বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৩:০৩
Home / আকাবির-আসলাফ / হৃদয়ে হৃদয়ে তুমি রবে নীরবে

হৃদয়ে হৃদয়ে তুমি রবে নীরবে

মোস্তফা কামাল গাজী
এহাতায়ে মুলছরিতে নীরবে বসে আছি অনেকক্ষণ ধরে। নওদারার সামনের দিকটায় হযরতের খাটিয়া রাখা আছে। সাদা কাফনে ঢাকা। নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি ঘুমুচ্ছেন যেনো। কেমন নির্মল হাসি হাসি চেহারা। আশেপাশে ভক্ত, অনুরগীদের ঢল। হযরতকে শেষ বিদায়ের অপেক্ষায় সবাই। কারো মুখে কথা নেই কোনো। কী এক যন্ত্রণায় কাতর সবাই। মলিন চেহারা নিয়ে নির্বিকার বসে আছে সবাই। হযরতের এই আকস্মিক পরযাত্রা যেনো কেউ মেনে নিতে পারছে না। কাছের খাদেমরা এখনো হাউমাউ করে কাঁদছে। তাঁদের সান্ত্বনা দেবার কেউ নেই। তাঁদের মতো আমারও কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। সবার সামনে আমি কাঁদতে পারি না। কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে। আজ সকালে ওজু করতে গিয়ে হযরতের কথা মনে হতেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না চলে এলো। দরোজা আটকিয়ে কাঁদলাম কতোক্ষণ। পরদেশে তাঁরাই তো আপনজন, রাহবার। তাই তাঁরা হারিয়ে যাওয়া মানে কাছের কেউ হারিয়ে যাওয়া। বেদনাটাও আপনজন হারানোর মতো।
হযরতের জন্ম ভারতের উত্তর প্রদেশস্থ আজমগর জেলায়। ১৯২৮ সাল মোতাবেক ১৩৪৫ হিজরির রজব মাসে সোমবারদিন তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক নাম আব্দুল হক। উপাধী আজমী। প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গ্রামে সমাপ্ত করে দারুল উলুম সরায়ে মীরে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে দারুল উলুম দেওবন্দে দাওরায়ে হাদিসে দাখেলা হয়। ১৯৪৯ সালে তাঁর শিক্ষাজীবন সমাপন হয়। এরপর শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। ১৬ বৎসর পর্যন্ত বেঁনারসে দরস তাদরিস চালিয়ে যান। ১৯৮২ সালে মজলিসে শুরার পরামর্শক্রমে দারুল উলুম দেওবন্দে বুখারি সানি পড়ানোর জন্যে নিয়োগ হন। সেই থেকে আমৃত্যু দীর্ঘ ৩৫ বৎসর দারুল উলুম দেওবন্দে বুখারি সানির দরস প্রদান করেন। এ সময়ে শত শত ছাত্র তৈরি হয় তাঁর ছায়াতলে। তিনি সর্বদা আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করতেন যেনো হাদিসে খেদমত করতে করতে মাওলার দরবারে হাজির হতে পারেন। আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেছেন। কয়েকদিন ধরে খুব অসুস্থ ছিলেন। ক্লাসে আসতে পারতন না মাঝে মধ্যে। শেষ কয়েকটাদিন আসেনও নাই। আমরা উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত। না জানি কী হয়! এর মাঝে পরীক্ষা শুরু হলো। পরীক্ষা শেষ হলো ২৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার। শনিবার থেকে যথারীতি ক্লাসে আসার কথা। কিন্তু তা আর হলো না। শুক্রবার দুপুরে হঠাৎ হযরতের শরীর অস্বাভাবিক খারাপ হয়ে পড়ে। মেডিকেল নেয়া হয়। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। শত চেষ্টার পরও তাঁকে বাঁচানো গেলো না তাঁকে। ১ রবিউস সানি ১৪৩৮ হিজরি মোতাবেক ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখ শুক্রবার মাগরীবের পর ডি কে জৈন হাসপাতালে শত শত ছাত্র আর ভক্তদেরকে শোক সাগরে ভাসিয়ে চলে যান মাহবুবের দরবারে।
হযরত ছিলেন নিতান্তই একজন সাধাসিধে অমায়িক মানুষ। তাঁর দরসে বসলে যেনো নূর ঝরতো শুধু। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম তাঁর মাধুর্যপূর্ণ তাকরির। ছোটখাটো বিষয়ে ছাত্রদের দিতেন ধমক। ছাত্ররা এতে কষ্ট না পেয়ে পেতো দারুণ আনন্দ। মজার মজার কথা বলে জমিয়ে রাখতেন পুরো ক্লাস। মাঝে মধ্যে হাসির রোল পড়ে যেতো। হযরতের বরকতের একটু সঙ্গ পাবার আশায় কাছে গিয়ে বসতো ছাত্ররা। একটু দোয়ার আশায় ছুটতাম তাঁর হুইল চেয়ারের পিছু। আলতো করে ছুঁয়ে দিতাম তাঁর চেয়ারটা। এটাই যেনো বরকতের বিশাল একটা অংশ। চলতে চলতে হুজুর চোখ বন্ধ করে তাসবিহ পড়তেন নীরবে। আমার মতো অনেক পাগল ছুটতো হুজুরের পিছু। একেবারে মসজিদে সাত্তা পর্যন্ত।
হজরত আজ নেই আমাদের মাঝে। কী শূন্যতা অনুভব হচ্ছে মনে। মানুষ হারিয়ে গেলে তার কদর বুঝে আসে। হযরত যে কী ছিলেন, কেমন ইলমের অধিকরী ছিলেন তা এখন ভালোভাবেই বুঝতে পারছি।
জানাজার কাতারে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। হযরতের খাটিয়া রাখা হয়েছে দারে জাদিদের সামনের দিকটায়। অন্যসব জানাজা এহাতায়ে মুলসুরিতে হয়ে থাকে। মানুষ বেশি হওয়ায় মদ্রাসার মূল মাঠে হচ্ছে হযরতের জানাজা। নামাজের সময় দেয়া হয়েছিলো দুপুর দেড়টায়। হযরতের ওলীগণ আসতে দেরি হওয়ায় সাড়ে চারটায় অনুষ্ঠিত হলো নামাজ। এতে কারো কোনো বিরক্তি দেখা গেলো না। সবাই যেনো চায় হযরত আরেকটু থাকুক আমাদের মাঝে! জানাজা পড়ালেন মাওলানা আরশাদ মাদানি দাঃবাঃ। নামাজ শেষে কবরস্থানে নেয়ার জন্য খাটিয়া ওঠানো হলো। চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলাম না। ঝরঝর করে আরেকবার ঝরতে লাগলো। মনটা ব্যথায় ভরে গেলো। সবার মতো আমিও ছুটলাম খাটিয়ার পেছন পেছন।
আজকের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। কেমন গুমোট পরিবেশ। বাতাসেও বেদনার গন্ধ। তারাও কি কাঁদছে হযরতের বিয়োগ ব্যথায়?
কাসেমি কবরস্থানে আগেই কবর খনন করা হয়েছে। হযরতকে কবরে নামানো হলো। শেষবারের মতো হযরতের চেহারাটা আরেকবার দেখলাম। আগের সেই হাসি হাসি কোমল মুখটা! কবরে তিন মুষ্টি মাটি দিয়ে একবুক ব্যথা নিয়ে চলে এলাম। কাসেমি কবরস্থানে চিরকালের জন্য সমাহিত হলেন আরেকটি এলেমের খনি।
শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ, ইউপি, ভারত।

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

সীমান্তে অভিবাসী শিশুদের তাড়াতেও কাঁদানে গ্যাস!

কমাশিসা: কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় ঢেকে গিয়েছে চারদিক। আতঙ্কে ছুটোছুটি করছে অনেকগুলি পরিবার। শিশুদের জাপটে ধরেছেন ...