আলেম ভাষা সৈনিক-৩
সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ |
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে বাাঙ্গালির চেতনার মহানায়ক মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ একটি নাম। একটি ইতিহাস। একটি দেশ রাষ্ট সার্বভৌমত্বের মহানায়ক। আজন্ম সংগ্রামি এক সিপাহসালার। বাংলা ও বাঙ্গালীর স্বাধীকার আন্দোলনের পুরোধা। তিনি হলেন ইতিহাসের সেই প্রথম ব্যক্তি যিনি ১৯৫২সালে ২১শে ফ্রেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নুরুল আমিন সরকারের বিরোদ্ধে প্রথম সিংহের ন্যায় গর্জে উঠেছিলেন এবং পালামেন্ট থেকে ৩৫জন সদস্য নিয়ে তার নেতৃত্ব বিদ্রোহ করেন এবং তিনি গেপ্তার হন।
একুশের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আইন পরিষদে এটিই প্রথম প্রতিবাদ। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে তিনটায় পূর্ববঙ্গ পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। মাত্র ঘণ্টা কয়েক আগেছাত্রদের ওপর গুলি চালনার প্রতিবাদে অধিবেশন সেদিনের জন্য স্থগিত রাখার দাবি জানান আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। তিনিবলেন, ‘জনাব স্পিকার সাহেব, প্রশ্নোত্তরের পূর্বে আমি আপনার কাছে একটা নিবেদন করতে চাই। যখন দেশের ছাত্ররা, যারাআমাদের ভাবী আশা-ভরসাস্থল, পুলিশের গুলির আঘাতে জীবনলীলা সাঙ্গ করছে, সেই সময় আমরা এখানে বসে সভা করতে চাই না। প্রথমে ইনকোয়ারি তারপর হাউস চলবে।’ একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে এটাই ছিল আইন পরিষদে প্রথম বক্তব্য।
শুধু কি তাই! এই মাওলানা সেই মাওলানা। তিনি প্রথম বাঙ্গলী হিসেবে ১৯৫৮ সালের ১২ আগষ্ট পালামেন্টে বাংলা ভাষাতে বক্তৃতা করে বাংলার সম্মান উঁচু করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন।পাকিস্তান গণপরিষদে প্রথম বাংলায় বক্তৃতা ১৯৫২ সালের ১২ আগস্ট সব ভ্রূকুটি অগ্রাহ্য করে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলায় বক্তৃতা শুরু করেন। পশ্চিম পাকিস্তানি গণপরিষদ সদস্যরা নানা উপহাস করে এ সময় তর্কবাগীশকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু উপহাস উপেক্ষা করেই তর্কবাগীশ বাংলায় বক্তব্য দেন। বাংলায় বক্তৃতা রেকর্ড করার জন্য ওই সময় আইনসভায় কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মাওলানা তর্কবাগীশ বেশ কয়েকবার স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণের পর পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা বক্তৃতা রেকর্ড করার জন্য লোক নিয়োগ করা হয়। এর পূর্বে পাকিস্তান গনপরিষদের কোন সদস্য বাংলাতে বক্তৃতা করেননি। যারা অপরিসীম দরদ দেখিয়ে বাংলার দাবীতে পূর্ব পাকিস্তানের হাটে মাটে গ্রামে গ্রামে বক্তৃতা করে বেড়াতেন এবং বাংলার জন্য সংগামি হিসাবে খ্যাত ছিলেন এমন নেতারাও পার্লামেন্টে বাংলায় বক্তিতা দেয়ার সাহস পাননি। তেমনকি অভিবক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সরোয়ার্দী ও শেরে বাংলা ফজলুল হক গণপরিষদে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিতে লজ্জাবোধ করেছেন।
তিনি আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান পার্লামেন্টে বাংলা বক্তৃতা চালু ও বাংলা ভাষা রেকর্ড করার প্রথা চালু করে এক ঐতিহাসিক অবদান সৃষ্টি করেন ।বৃট্টিশ বিরোধি আন্দোলন থেকে ৫২র ভাষা আন্দোলন হয়ে ৭১এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন আপোষহীন এক নেতা। উড়ে এসে জুড়ে বসে নয় বরং এই মাওলানা তিল তিল করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। আমাদের ইতিহাস প্রতিমুহুর্তে বদল হয় এভাবেই আজ ইতিহাসের ছাত্রদের কাছে অপরিচিত বাঙ্গালীর অবিসংবাদিত নেতা মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবার্গীশ। ১৯১৯ সালের খিলাফত আন্দোলন, ১৯২২ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপ্নসিঁড়ি খ্যাত ঐতিহাসিক ‘সলংগ বিদ্রোহ’ এর নেতৃত্ব দেন। এরপর থেকে আজীবন বাংলা ও বাঙ্গালীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তিনি ছিলেন আপোষহীন এক বীরসিপাহসালার। বিদ্রোহী এক যুদ্ধা। মুক্তিকামি মানুষের চেতনার মহানায়ক। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন আওমী লীগের কেন্দ্রিয় সভাপতি। তার হাত ধরেই তৈরি হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতা। ৭০ এর নির্বাচনে তিনি আওমীলীগ প্রার্থী হিসাবে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ৭১এর স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি ব্যাপক জনমত তৈরির লক্ষ্যে মাটে ময়দানে জনগনকে মুক্তি সংগ্রামে উদ্ধুদ্ধ করতেন। তিনি সর্বশেষে স্বাধীন বাংলাদেশ এর জনমত তৈরির লক্ষ গঠন করেন উলামা পার্টি। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তার নাম দিয়েছিল ‘কাফের মাওলানা’। তারা তার বাড়ি ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল । এটা নিসংকোচে এবং নিদ্ধিধায় বলা চলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভুমি তৈরিতে তিনি এক মহানয়ক ও স্বপ্নদ্রষ্টা । মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবার্গীশের কাছে বাংলাদেশ ও বাংলাভাষীরা চিরকৃতজ্ঞ।