আকাবির-আসলাফ (১)
একজন তরুণ আলেম। সবেমাত্র দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করে ট্রেনে করে জীবনের প্রথম কর্মস্থল জামেয়া আশরাফুল উলূম বড়কাটারায় যাচ্ছেন। তাঁর বয়েস ২১। তখনকার সময়ে সাধারণ এই বয়েস ছাত্রদের হত। এরমধ্যে আবার দেখতেও ছোট। তখন তাঁর পাশেই বসা ছিলেন আরেকজন হুজুর। উনি দেখতেও হুজুরের মতো। তাই উনি নিজের উপর অনুমান করে পাশের এই কমবয়েসি এই তরুণ আলেমের সাথে ছাত্রসূলভ আচরণ করলেন।
পরের দিন উভয়েই বড় কাটারা মাদ্রাসায় পৌঁছে দারসে গেলেন। কিন্তু প্রত্যেকের আসন হলো ভিন্ন ভিন্ন। যিনি দেখতে হুজুরের মতো ছিলেন তিনি বসলেন ছাত্রের আসনে। আর যিনি কম বয়েসি, দেখতেও আবার ছাত্রের মতো, তিনি বসলেন উস্তাদের আসনে!
এতে হুজুর গতরের এই ছাত্র পুরোই থ বনে গেলেন।
এবার চিনতে পারছেনতো কমবয়েসি সদ্য ফারেগ হওয়া এই আলেমকে? তিনিই হচ্ছেন আল্লামা ইসহাক সাহেব রাহিমাহুল্লাহ! বাংলাদেশের হাতেগুনা যে সকল আলেমেদের রচনা কৃত্রিম এই সীমানা পাড়ি দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন কুতুবখানা ও মাদ্রাসায় স্থান দখল করেছে তম্মধ্যে একজন হচ্ছেন শায়খুল হাদীস আল্লামা ইসহাক রাহিমাহুল্লাহ। হাদীসশাস্ত্রের এক আলোকজ্জ্বল ধ্রুবতারা।
জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষাঃ
১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪১ সালে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার রাজাগঞ্জ ইউনিয়নের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন ক্ষণজন্মা এই প্রাজ্ঞ শায়খুল হাদীস। পিতা হচ্ছেন মোহাম্মদ হাবীবুল্লাহ চৌধুরী, দাদা মুহাম্মদ চৌধুরী আর মাতা হচ্ছেন মুস্তাফা বেগম।
তিনি জন্মগতভাবেই প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। শৈশবেই তাঁর মেধার বিভা ফুটে উঠে। পারিবারিক পরিমণ্ডলে তাঁর শিক্ষাদীক্ষা শুরু হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর শিক্ষা শুরু হয় গ্রামের প্রাত্যুষিক মকতবে। মকতবের উস্তাদের কাছে মাত্র তিনদিনে বাগদাদি কায়েদা সমাপ্ত করে ফেলেন। দুই দিনে আমপাড়া আর স্বল্পদিনে কুরআন শরীফ সমাপ্ত করে ফেলেন। তাঁর এই প্রখর মেধা দেখে উস্তাদ রফিক আহমদ সাহেব (বড় মিয়া) বলেন, ‘৪০ বছরেও আমি এমন মেধাবী ছাত্র দেখি নি’।
এরপর নিজগ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে লেখাপড়া করেন। প্রাথমিক শিক্ষার্জনের পর দ্বীনি ইলম অর্জনে পার্শ্ববর্তী তালবাড়ী নেছারিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে সেখানে হেদায়াতুন্নাহু পর্যন্ত অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে লেখা পড়া করেন। অতঃপর কানাইঘাট ইমদাদুল উলুম উমরগঞ্জ মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে সেখানে বছরখানেক অধ্যয়ন করে কাফিয়া জামাতের লেখাপড়া সমাপ্ত করেন। তাঁর মেধাশক্তি এতই প্রখর ছিলো যে, তিনি শুধুমাত্র উস্তাদগণের দারসের উপরই নির্ভরশীল ছিলেন। দারসের বাইরে কোনো কিতাব অধ্যয়নের প্রয়োজন অনুভব করেন নি। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেন, ‘কাফিয়া জামাত পর্যন্ত উস্তাদদের দারসের উপরই নির্ভরশীল ছিলাম। উস্তাদগণ দারসে যা বলতেন, হুবহু আমার তা স্মরণ থাকতো। ফলে কোনো কিতাব অধ্যয়নের প্রয়োজন পড়ে নি’।
উচ্চ শিক্ষার্জনে নিজ এলাকা ত্যাগঃ
নিজ এলাকায় কাফিয়া পর্যন্ত অধ্যয়ন করে উচ্চশিক্ষার্জনে তৎকালীন প্রসিদ্ধ বিদ্যানিকেতন ঢাকাস্থ জামেয়া আশরাফুল উলূম বড়কাটারা মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে হেদায়াহ আউয়ালাইন পর্যন্ত লেখা পড়া সমাপ্ত করেন। অতঃপর তাফাক্কুহ ফীদ – দ্বীন অর্জনের লক্ষ্যে নিজের আসাতেযায়ে কেরাম, আত্মীয়-স্বজন ও সহপাঠীদের পরামর্শক্রমে পাকিস্তানের বিন্নুরি টাউনস্থ বিশ্বখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামে’ উলুম আল-ইসলামিয়্যাহে জালালাইন জামাতে ভর্তি হন। সেখানেই মাদ্রাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর তাকমীল ফিল-হাদীস পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পাকিস্তানে পড়াকালীন সময়েই তিনি দারসের ফাঁকে ফাঁকে কুরআন শরীফ মুখস্থ করে ফেলেন।
জামে’ উলুম আল-ইসলামিয়্যাহের শিক্ষা সমাপ্ত করার পর হযরত সায়্যিদ ইউসূফ বিন্নুরি সাহেব রাহিমাহুল্লাহ তাঁকে বুখারি শরীফ ও মুসলিম শরীফসহ হাদীসের সকল কিতাবের ইজাযত প্রদান করেন। এছাড়া অন্যান্য আসাতেযায়ে কেরাম তাঁকে বিভিন্ন কিতাবের ইজাযত দেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য আসাতেযায়ে কেরাম হচ্ছেন- আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরি রাহ, মুফতি ওলী হাসান টুনকি রাহ, মাওলানা আব্দুর রশীদ নোমানি রাহ., আল্লামা ইদ্রিস মিরঠি রাহ., মাওলানা লুৎফুল্লাহ পেশোয়ারি রাহ., মাওলানা ফজলে হক পেশোয়ারি রাহ. এবং মুফতি রাহমাতুল্লাহ রাহ.।
শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি ২১ বছর বয়েসে প্রথমে ঢাকাস্থ বড়কাটারা মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে ইলমে দ্বীনের মহান খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু দেড়মাস পরই স্বীয় উস্তাদ শায়খ হযরত ইউসুফ বিন্নুরি রাহ. তাঁকে ইলমে হাদীসের বিশেষ ডিগ্রী ‘তাখাসসুস ফিল হাদীস’ গ্রহণের আহবান জানিয়ে পূর্ব অবগতি ছাড়াই ফ্রী বিমান টিকেট পাঠিয়ে দেন। ফলে তিনি পুনরায় বিন্নুরি টাউনস্থ জামে’ উলুম আল-ইসলামিয়্যাহে চলে যান। সেখানে দুই বছর অবস্থান করে স্বীয় শায়খ আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরি রাহ. ও মাওলানা ইদরীস মিরঠি রাহ. সাহেবের তত্ত্বাবধানে ‘তাখাসসুস ফিল হাদীসে’র কোর্স সমাপ্ত করে ইলমে হাদীসের উপর বিশেষ ডিগ্রী হাসিল করেন। তিনি শায়খ আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরি রাহ’র নির্দেশে সেখানেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। কিন্তু ঢাকাস্থ আশরাফুল উলুম বড়কাটারা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ বারবার তাঁকে চলে আসার আহবান জানালে স্বীয় উস্তাদ বিন্নুরি রাহ’র নির্দেশে তিনি আশরাফুল উলুম বড় কাটারায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
এ কথা একাধিক বার উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন, তাঁর মেধার স্বীকৃতি তাঁর শায়খগণও দিয়েছেন।
প্রখ্যাত হাদীসবিশারদ আল্লামা ইউসূফ বিন্নুরি রাহ. তাঁকে হাদীসশাস্ত্রের ইজাযত প্রদানকালে বলেন, ‘তুমি বাংলায় গিয়ে নির্ভীকভাবে হাদীসের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার করতে থাকবে’।
একবার তাঁর মামা ও শিক্ষক মুফতি রহমতুল্লাহ রাহ. সাহেব তাঁর লেখাপড়ার ব্যাপারে আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরি রাহ’কে জিজ্ঞেস করেন। জবাবে আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরি রাহ. বলেন, ‘সে আরবিতে প্রশ্নের জবাব এমনভাবে লিখে, যা বড় বড় মুহাদ্দিসীনে কেরামও লিখতে অপারগ হন’। তখন মুফতি শফী রাহ. আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন, ‘কে সে জন’? প্রতি উত্তরে ইউসুফ বিন্নুরি রাহ. ইসহাক সাহেবের মামা মুফতি রহমতুল্লাহ রাহ’র দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘সে হচ্ছে তাঁর ভাগ্নে মুহাম্মদ ইসহাক। সে আমাদের তাখাসসুস ফিল-হাদীসে অধ্যয়নরত’।
আল্লামা ইসহাক সাহেবের উস্তাদ আল্লামা ইউসূফ বিন্নুরি রাহ. দারসের তাকরীর প্রদানকালে একাধিক ব্যাখ্যা থাকলে গুরুত্বপূর্ণ দু’একটি ব্যাখ্যা প্রদান করে তাঁর দিকে ইঙ্গিত করে ছাত্রদেরকে বলতেন, ‘বাকী ব্যাখ্যা তোমরা ইসহাকের কাছ থেকে জেনে নিও। সে বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ তোমাদেরকে বলে দিতে পারবে। কেননা সে কিতাবাদি অধিক অধ্যয়ন করে থাকে’।
আশরাফুল উলূম বড়কাটারা মাদ্রাসার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা মোহাম্মদ আলী রাহ. বলেন, ‘আমার জীবনে প্রকৃতপক্ষে দু’জন মেধাবী ছাত্র পেয়েছি। একজন হচ্ছে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক ও অপরজন শায়খুল হাদীস আল্লামা মুহাম্মদ ইসহাক’।
ইলমে হাদীসের শিক্ষাদানে পদার্পনঃ
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, যে, হুজুর খুব কম বয়েসে শিক্ষাদানে নিয়োজিত হন। ঢাকাস্থ বড় কাটারা মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যখন প্রথম দারসে যান তখন তাহাবী শরীফের তাদরীস(পাঠদান) তাঁর দায়িত্বে অর্পণ করা হয়। প্রথমদিন যখন জামাতে দরস দেওয়ার জন্যে উপস্থিত হন, তখন ছাত্ররা তাঁর কমবয়েস দেখে একে অন্যের মুখে চাওয়া-চাওয়ি শুরু করে। হয়তো তারা বুঝাতে চাচ্ছিল, যে, এই কমবয়েসি ব্যক্তি কীভাবে হাদীসের দারস দিবে?
