মুহাম্মাদ ফায়সাল::
হজরত মুয়াবিয়া (রা.) ৬০৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছেন। রাসুল (সা.)-এর হিজরতের সময় তাঁর বয়স ছিল ১৮ বছর।
তাঁর বংশ পঞ্চম পুরুষে এসে রাসুল (সা.)-এর বংশের সঙ্গে মিলে যায়। তিনি উম্মুল মুমিনীন উম্মে হাবিবা (রা.)-এর সহোদর ভাই ছিলেন। তিনি মক্কা বিজয়ের সময় রাসুল (সা.)- এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে ইসলাম প্রকাশ করলেও মূলত হিজরতের আগেই তিনি গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ জন্যই তিনি বদর, ওহুদ, খন্দকসহ কোনো যুদ্ধেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসেননি- (উস্দুল গাবাহ ৫/২১০)। মুয়াবিয়া (রা.) আল্লাহপ্রদত্ত অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। রাসুল (সা.)-এর কাছে তিনি এতই নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন যে তিনি তাঁকে ওহি লেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ফকিহ সাহাবিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। রাসুল (সা.) থেকে তাঁর সূত্রে ১৬৩টি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সর্বপ্রথম তিনিই ইসলামের ইতিহাস রচনা করেছেন।
রাসুল (সা.)-এর দৃষ্টিতে হজরত মুয়াবিয়া (রা.)
হজরত উম্মে হারাম (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, আমার উম্মতের সর্বপ্রথম সামুদ্রিক অভিযানে অংশগ্রহণকারী বাহিনীর জন্য জান্নাত অবধারিত’- (সহিহ বোখারি, হা. ২৯২৪) ।
এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাল্লাব (রহ.) বলেন, ‘হাদিসটিতে হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। কেননা হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-ই ছিলেন ওই বাহিনীর সিপাহসালার’- (ফাতহুল বারী : ৬/১০২)।
হজরত আবদুর রহমান ইবনে আবি উমায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) মুয়াবিয়ার জন্য এ দোয়া করেছিলেন, হে আল্লাহ! মুয়াবিয়াকে সঠিক পথে পরিচালনা করুন ও তাঁকে পথপ্রদর্শক হিসেবে কবুল করুন’- (তিরমিজি, হা. ৩৮৪২) ।
একবার মুয়াবিয়া (রা.) রাসুল (সা.)-এর অজুতে পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন, তখন রাসুল (সা.) তাঁকে বললেন, ‘হে মুয়াবিয়া, যদি তোমাকে আমির নিযুক্ত করা হয়, তাহলে আল্লাহকে ভয় করবে এবং ইনসাফ করবে। ‘ মুয়াবিয়া (রা.) বলেন, ‘সেদিন থেকেই আমার বিশ্বাস জন্মেছিল যে, এ কঠিন দায়িত্ব আমার ওপর এসে পড়বে’- (মুসনাদে আহমাদ হা. ১৬৯৩৩)।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, একদিন জিবরাঈল (আ.) রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ‘হে মুহাম্মদ (সা.), মুয়াবিয়াকে সদুপদেশ দিন, কেননা সে আল্লাহর কিতাবের আমানতদার ও উত্তম আমানতদার’- (আল মুজামুল আওসাত, হা. ৩৯০২) ।
খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন
অসাধারণ নৈপুণ্যের কারণে হজরত ওমর (রা.) তাঁর খেলাফতকালে তাঁকে দামেস্কের আমির নিযুক্ত করেছিলেন। হজরত ওসমান (রা.) তাঁকে পুরো শামের (সিরিয়ার) আমির নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁদের খেলাফতকালে মুয়াবিয়া (রা.) ইসলামের বহু যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে অনেক দেশ জয় করেছিলেন।
খেলাফত আমলের কীর্তি
হজরত মুয়াবিয়া (রা.) চরম সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সব ফিতনা দমন করে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনেন। পরিস্থিতি এমন হয় যে, মহিলারা রাতে তাদের ঘরের দরজা খুলে ঘুমাতেও ভয় করত না, কোনো ব্যক্তি পথে পড়ে থাকা কারো জিনিস ছুঁয়ে দেখার সাহস পেত না। তাঁর শাসনামলে সারা পৃথিবীতে কোনো মুসলমান ভিক্ষুক ছিল না। রাজ্যের অমুসলিম নাগরিকদেরও শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম যোগাযোগের জন্য ডাক বিভাগ চালু করেন এবং সরকারি দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষণের জন্য পৃথক বিভাগ চালু করেন। তিনি মুসলিম বাহিনীকে সুশৃঙ্খল রূপ দেন ও ইসলামের দাওয়াত বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যও বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন- (তারিখে ত্বাবারি, মু’জামুল বুলদান ৪/৩২৩, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৩/১৫৭)। পর্তুগাল থেকে চীন পর্যন্ত এবং আফ্রিকা থেকে ইউরোপ পর্যন্ত ৬৫ লাখ বর্গমাইল বিস্তৃত অঞ্চল তাঁর শাসনামলে ইসলামের পতাকাতলে চলে আসে। তিনি দীর্ঘ ২৫ বছর খেলাফতের গুরুদায়িত্ব পালন করেন ।