মাহদি হাসান সজিব
‘এতক্ষণে সময় হলো তোর! আধঘন্টা যাবত দাঁড়িয়ে আছি৷ বের হওয়ার কোনো নামই নেই যেনো৷ কি করেছিলি এতসময়?’
‘দুঃখিত বন্ধু৷ একটুও খেয়াল ছিলো না৷ নামাজ পড়ে ইমাম সাহেবের সাথে কথা বললাম৷ কুরআন পড়া শিখতে হবে৷ নইলে উপয় নেই যে৷ যাগ্গে এসব৷ তোদের গাড়ি ছাড়বে কখন তাই বল।’
‘এইতো পনেরো—বিশ মিনিট৷ চল এগিয়ে দেই৷’
কথা হচ্ছিলো আদনান ও আহমাদের মধ্যে৷ শৈশব থেকেই অন্তরঙ্গ বন্ধু দুজন৷ একজন ছাড়া আরেকজন(!) কল্পনাও করা যায় না কখনো৷ ক্লাসে বসা, খেলাধুলা সবই একসঙ্গে৷ ছোটবেলা তো একগ্রুপে না হলে খেলতই না৷ তবে বন্ধুতের এ বন্ধনটা আরো মজবুত হয় তাবলিগে গিয়ে৷ একদিন এক আলেম বয়ান করেছিলেন, হাদিসে এসেছে ‘আল্লাহর জন্য কাউকে মহব্বত করা বা ঘৃণা করা উভয়টাই ঈমানের দৃঢ়বন্ধন’৷ আরেক বর্ণনায় রয়েছে ‘কেউ যদি কাউকে আল্লাহর জন্য মহব্বত করে সে যেনো তাকে বলে দেয়’৷ সেদিনই আহমাদ বলেছিলো আদনান তোকে আমি আল্লাহর জন্যই ভালোবাসি৷ এরপর থেকে ওদের পথ হয়ে যায় এক ও অভিন্ন৷ চলাফেরাটাও ব্যাতিক্রম ছিলো অন্যদের থেকে৷ এজন্য নজর কেড়েছে গুরুজনদের৷ বন্ধুমহলেও কুড়িয়েছে সুনাম৷
আহমাদ দুবোনের একভাই৷ বাপের রয়েছে অঢেল সম্পত্তি৷ কিন্তু চলাফেরাটা সাধারণ৷ নিরহংকার একজন মানুষ৷
আদনান পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়৷ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ও৷ বাবা একটা কম্পানিতে চাকুরী করেন৷ তা দিয়ে চার ভাইবোনের পড়ালেখা,ও সংসার কোনরকম চলে যায়৷
দশম শ্রেণিতে পড়ে আদনান৷ আজ স্কুল থেকে শিক্ষা সফরে যাচ্ছে সকলে৷ ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারছে না আদনান৷ পড়ার খরচটাই চলে না; আর তো সফর! প্রাইভেটটা বন্ধ করে দিয়েছে সে—কবে! আসলে সংসারের বড় হলে এমন অনেক ত্যাগই স্বীকার করতে হয়৷ ছোট বোনটার জন্য সমন্ধ আসছে চারদিক থেকে৷ রাজি হলেই হয়৷ সমস্যা টাকা৷
বন্ধুরা অনেকে বলেছে সঙ্গে যাওয়ার৷ টাকার যোগাড়টাও ওদের হাতে৷ কিন্ত আদনান ঋণী বা বোঝা হতে চায় না কারোর কাছে৷ আহমাদও বুঝালো৷ কাজ হলো না কোনো৷ আদনান ছাড়া ওর আনন্দই যে মাটি! তবুও আব্দার ওকে গাড়ীতে উঠিয়ে দেওয়ার৷ সে আশায়ই দীর্ঘ প্রতিক্ষা আহমাদের৷
প্রত্যেকে যার যার ছিট দখল করে আছে৷ দু’একজন বাইরে৷ অপেক্ষা শুধু আহমাদের৷ একটা চাপা আনন্দ বিরাজ করছে সবার মাঝে৷ দুজনই পৌছালো সেখানে৷ গাড়ীতে উঠলো আহমাদ৷ মনটা ভিষন খারাপ৷ গাড়ি ছেড়ে দিলো৷ জানালা দিয়ে মুখটা বের করে শুধু বললো, ‘বন্ধু সন্ধ্যেই চলে আসবো৷ কষ্ট নিসনে৷ বাড়ি যা এখন৷’
ঠায় দাড়িয়ে আদনান৷ চিৎকার করে কান্না আসছে ওর৷ চোখ গড়িয়ে পড়ছে জল৷ কী—এক অভাবের সংসার৷ মানুষ কত না অসহয়! তবুও মানতে হবে৷ এটাই নিয়তী৷ এ্যাবড়ো—থ্যাবড়ো হাঁটছে ও৷ পা নড়ছে না যেনো৷ অন্যমনস্ক৷ খেয়াল নেই কোনদিকে৷ পিছন থেকে হর্ণ দিচ্ছে গাড়ি৷ শুনতে পাচ্ছে না ও কিচ্ছুই৷ দেখতে দেখতেই ও চলে এলো গাড়ির একদম নিচে৷ যাত্রীরা অনুভব করলো একটা ঝাকির৷ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো শরীর৷
বড্ডো খারাপ লাগছে আহমাদের৷ মন চাচ্ছে নেমে যেতে৷ তারপরও চললো৷
সন্ধ্যের পর৷ গাড়ী থামলো বাজারে৷ আহমাদ ছুটছে আদনানের কাছে৷ কেমন যেনো লাগছে ওর৷ পথে পড়লো নতুন একখানা কবর৷ অবাক হলো৷ থমথমে পরিবেশ৷ কেমন একটা শোকের বাতাস৷ ভেসে আসছে চাপা কান্নাও৷ বুঝতে বাকি থাকে না কিছু৷
কবরে বসে পড়ছে আহমাদ৷ অঝর ধারায় গড়াচ্ছে জল৷ আজ শোধ নিলি তুই! এমনটা তো করসনি কোনদিনও৷ আমি একা গেলাম বলে একাই গেলি চিরদনের জন্য!
শিক্ষার্থী: দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত