কমাশিসা ডেস্ক: সুন্দরগঞ্জে গাইবান্ধা-১ আসনের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের ছোড়া গুলিতে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র শাহাদাত হোসেন সৌরভ (৯) গুরুতর আহত হয়েছে। গতকাল ভোরে সুন্দরগঞ্জ-বামনডাঙ্গা সড়কে এ ঘটনা ঘটে। বর্তমানে ওই শিশু রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। সৌরভের বাবা সাজু মিয়া গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ বামনডাঙ্গার গোপালচরণ গ্রামের হাঁড়ি-পাতিল ব্যবসায়ী। তিনি জানান, প্রতিদিনের মতো গতকাল সকাল সাড়ে ৫টায় তার ছোট ছেলে সৌরভ ঘুম থেকে উঠে ব্র্যাক মোড় এলাকায় রাস্তায় ব্যায়াম করতে যায়। কিছুক্ষণ পর সাজু মিয়া জানতে পারেন তার ছেলেকে গুলি করা হয়েছে। ঘর থেকে বাইরে এসে শোনেন, গাইবান্ধা-১ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের ছোড়া গুলিতে সৌরভ আহত হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ব্যায়াম করার সময় হঠাৎ করে সৌরভের সামনে এমপির গাড়ি এসে থামে। গাড়ি থেকে নেমে এমপি শিশু সৌরভকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি কয়েকটি গুলি ছুড়লে ৩টি গুলি সৌরভের দু’পায়ে লাগে। এ সময় সে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তার পা থেকে রক্তক্ষরণ হয়। পরে গাড়িতে করে সুন্দরগঞ্জ হাসপাতালে এলাকাবাসী নিয়ে যেতে চাইলে এমপি এবং তার সঙ্গীরা গতিরোধ করে চালকের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হাসপাতালে যেতে বাধা দেয়। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে শিশু সৌরভকে প্রথমে সুন্দরগঞ্জ হাসপাতাল এবং পরে চিকিৎসকের পরামর্শে সেখান থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সৌরভ সাংবাদিকদের ওই ঘটনার বর্ণনা দেয়। সৌরভ বলে, আমি ব্যায়াম করবার লাগছি। এমপি লিটনের গাড়িখ্যান বামনডাঙ্গা থেকে আইসছে। আসিয়ে থামাইল, থামাইয়া আবোলতাবোল কয়, কুত্তার বাচ্চা কয়, কয়া গুলি মারিল। সৌরভ আরও বলে, তিনটা-পাঁচটা (গুলি) মারিয়া, গাড়িখ্যান সোজা আমাদের বাড়ির তেপতির (তিনমাথা) ওডে (ওখানে) গেল। যায়া (গিয়ে) জিনিসটা বাইর করিল… কাক্কুক (চাচাকে) ইশারা করি ডাকায়, কাক্কু আইসছে, বমা (গুলি) ভরবার ধরছে, ডাইবর (ড্রাইভার) কাক্কুক ইশারা করছে, এইদেন করি যাইবার কইছে, কাক্কু পালিয়ে গেইছে, তারপর গাড়িডে সোজা সুন্দরগঞ্জ মুখে গেইছে।
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ডা. বাবলু কুমার সাহা বলেন, শিশু সৌরভ আশঙ্কামুক্ত থাকলেও এখন নিশ্চিত করে তার অবস্থা সম্পর্কে বলা যাচ্ছে না। শনিবার সকালে পায়ে অপারেশন করে গুলি আছে কিনা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তখন বোঝা যাবে শিশুর সার্বিক অবস্থা। খবর পেয়ে গাইবান্ধার পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছুটে আসেন। এ সময় তিনি গুলিবিদ্ধ আত্মীয়-স্বজনদের আশ্বস্ত করে বলেন, আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। তদন্তসাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এমপি’র গুলিতে শিশু আহত হওয়ার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মিডিয়াকর্মী, মানবাধিকার কর্মীসহ সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দরা ছুটে আসেন। ইউনিটি ফর ইউনিভার্স হিউম্যান রাইটস্ অফ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের রংপুর বিভাগীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোজাক্কের হোসেন মঞ্জু, আবদুল্লাহ আল মামুনসহ অন্যান্যরা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, যারা নির্বিচারে অবোধ শিশুর উপর গুলি চালায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এমপি’র গুলিতে শিশু আহত হওয়ার প্রতিবাদে গতকাল সকাল থেকেই স্থানীয়রা সুন্দরগঞ্জ-বামনডাঙ্গা সড়কের ওই স্থানে দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ও রাস্তা অবরোধ করে রাখেন। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে অবস্থানকারীদের সরিয়ে দেয়। খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক আবদুুস সামাদ, পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবদুল হাই মিলটন ও থানা অফিসার ইনচার্জ ভারপ্রাপ্ত জিন্নাত আলী ঘটনাস্থলে আসেন। থানা অফিসার ইনচার্জ (ভারপ্রাপ্ত) জিন্নাত আলী জানান, আহত শিশুটিকে দেখার জন্য পুলিশ সুপার ও এসআই কারিবেল হাসান রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যান। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবদুল হাই মিলটন জানান, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে বামনডাঙ্গার পূর্ব পার্শ্বে নতুন পেট্রোল পাম্প স্টেশনের কাছে শিশুটিকে বহনকারী গাড়ি এমপি’র লোকজন কর্তৃক আটক করার কথা শুনে তিনি ঐ স্থানে যান। তবে কিভাবে শিশুর পায়ে গুলি লেগেছে এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু জানাতে পারেননি তিনি। থানা অফিসার ইনচার্জ (ভারপ্রাপ্ত) গুলিতে শিশু আহতের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও কিভাবে বা কে গুলি করেছে তা তিনি নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি। ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
এমপি’র বিরুদ্ধে যত অভিযোগ । মঞ্জুরুল ইসলাম শুধু এই শিশু সৌরভকেই গুলি করা নয়, এর আগে গত ২১শে সেপ্টেম্বর সকাল ৬টার দিকে সুন্দরগঞ্জ হাসপাতাল চত্বরে ঢুকে প্রকাশ্যে ৫ রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করেন। এতে হাসপাতালের সাধারণ রোগী ও অভিভাবকসহ ডাক্তাররা ভীত হয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করেন। এ ঘটনাটি সেদিন টক অব দ্য সুন্দরগঞ্জে পরিণত হয়। এর কিছুদিন আগেও গত এপ্রিল মাসে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা রেললাইনের পশ্চিমে জনৈক মোতালেবের বাড়িতে প্রবেশ করে এলোপাতাড়ি ৪ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করেন। তখন ঐ রাতেই মোতালেবের গোটা পরিবার জীবন রক্ষার্থে অন্য আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে রাত যাপন করেন। গত বছর গাইবান্ধা থেকে ২ জন ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ সঙ্গে নিয়ে বামনডাঙ্গা কলেজ মাঠে সার্কাসের নামে উলঙ্গ নৃত্য ও জুয়া বন্ধ করতে গেলে প্রকাশ্যে এই এমপি নিজেই ওই দুইজন ম্যাজিস্ট্রেটকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। এ ঘটনাটি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল সেদিনও।
সুত্র: মানবজমিন