কুতায়বা আহসান
পূর্ব প্রকাশের পর
– নতুন নৌবহর, তাজাদম লশকর আর আপন শাহিনসাথীদের নিয়ে খাইরুদ্দীন বারবারুসা পুনরায় সাগরে নেমে পড়লেন। আফ্রিকার দিকে রওয়ানা হবার পূর্বেই তিনি তাঁর দ্রুতগামী টহল দলকে সেখানে পাঠিয়ে তাঁর সমমনাদের কাছে বার্তা প্রেরণ করলেন, তারা যেন সত্তর আলজেরিয়ার উপকুলে এসে পৌঁছান। তাঁদের সাথে তাঁর জরুরী পরামর্শ রয়েছে।
– খাইরুদ্দীন আলজেরিয়ার উপকুলে এসে দেখলেন তাঁর সমমনাদের মাধ্যে মাত্র একজন তাঁকে ইস্তেকবাল জানানোর জন্য উপকুলে এসে পৌঁছেছেন, আর তিনি হচ্ছেন সুগরাভি কবিলার সর্দার আব্দুল আযীয।
– বারবারুসা আর তাঁর সাথীরা অত্যন্ত আবেগ নিয়ে আব্দুল আযীযের সাথে মিলিত হন।
– বারবারুসা আব্দুল আযীযকে একা দেখতে পেয়ে কিছুটা তাজ্জবের সাথে বলেন: মুহতারাম ভাই! প্রথমেই আমি আপনার শুকরিয়া আদায় করছি। আপনি আমার ডাকে সাড়া দিয়ে তাকলিফ স্বীকার করে চলে এসেছেন। কিন্তু বারবারদের নেতা হাফসিকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?
– আব্দুল আযীয প্রশ্নটা শুনে উদাস ও বিষন্ন হয়ে উঠলেন। এরপর বারবারুসাকে খেতাব করে বললেন: প্রিয় ভাই! হাফসি আসবেন না। তিনি বিক্রিত হয়ে গেছেন। কুকোর সুলতান ইবনে কাজি তাকে বড় অংকের অর্থমূল্যে কিনে নিয়েছেন। তিনি আর আমাদের পক্ষ হয়ে আসবেন না, বরং আমাদের শত্রুদের পক্ষ হয়ে আমাদেরই মোকাবেলায় আসবেন।
– আব্দুল আযীয কিছুক্ষণ নীরব থেকে অধিকতর বিষন্ন কন্ঠে বলে যেতে লাগলেন:
– আমার প্রিয় ভাই! কিছুসংখ্যক মানুষ সময়, দূরত্ব আর আগ্রহের কাফেলার অশ্বখুরের ধুলি দেখে তার মানযিল নির্ধারণে পরিবর্তন নিয়ে আসে। আফ্রিকার ছোট বড় মুসলিম রিয়াসতগুলোর হাকিম আর সুলতানরা আজ ঐ অবস্থার শিকার।
– কওমের ঘাড়ে চেপে বসা দায়িত্বজ্ঞানহীন এই লোকগুলো আন্দালুসীয় মুসলমানরা যে সব হিংস্র জালেমদের থাবায় ক্ষত বিক্ষত হচ্ছিল, জন্মভূমি ছেড়ে সাগর পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল, সেই সব রক্তখেকোদের কাছে তাদের ভবিষ্যতের নিরাপত্তা খুঁজছে। তারা বিশ্বাস করছে সেই জালেম স্পেনীয়রা তাদের ভবিষ্যত উজালা করে দেবে। তাদের ভাগ্যের সেতারায় চমক জাগিয়ে দেবে। অথচ তারা জানে না স্পেনীয়রা তাদের ভাগ্যের ঝুলিতে ভীষণ সদমা, সীমাহীন আফসুস আর সাগর সাগর অশ্রু ভরে দিতে চায়।
– হায়! কেউ যদি তাদেরকে একথাটা স্মরণ করিয়ে দিত যে, ভিজে ছাই থেকে কখনো আগুনের ফুলকি ওড়ে না। পানির বুদ্বুদ থেকে কখনো ঘূর্নি জেগে উঠে না।
– আব্দুল আযীযের গলা ক্রমে ধরে আসছিল। তিনি বলছিলেন:
