মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরি
বর্তমানে মাদরাসায় পড়ানো কিংবা মসজিদে ইমামতি করার পাশাপাশি রোজগারের জন্য কোনো ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়ানো অনেকেই খারাপ মনে করে থাকেন। ভাবেন আলেম মানেই তো কেবল মাদরাসা, মসজিদ, খানকা নিয়েই পড়ে থাকা এক গোষ্ঠীর নাম। সাধারণের পাশাপাশি এমনটা আলেমরাও ধারণা করে বসছেন আজকাল। অথচ নিজ হাতে জীবিকা উপার্জন করা একটা উত্তম কাজ। এটা তাকওয়া, পরহেজগারির বিপরীত কোনো বিষয় নয়। বোখারি শরিফের ২৭৮ নম্বর পৃষ্ঠায় এ সম্বন্ধে একটা স্বতন্ত্র অধ্যায়ও রয়েছে। তাছাড়া নবী-রাসুল (সা.), সাহাবায়ে কেরাম ও আকাবিরদের প্রায় প্রত্যেকেই ধর্মীয় কাজের পাশাপাশি সংসার পরিচালনার জন্য কোনো একটি পেশা বা কাজ বেছে নিয়েছিলেন। হজরত দাউদ (আ.) রাষ্ট্র পরিচালনার পাশাপাশি লৌহবর্ম তৈরি করতেন। হজরত সোলাইমান (আ.) ঝুঁড়ি বানাতেন। রাসুল (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই নানাধরনের ব্যবসা করেছেন। এইতো কয়েকশো বছর আগেও বাদশাহ আওরঙ্গজেব (রহ.) নিজ হাতে কোরআন শরিফ লিপিবদ্ধ করতেন এবং তা বিক্রি করতেন। আজও দারুল উলুম দেওবন্দের কুতুবখানায় তার হাতে লেখা কোরআনে কারিমের সেই কপি হুবহু বিদ্যমান। দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার আগে শাইখুল ইসলাম হজরত মাওলানা কাসেম নানুতাবি (রহ.) মিরাঠের একটা ছাপাখানায় প্রুফ দেখার কাজ করতেন। দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পর তা ছেড়ে দেবার তাগাদা দিয়ে চিঠি দেওয়া হলো। তিনি আরজ করলেন, ‘সব ছেড়ে দিলে আমার পরিবারের খরচ বহন করবো কী করে!’ তাহলে কি তার মাঝে কোনো তাকওয়া, পরহেজগারি ছিলো না? অবশ্যই ছিলো। অধিক তাকওয়ার ফলেই দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে তিনি কোনোদিনও বেতন গ্রহণ করতেন না।
বর্তমানে আমাদের পথপ্রদর্শক দারুল উলুম দেওবন্দের আসাতিযায়ে কেরাম অধ্যাপনার পাশাপাশি কোনো না কোনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। অধম নিজেও বহুদিন কুতুবখানায় কাজ করেছে। ছাপানো, বাইন্ডিং সব নিজ হাতে করা হতো। কারো সহযোগিতা নেয়া হয়নি কখনও। দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ভাতা গ্রহণ করে আবার লিল্লাহ ফান্ডে ওয়াকফ করা হয় আজ অবধি। আলেমরা মাদরাসা-মসজিদ, মক্তব, খানকা সবই দেখবে। পাশাপাশি প্রয়োজনমাফিক জীবিকা উপার্জনের জন্য যেকোনো একটি কাজে লেগে যাবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যেনো ধর্মীয় কাজে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে। আর মাদরাসা, মসজিদ থেকে যা পাবে, তাকে গনিমত মনে করা চাই। পড়া, পড়ানো, খাওয়া, ঘুমছাড়া আমাদের হাতে যথেষ্ঠ সময় থাকে। সে সময়টা অযথা নষ্ট না করে উপার্জনের উদ্দেশ্যে কোনো না কোনো কাজে ব্যয় করা উচিত। কাগজ কিনে লেখালেখি করা বা সেলাই মেশিন কিনে ঘরে বসে কাজ করা চাই। এতোটুকুন শ্রমও সংসার পরিচালনার জন্য যথেষ্ঠ। প্রথম তো আসবাব গ্রহণ করতে হবে আমায়। তারপর না হয় তাওয়াক্কুলের পর্ব। তিরমিজি শরিফের একটা হাদিসে রয়েছে, এক সাহাবি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি কি উটের পায়ে রশি লাগিয়ে তার ওপর ভরসা করে ঘরে বসে থাকবো?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘আগে তো হেফাজতের জন্য আসবাব গ্রহণ করো। তারপর না হয় ভরসা করো।’ এ কারণে প্রথমে আসবাব এখতিয়ার করা দোষণীয় নয়, বরং আমরা আমাদের আকাবিরদের থেকেও এই শিক্ষাই পাই। এজন্য জীবিকার উদ্দেশ্যে কেবল মাদরাসায় পড়ানো বা মসজিদে ইমামতি করার ওপর ভরসা করা উচিত নয়। এতে কোনো বুজুর্গি নেই; বরং নিজ হাতে উপার্জন করে বৈধপন্থায় সম্মানের সঙ্গে জীবনযাপন করাই মোমিনের উত্তম কাজ।
আলোচক : শাইখুল হাদিস, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত
শ্রুতিলিখন ও অনুবাদ : মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ ও মাহদি হাসান সজিব