বিষয়টি তিনি অনুধাবন করতে পেরে পরের বার যখন জামাতে গিয়ে উপস্থিত হন, তখন হাদীসের উপর এমন গোছালো জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেন যে, উপস্থিত ছাত্ররা হতবাক হয়ে যায়। এভাবে সারা বছর অত্যন্ত সুনামের সাথে দরস দেন। এরপরের বছরই তাঁর দায়িত্বে তিরমিযি শরীফ ১ম খণ্ড অর্পণ করা হয়। এভাবে তিনি খুব অল্প সময়েই হাদীসের দারসের ক্ষেত্রে সর্বস্তরের গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেন।
শিক্ষকতার ক্ষেত্রে তিনি প্রথমে ঢাকার বড় কাটরা মাদ্রাসায় ধারাবাহিক দশ বছর মুহাদ্দিস হিসেবে খেদমত আঞ্জাম দেন। এরপর ক্রমান্বয়ে বিশেষভাবে জামেয়া দরগা সিলেট, জামিয়া ইসলামিয়া রাজাগঞ্জ, জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার, (মধ্যখানে) জামেয়া ঢাকাদক্ষিণ, জামেয়া রামধা এবং সর্বশেষে জামেয়া মাহমুদিয়া সোবহানীঘাটে হাদীসশাস্ত্রের খেদমতরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।
তিনি ইলমে হাদীসের গুরুত্বপূর্ণ কিতাব মুসলিম শরীফ, তিরমিযি শরীফ, আবু দাউদ শরীফ, তাহাবী শরীফ, মিশকাত শরীফ ইত্যাদি কিতাবাদির শিক্ষকতা করেন।
দরগাহ মাদ্রাসায় থাকাকেলেই তাঁর দায়িত্বে সর্বপ্রথম বুখারী শরীফ আসে। এরপর রাজাগঞ্জ মাদ্রাসায় তিনি এ কিতাবের দায়িত্ব অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে আদায় করেন। এরপর শায়খুল হাদীস খেতাবে যে তিনি ভূষিত হয়েছিলেন, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এ দায়িত্বেই ছিলেন।
তাঁর পাঠদান পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর প্রিয়ভাজন ছাত্র আমার ওয়ালিদে মুহতারাম শায়খুল হাদীস মাহমূদ হোসাইন হাফিজাহুল্লাহ বলেন, আমরা যখন দরগাহ মাদ্রাসায় পড়তাম তখন দরগা মাদ্রাসায় সিলেটের সব নির্বাচিত উস্তাদরাই দারস দিতেন, এরমধ্যে হুজুরের দারস ছিলো খুবই সুসজ্জিত, চিত্তাকর্ষক, সুন্দর স্পষ্টভাষায় দারস দিতেন। হুজুরের দারস অনেকে উর্দু ভাষায় লিখতেন। তবে তিরমিযি শরীফের দারস দরগাহ মাদ্রাসার বর্তমান মুহতামিম মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া সাহেব আরবিতে লিখতেন’।
মোটকথা আল্লামা ইসহাক সাহেব রাহিমাহুল্লাহের দারস কয়েকটি বাক্য দিয়ে বুঝানো অসম্ভব।
তিনি শুধু একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন এরকম নয়, বরং বিভিন্ন মাদ্রাসার বুখারী দারস, সমাপনী দারস ও মাদ্রাসার ভিত্তিপ্রস্তরের ক্ষেত্রেও তাঁকে নিমন্ত্রণ করা হতো। এরই ধারাবাহিকতায় ১৩ নভেম্বর ১৩-তে নগরীর নবপ্রতিষ্ঠিত ব্যতিক্রমী দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামেয়া দারুল হুদা সিলেটে’র মূল ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শরীক হন।
তাঁর সহস্রাধিক ছাত্রবৃন্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছাত্র হচ্ছেন- মুফতি আবুল কালাম যাকারিয়া সাহেব, প্রধান মুফতি ও মুহতামিম জামেয়া দরগা সিলেট। শায়খুল হাদীস মাহমূদ হোসাইন, বর্তমান শায়খুল হাদীস জামেয়া ইসলামিয়্যাহ বার্মিংহাম, মুফতি মুজীবুর রাহমান, শায়খুল হাদীস জামেয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর, মাওলানা সালেহ আহমদ জকিগঞ্জি, মাওলানা গৌছুদ্দীন রাহিমাহুল্লাহ, মুফতি শফিকুর রাহমান, মাওলানা রেজাউল হক, বৃটেন, মাওলানা হারুনুর রশীদ প্রমুখ।
