বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৫:৪৫
Home / প্রতিদিন / ভাষার জয়গান

ভাষার জয়গান

এহতেশামুল হক ক্বাসিমী : বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস-ঐতিহ্য বেশ প্রাচীন। এর উত্তরাধিকার অনেকের পক্ষেই ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কম করে হলেও দেড় হাজার বছরের পুরনো এ ভাষা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। যুগ-যুগান্তরের নানা প্রকার বাধাবিপত্তিতে তা আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কালের পরম্পরায় এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রও কম হয় নি। এতে করেই এ ভাষার পক্ষে তা শাপেবর হয়েছে। এ ভাষাভাষী সম্প্রদায়ের ওপরও নানাভাবে শোষণ-পেষণ অব্যাহত থাকে। কিন্তু কোনোক্রমেই তারা থেমে থাকেন নি। বরং ততোধিক প্রাণবায়ু সঞ্চয় করে এগিয়ে গেছেন। আশ্চর্য হলেও সত্য, ইতিহাসের ধারাপথ বেয়ে বাংলা আজ বিশ্ব সভায় স্থান করে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা হিসেবেও স্বীকৃতি আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এ ভাষার মাহাত্ম্য ও মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পাবে নিঃসন্দেহে।
কী এর রহস্য-উৎস বা হয়ে ওঠা? এক কথায় উত্তর দেয়া কঠিন ব্যাপার। এর মধ্যে অনেকগুলো উপায়-সমবায় যুক্ত হয়ে আছে। প্রধানতম কথা হচ্ছে- বাংলা ভাষা জনমনের মৃত্তিকা মূল থেকে উৎসারিত হয়েছে। এর শেকড়-বাকড় শত-সহস্র বছরব্যাপী বিস্তৃত হয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। চড়াই-উৎরাই, টানাপড়েন ও শোষণ-বঞ্চনার মধ্য দিয়ে নিজেকে গড়ে তোলে। স্বভাবত এর গ্রহণ-বর্জন উপায়-উপাদান, উপযোগ-সংযোগ অনেক রকম বেশি, বহু বর্ণিল ভাবপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে অনেক বেশি সক্ষম।
উদাহরণস্বরূপ বাগানের ছায়াতলে আদরে লালিত বৃক্ষ ও পথের ধারের বৃক্ষের তুলনা করা যায়। ছায়াশ্রিত বৃক্ষ ক্ষণভঙ্গুর। সামান্য ঝঞ্ঝা-আঘাতে ভেঙে পড়ে। অন্য দিকে পথের ধারের বৃক্ষটি নানা রকম অত্যাচার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত। গরু খায়, ছাগলে মুড়ে, কেউ বা পাতা ছিঁড়ে ও ডাল ভাঙে। অবশেষে এ গাছটিই গোড়া থেকে বেশ শক্তিশালী রূপে বেড়ে ওঠে। তখন আর কেউ তাকে আঘাত করার সাহস পায় না।

দুই.
বাংলা ভাষা হচ্ছে এই পাশের বৃক্ষের মতোই। অথবা এ ভাষা প্রসঙ্গে স্রোতস্বিনী নদী ও বদ্ধ জলাশয় বা পুকুরের কথা মনে পড়ে। বাংলা ভাষা বহতা নদীর মতো। ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে তা নগর জনপদ গড়ে তোলে। উৎপাদনশীল পলিমাটি ফেলে সবুজ শ্যামলে ভরিয়ে দেয়। জীবন সুখসমৃদ্ধ ও সুসংহত হয়ে ওঠে।
এর পেছনে ছিলো বাংলা ভাষার অবিরাম চর্চা, অনুশীলন ও প্রয়োগ ব্যবহার। অব্যবহৃত জিনিস বরাবরই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। প্রতিটি বস্তুরই যেমন একটা নিজস্ব ব্যবহারবিধি রয়েছে। এবং এর ফলেই তা টিকে থাকে। নইলে আবর্তনের ঘূর্ণিপাকে হারিয়ে যায়। অন্য দিকে ব্যবহারের ফলে তা নবনব যাত্রাযোগে বেড়ে ওঠে। কালের মাত্রামহিমায় উপযোগিতা লাভ করে। বিবর্তনের ধারায় সক্ষমতা অর্জন করে নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে সক্ষম হয়। বাংলা ভাষার বেলায়ও অনুরূপ ইতিহাসের দৃশ্যরূপ সঙ্ঘটিত হতে দেখা যায়।
ভারতীয় ইতিহাসের প্রাচীনতমকাল থেকেই অনুরূপ প্রয়াস লক্ষ করা যায়। বৈদিক যুগেই বঙ্গীয় বাঙ্গালদের বয়াংসি বা পশুপাখি বলে অভিহিত করা হতো। তারপর থেকে যুগে যুগে একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগজুড়ে অনুরূপ ধারা পরম্পরা সংঘটিতও হয়। বৈদিক-সংস্কৃতি বাংলা ভাষাভাষীর বিরুদ্ধে রীতিমতো অবরোধ অবস্থা আরোপ করে। সংস্কারের মাধ্যমে সংস্কৃত ভাষা রক্ষার নামে বাংলা ভাষা ও ভাষাভাষীর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু এতেই বাংলা ভাষার চর্চা থেমে থাকে নি। এমনকি এ ভাষাগোষ্ঠীর ভাবানুভবের আদান-প্রদান থেমে যায় নি। বরং প্রাকৃত জনগোষ্ঠীর ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তা ক্রমান্বয়ে সমুন্নত হতে থাকে। যুগে যুগে নানা রকম বিঘ্নবিপত্তি আশীর্বাদ রূপে এসে জড়ো হয়।