– হায় কোনো রহস্যভেদী যদি তাদের কাছে এ সত্যটা উদ্ঘাটন করে দিত যে, তারা যাদের সঙ্গ ধরেছে সেই স্পেনীয়রা মুসলমানদের সৌহার্দ্যের মধ্যে নফরতের বীজ বপন করতে চায়। এরা তো সেই হিস্পানীয় শক্তি; যাদের ঝুলিতে রয়েছে সেই প্রতারণা, সেই রক্ততৃষ্ণা, সেই আগুন আর ঘৃণা যা তারা মাদ্রিদে, সেভিলে, কর্ডোবায় এবং গ্রানাডায় দেখিয়েছিল। ওরা যদি কিছু দেয় তাহলে সেটা যে সেই ঘৃণা, সেই রক্ত আর সেই প্রতারণা ছাড়া কিছুই হবে না তা হলফ করেই বলে দেয়া যায়।
– আহ! যদি কুদরতের পক্ষ থেকে অন্ধকারে পড়ে থাকা এই দায়িত্বজ্ঞানহীনদের যদি কেউ এ কথাটা বলে দিত— জীবনের প্রকৃত স্পন্দন কাকে বলে? যদি তাদেরকে কেউ এটা জানিয়ে দিত, তাঁদের সামনে কোথায় মৃত্যুর কোন গহীন ফাঁদ পাতা রয়েছে! দুর্ভাগ্য কোথায় ওঁত পেতে বসে আছে। আহ! তাঁরা যদি জানতো সমুদ্রপার থেকে চলে আসা যে শক্তির সঙ্গ তাঁরা দিচ্ছে এরা প্রজ্জ্বলিত আগুন ছাড়া কিছুই নয়। এ আগুন তাঁদেরকে জ্বালিয়ে ছাই করে মাঠে ছড়িয়ে রাখবে।
– আব্দুল আযীয কথাগুলো বলে থেমে যেতেই বারবারুসা তাঁর কাঁধ চাপড়িয়ে বললেন:
– আব্দুল আযীয, আমার মুহতারাম ভাই! আমি আপনার আবেগকে শ্রদ্ধা করি। কুকোর সর্দার ইবনে কাজি যদি হিস্পানীয়দের সঙ্গ দেয়ার জন্য বারবারদের নেতা হাফসিকে তার সাথে মিলিয়ে নেন, তাহলে এতে আমাদের চিন্তিত হবার কিছুই নেই। আমরা আমাদের কাজের শুরুটা সেই ইবনে কাজি থেকেই শুরু করবো।
– খাইরুদ্দীনের এ সিদ্ধান্ত শুনে কেবল আব্দুল আযীযই নন তাঁর সকল সালাররাও আনন্দে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেন। এরপর খাইরুদ্দীন কিছুটা ভেবে সুগরাভি কবিলার সর্দার আব্দুল আযীযকে লক্ষ করে বলতে থাকেন:
– আব্দুল আযীয! আমার মুহতারাম ভাই! —–।
– খাইরুদ্দীন আর আগাতে পারলেন না, আব্দুল আজীজ আবার বলে উঠলেন:
– ইবনে ইয়াকুব! সম্ভবত আপনি আমাকে এ প্রশ্ন করতে যাচ্ছেন আমি আপনার সহায়তায় সাথে করে কোনো সাহায্য নিয়ে এসেছি কি না? তো শুনো ভাই! আমার কাছে যে পরিমাণ সৈন্য ছিল তা দু’ভাগ করে এক অংশকে আমার অধীনস্ত এলাকার নিরাপত্তায় রেখে বাকি অর্ধেককে সাথে নিয়ে আপনার কাছে চলে এসেছি। আমার লশকর বর্তমানে আপনার লশকরের পাশেই শিবির পেতে আরাম করছে।
– আব্দুল আযীযের এ কথা শুনে বারবারুসা আবারো তাঁর কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বললেন:
– তাহলে এবার চল সব মাল্লাদের নিয়ে আমরা শিবিরে চলে যাই। এতদসঙ্গে বারবারুসা তাঁর অন্তরঙ্গ সাথী সালেহের দিকে তাকিয়ে বললেন: সালেহ! যে সব জওয়ান আমাদের নৌবহরের নিরাপত্তায় মামুর রয়েছে তাঁদেরকে ছাড়া সবাইকে বল, তারা যেন শিবিরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নেয়। এ কথা বলেই খাইরুদ্দীন আব্দুল আযীযকে সাথে নিয়ে তাঁর জন্যে পেতে রাখা খিমার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। চলবে