত ওয়াকিফহাল। তিনি বারবার মাওলানা জমশেদ আলী রাহ.’র কথা উল্লেখ করে আমাকে রীতিমত ভাবিয়ে তুলেন। অতঃপর চা-নাস্তা সেরে চলে আসি। প্রিয় পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন মাওলানার দায়িত্ব আঞ্জামের ব্যাপারটি। জ্ঞানতাপস এ মনীষা পুরো দেশেই শিক্ষা সফর করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, আমি যখন ভূগোল বইটি লেখা শুরু করি তখন পায়ে হেটেও দেশের কত জায়গায় যেতে হয়েছে তার কোন ইয়েত্তা নেই। এরপর থেকেই রোগ-ব্যাধি তার পিছু ছাড়েনি। উল্লেখ্য [মাওলানা জমশেদ আলী] বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের প্রথম কোন পন্ডিত আলেম, যিনি ভূগোলের মত কঠিন বই সর্বপ্রথম লিখেছেন- আবার তা ৩ খন্ডে। যা তখনকার কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড আযাদ দ্বীনি এদারা ও বেফাক বোর্ডের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর সিলেবাসভ’ুক্ত ছিল। জটিল রোগে আক্রান্ত না হলে হয়ত তার কাছ থেকে আরো লিখনি আমরা পেতাম। আল্লাহ তাকে নি’মাল বদল দান করুন।

রাজনৈতিক জীবন:

মাওলানা জমশেদ আলী ছিলেন, শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.’র একজন প্রিয় শিষ্য। হযরত মাদানী ছিলেন ১৯৪৭ পূর্ববর্তী ভারতের রাজনীতিতে অখন্ড ভারতের পক্ষপাতী এবং বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের অগ্রসৈনিক। মাদানীর অনুসারী মাওলানা জমশেদ আলীও এই চিন্তাধারার আলোকে গড়ে উঠেছিলেন। ছিলেন সবক’টি আন্দোলনে সরগরম। শুধু আন্দোলন নয় তিনি নির্বাচনও করেছেন। ১৯৫৭ সালে রাজাগঞ্জ ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন। পাঁচ বছর সফলতার সাথে জনগণের সেবা করেন। অত:পর ১৯৬২ সালের নির্বাচনে রাজাগঞ্জ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে দোয়াত-কলম মার্কায় প্রতিদ্বন্ধিতা করে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। জনকল্যাণে কতটুকু দায়িত্বশীল ছিলেন-লোকমুখে এখনো শুনা যায় যে, তিনি চেয়ারম্যান থাকাবস্তায় প্রতিদিন সকালে মানুষের দুঃখ দুর্দশার খবর রাখতে ইউনিয়নের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পায়ে হেটে ঘুরতেন। কারো কোন প্রয়োজন থাকলে যথাসাধ্য মেটাবার চেষ্টা করতেন। রাস্তা-ঘাট, কালভার্ট ইত্যাদি সেবামূলক কাজে তার পদচারণা খুবই বিস্তৃত। তাই তিনি আপন স্মৃতিতে এখনো অম্লান।

বৈবাহিক জীবন:

আত্মাকে পূত-পবিত্র রাখার অন্যতম মাধ্যম হল বিয়ে। জীবনের পরিপূর্ণতার এক সিড়ি বিয়ে। ইসলামের শাশ^ত বিধান বিয়ে। নবী জীবনের সুন্নতও এই বিয়ে। আত্মসংযম, চরিত্রগঠন ও সত্য সুন্দরকে স্বাগত জানাতেই বিয়ের পীড়িতেও বসেছিলেন মাওলানা জমশেদ আলী। তিনি চাঁরটি বিবাহ করেছেন। প্রথম স্ত্রী মোছাম্মত মফুরা বেগম। দ্বিতীয় স্ত্রী মোছাম্মত নেছা বেগম। তৃতীয় স্ত্রী মোছাম্মত আনওয়ারা বেগম। চতুর্থ স্ত্রী মোছাম্মত আমিনা বেগম।

সন্তানাদি:

প্রথম স্ত্রীর উদর থেকে মাওলানা আহমদ হুসেন আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্ত্রী থেকে কোন সন্তান নেই। তবে চতুর্থ স্ত্রীর উদর থেকে দুই ছেলে মাওলানা ওলিউর রহমান ও ক্বারী হারুনুর রশীদ, দুই মেয়ে- মোছাম্মত মরিয়ম বেগম ও হালিমা বেগম। মাওলানার দুই স্ত্রী ও সন্তানাদীর সকলেই জীবিত আছেন। আল্লাহ তাদের হায়াতে তায়্যিবাহ দান করুন।
লালারচক মহিলা মাদরাসা: মাওলানা জমশেদ আলীর হাদীস পড়ানোর প্রতি আগ্রহের কথাটি জীবনে বারবার বলেছেন। কিন্তু বৃহত্তর সিলেট রাণাপিং কেন্দ্রীক এদারা বোর্ড, লালারচক মাদরাসা ছাড়াও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দায়িত্বের বুঝা হাদীস পড়ানোর ক্ষেত্রে তার জন্য ছিল বড় অন্তরায়। তবে জীবনের শেষভাগে লালারচক মহিলা মাদরাসা দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত পৃথক শাখা খোলে হাদীস পড়ানোর আগ্রহ কিছুটা হলেও প্রশমিত করেছেন। তার পরলোকগমনের পর লালারচক মাদরাসার দায়িত্বে মাওলানা আবুল হাসান সাহেব মনোনীত হলে এলাকার মুরব্বীয়ান ও পরিচালনা কমিটি মাদরাসায় মহিলা ক্যাম্পাস খোলে মহিলা শাখাটি স্থানান্তর করেন। খুবই দূরদর্শিতা ও সুনামের সাথে পরিচালিত হয়ে আসছে আজো।

পরলোক গমন:

পশ্চিম কানাইঘাটের এ উজ্জল নক্ষত্র ৩০ জানুয়ারি, ২০০৫ ইংরেজি, ১৭ই মাঘ ১৭১৯ বাংলা, মোতাবেক ১৮ই জিলহজ¦ ১৪২৫ হিজরী, রবিবার ভোর রাতে নশ^র এ জগতের বন্ধন ছিন্ন করে পরলোক গমন করেন। বড় ছেলে মাওলানা আহমদ হুসেনের ইমামতিতে নিজ বাড়ি সংলগ্ন খোলা আকাশের নীচে হাজার হাজার ভক্ত অনুরাগী জানাযায় অংশগ্রহণ করেন।। লালারচক মাদরাসা ও জামে মসজিদ সংলগ্ন পশ্চিম পাশের গোরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। আল্লাহ তাকে জান্নাতের উচু মর্যাদা দান করুন। আমীন ॥

লেখক: মুহাদ্দিস ও প্রাবন্ধিক

E-mail: shamsherharunrahsid@yahoo.com

আরও পড়ুন :

আকাবির আসলাফ-১, শায়খুল হাদীস আল্লামা ইসহাক রাহ.

আকাবির আসলাফ-২, আলোর দিশারী : মাওলানা জমশেদ আলী

আকাবির আসলাফ-৩, আরিফ বিল্লাহ মাওলানা আকবর আলী রাহ.

আকাবির আসলাফ-৪, হযরত মাওলানা কুতুবুদ্দীন রহ.

আকাবির আসলাফ-৫,  শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযাম রহ.

আকাবির আসলাফ-৬, আল্লামা আশরাফ আলী বিশ্বনাথী রাহ.

আকাবির আসলাফ-৭, মাওলানা আব্দুল করীম শায়খে কৌড়িয়া রাহ.

About Abul Kalam Azad

এটাও পড়তে পারেন

বেফাকের দ্বিতীয় সভাপতি আল্লামা হারুন ইসলামাবাদী রহ.-এর বর্ণিল জীবন

কমাশিসা ডেস্ক:: আল্লামা মুহাম্মদ হারুন ইসলামাবাদী রহ.। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ- এর দ্বিতীয় সভাপতি। বাংলাদেশে ...