তিন.
প্রান্তিক জনশ্রেণীর ওপর অভিজাত শ্রেণীর অত্যাচারের কথা চর্যাপদে উল্লিখিত হয়। সেখানে অস্পৃশ্য অবজ্ঞাত জনশ্রেণীর চিত্রগাঁথা উন্মোচিত হতে দেখা যায়। এই অভিজাত শ্রেণিগোষ্ঠীই বাংলা ভাষার চর্চা অব্যাহত রেখেছে। যেমন-
টালত মোর ঘর নাহি পড়বেশি
হাঁড়িতে ভাত নাহি নিতি আবিশে
… … …
নিতি নিতি সিআলা সিহে সম জুঝই
অর্থাৎ টিলার ওপর আমার ঘর। হাঁড়িতে ভাত নেই, অথচ প্রতিদিন অতিথি এসে ভিড় করে। প্রতিদিন শৃগাল ও সিংহ যুদ্ধ করে। শৃগাল-সিংহের যুদ্ধের কথা বলে শোষক-শোষিতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়। চর্যাপদজুড়ে এ রকম উদাহরণ উদ্ধৃতি লক্ষ করা যায়। মধ্যযুগে বাংলা ভাষাকে পাশ কাটিয়ে ফারসি ভাষার একাধিপত্য বজায় ছিলো। মুসলমান রাজা-বাদশাহরা একসময়  ফরাসি ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। সেখানে বাংলা ভাষার চর্চা অনুশীলন খানিকটা কম ছিলো। তারপর এলো ব্রিটিশ শাসন। ইংরেজরা ইংরেজি ভাষা বিস্তারের জন্য নানামুখী সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকে। এমনকি ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে এক আদেশনামায় ইংরেজিকে রাজভাষা গ্রহণের জন্য আদেশনামা জারি করে। ইংরেজি ভাষার চর্চা, পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তি, বাংলা ভাষার ইংরেজিকরণ ইত্যকার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। তারপরে হলো পাকিস্তান রাজ্যের সূত্রপাত। সেখানেও একপ্রকার গভীর ষড়যন্ত্র লক্ষণীয়। পর্যায়ক্রমে এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষাভাষী সম্প্রদায় রুখে দাঁড়ায়। অবশেষে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এর প্রতিবাদ করে। সর্বাত্মক এ আন্দোলনের সাথে আপামর বাঙালি জনতার সমর্থন ছিল। ফলে তা এক আশ্চর্যরূপে সাফল্য লাভ করে। শুধু তাই নয়, এর মধ্য দিয়েই বাঙালির স্বাধিকার চেতনা দানা বাঁধতে শুরু করে। পরবর্তীকালে তাও বিস্ময়কর রূপে সাফল্যমণ্ডিত হতে দেখা যায়।
১৯৭১ সালে মাত্র নয় মাস যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এ আশ্চর্য সাফল্যের পেছনে বাংলা ভাষা ও ভাষাভাষী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সর্বোপরি বাংলা ভাষা অন্তর্গত দিক থেকে অপরিমেয় সামর্থ্যরে অধিকারী। এর সমূহ সম্ভাবনাও সুদূরপ্রসারী ইতিহাসের সাক্ষ্য প্রমাণ থেকেও এ কথার সত্যতা প্রমাণ করা সম্ভব। এরই ধারাবাহিকতায় এ ভাষা আরো সমুন্নত হওয়ার সুযোগ পাবে। তবে যথার্থ চর্চ্চা অনুশীলন ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে অন্যথায় তা বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যা কারোর কাম্য হতে পারে না।

ahteshamqasimesyl@gmail.com

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...