রচনাবলী:
তাঁর প্রসিদ্ধ উল্লেখযোগ্য রচনা হচ্ছে দারসে মিশকাত ও দারসে বুখারি। এ ছাড়া রয়েছে হিরযুল মুসলিমীন। দারসে মিশকাতের নামকরণ সম্পর্কে শায়খুল হাদীস মাহমূদ হোসাইন হাফিজাহুল্লাহ বলেন, তিনি এমনভাবে আলোচনা করতেন, যা লিখলে একটি স্বতন্ত্র কিতাব হয়ে যেতো, তাঁর দারস অনেকে লিখতো তন্মধ্যে আমার সহপাঠি মাওলানা গৌছুদ্দীন সাহেবও লিখতেন। দারসে মিশকাতের সঙ্কলক হিসেবে উনার নাম কিতাবে আছে। হুজুর যখন এই সব জমা করে কিতাব আকারে ছাপানোর ইচ্ছা করলেন, তখন নাম দিলেন ‘আত-তাকরীরুল মালীহ লি মিশকাতিল মাসাবীহ’। তখন হুজুর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম দিবো, আমি বললাম, এত লম্বা নাম সবার জন্যে কষ্টকর হয়ে যাবে, আমি দারসে তিরমিযি নামে মুফতি তাকী উসমানি দামাত বারাকাতুহু সাহেবের একটি কিতাব দেখেছি, যা ইতোমধ্যে খুব গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে, আমার মনে হয়, হুজুর এই কিতাবের নাম দারসে মিশকাত রাখলে ভালো হয়। এরপর হুজুর এই কিতাবের নাম দারসে মিশকাত রাখলেন।
পারিবারিক জীবনঃ
তিনি প্রথম বিবাহ করেছিলেন কানাইঘাট এলাকার বিশিষ্ট বুজুর্গ হযরত মাওলানা নেছার আলী রাহমাতুল্লাহ আলাইহির দ্বিতীয় কন্যাকে। উনি খুব নেককার মহিলা ছিলেন। উনার গর্ভ থেকে হুজুরের তিন ছেলে এবং তিন মেয়ের জন্ম হয়। ছেলেরা হচ্ছেন, হাফিজ মাওলানা হেলালুদ্দীন, মাওলানা বদরুদ্দীন, শায়খুল হাদীস জামিয়া মাদানিয়া সুনামগঞ্জ ও হাফিজ মাওলানা কমরুদ্দীন। আর তিন মেয়ের স্বামীরা হচ্ছেন মুহাদ্দিস আলেম মাওলানা সাইফুল আলম, বিশিষ্ট আলেম মাওলানা হারুনুর রশীদ ও মাওলানা সৈয়দ আলী আহমদ।
ওই নেককার প্রথম স্ত্রী মাগরিবের সালাত আদায়কালীন সময়ে সেজদারত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।
এরপর তিনি আরেকটি বিবাহ করেন। এ স্ত্রীর ঔরস থেকে একজন পুত্র ও কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।
তাঁর জীবনের কয়েকটি সুন্দরতম দিকঃ
তিনি অত্যন্ত নির্মল পরিপাটি পরিবেশ পছন্দ করতেন। সর্বদা সাদা পোশাক পরতেন, ঘর থেকে টুপিবিহীন খালি গায়ে বের হতেন না। সুশৃংখলিত জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন। খানা-ঘুম, তেলাওয়াত-গোসলের নির্ধারিত রুটিন ছিলো। নিয়মিত তাহাজ্জুদ, তাকবীরে উলা, আধা পারা তেলাওয়াত এবং বাদ আছরের যিকর কখনো বাদ পড়তো না। তাঁর দৈনন্দিন তেলাওয়াত সম্পর্কে তিনি নিজে বলেন, তিনি এই অর্ধেক পারা তেলাওয়াতের প্রতি এতই যত্নবান ছিলেন যে, যেদিন উনার পিতার ইন্তেকাল হয় সেদিনও এই তেলাওয়াত বাদ পড়ে নি, এমনকি যেদিন উনার স্ত্রীর ইন্তেকাল হয় সেদিনও এই তেলাওয়াত বাদ পড়ে নি। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের প্রতি এতই পাবন্দ ছিলেন যে, কায়লুলাহ বা দুপুরে ঘুমানোর সুন্নত কখনো বাদ পড়তো না, যে সুন্নত আঁকড়ে ধরেছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর উপর অটুট ছিলেন।
তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল, সাদাসিধে, নিরহংকারী নম্রস্বভাবের অধিকারী ছিলেন। গীবত-শেকায়ত থেকে দূরে থাকতেন। তাঁর সাথে চললে মনে হত না যে রাগ নামক স্বভাব তাঁর মধ্যে বিদ্যমান আছে। খোশমেজাজ-হাস্যবদনের অধিকারী এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। ছাত্রদের সাথে ফূর্তি-আমোদও করতেন। তাঁর নম্রতা-কোমলতার দরুন তাঁকে ‘মাটিয়া পীর’ বলা হত।
তিনি সবকিছুর উপরে দরস-তাদরীসকে অগ্রাধিকার দিতেন। দরসপ্রদানের সময় যদি কোনো মেহমান উপস্থিত হতেন, উনি যতই গুরুত্বপূর্ণ হন না কেনো, সন্তোষজনক আপ্যায়নের পর মেহমানের অনুমতি নিয়েই দরসে চলে যেতেন।
জীবনের শেষ দিনগুলোঃ
তাঁর জামাতা মাওলানা সাইফুল আলম সাহেবের সূত্রে পাওয়া যায় যে, ‘তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কাছ থেকে বিদেয় নিয়ে চলে যাচ্ছেন’। এই স্বপ্নের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, যে আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না। তাই তিনি অন্য বছর যে সময় বুখারী শরীফের দারস সমাপ্ত করতেন, এ বছর এর অনেক পূর্বেই তা সমাপ্ত করে ফেলেন। এদিকে দিনে দিনে তাঁর চেহারা প্রোজ্জ্বল হচ্ছিলো। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহের অনুসারীদের চেহারা যতদিন যায় তত উজ্জ্বল হয়’। আল্লামা ইসহাক সাহেব রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন এই কথার বাস্তব প্রতিবিম্ব। তাঁর চেহারার উজ্জ্বলতা ক্রমশ বাড়ছিল। ইন্তেকালের পর তাঁর চেহারা এই পরিমাণ নুরান্বিত হয়েছিল যে, প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, তাঁর চেহারা এমন হাস্যরত প্রোজ্জল ছিলো, যে, এরকম চেহারা জীবনে দেখিনি।
উনার এলাকার মাওলানা সুলাইমান সাহেবের বলেন, যে তাঁর ইন্তেকালের কয়েকদিন পূর্বে সর্ব কনিষ্ট মেয়ে বলেন, ‘আব্বা! আপনাকে এখন খুব সুন্দর এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মনে হচ্ছে’।
জবাবে তিনি বলেন, ‘নেককার মানুষ মৃত্যুর নিকটবর্তী সময়ে সুন্দর এবং তাজা হয়ে যায়’।
ইন্তেকাল ও জানাযাঃ
চলতি বছরের এপ্রিল মাসের শেষদিকে তাঁর হার্টের সমস্যা বেড়ে যায়, এরপর তাঁকে সিলেট নগরীর ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রায় সপ্তাহখানেক হাসপাতালে থাকার পর কোনোধরনের শারীরিক উন্নতি না হওয়ায় ২৯ এপ্রিল রাত দশটার দিকে তাঁর নিজ বাড়ী কানাইঘাট উপজেলার তালবাড়ীর উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। পথিপথ্যে নগরীর মিরাবাজার ও শিবগঞ্জের মধ্যখানে রাত ১০টা ১৫ মিনিটে ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ইন্তেকালের সময় তাঁর বয়েস ছিলো ৭৪ বছর।
মৃত্যুকালে তাঁর ওসিয়ত ছিলো যে, পরিবারের কোনো সদস্য যেনো তাঁর মৃত্যুতে সশব্দে ক্রন্দন না করে। আল-হামদুলিল্লাহ হযরতের পরিবারবর্গও এই কথার উপর অক্ষরে অক্ষরে আমল করেছেন।
তাঁর আরেকটি ওসিয়ত ছিলো, যে, তাঁর লাশকে সামনে রেখে যেনো আলোচনা সভা না হয়। এজন্যে তাঁর লাশকে সামনে রেখে কোনো আলোচনা-সভা হয় নি।
তাঁর জানাযায় বৃহত্তর সিলেটের সর্বস্তরের আলেম-উলামা ও মুহাদ্দিস ও শায়খুল হাদীসদের সমাগম ঘটে। আল্লাহ তা’আলা তাকে জান্নাতুল ফিরদাউসে স্থান দিন। আমীন।
লেখক : আব্দুল্লাহ মায়মূন, প্রবন্ধকার, শিক্ষক