ফুজায়েল আহমাদ নাজমুল :
ভাষা এমন একটি নিয়ামত যার ফলে মানুষ সকল সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। ভাষা সম্পন্ন প্রাণী বলা হয় মানুষকে। আবার ভাষার জ্ঞানে যারা সমৃদ্ধ তারা মানুষের মাঝে শ্রেষ্ঠ। এ দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত যত জ্ঞান বিজ্ঞান মানব জাতি অর্জন করেছে সবই ভাষার মাধ্যমে করেছে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
ভাষা ছাড়া কোনো জাতি নেই। সব জাতিরই নিজস্ব একটি ভাষা রয়েছে। ঠিক তেমনি আমরা বাঙালি জাতিরও রয়েছে নির্দিষ্ট একটি ভাষা। যেটাকে আমরা মায়ের ভাষা বলে গর্ববোধ করি। রাষ্ট্রীয় ভাবে এই ভাষা প্রতিষ্ঠায় রয়েছে একটি গৌরবময় ইতিহাস। ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য আত্মত্যাগের এক অনন্য নজির স্থাপন করে বাঙালি জাতি যে পরিচয় দিয়েছিল তা পৃথিবীর আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে বিরল। বুকের তাজা লাল খুন ঢেলে মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সেদিন রাজপথে রফিক, শফিক, সালাম, বরকতসহ অনেকেই যে ত্যাগের উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তা প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে আজো উদ্বেলিত। এজন্যই বাঙালি জাতির জীবনে ২১ শে ফেব্রুয়ারী এ দিনটি বিশেষ মহিমায় ভাস্বর।
একদিক থেকে ২১ শে ফেব্রুয়ারি যেমন আমাদের জন্য বেদনাস্মৃতির তেমনি গর্বেরও। কালের পরিক্রমায় এ দিনটি আজ গোটা বিশ্ববাসীর জন্যই মাতৃভাষাকে সম্মান জানানোর উপলক্ষ। ভাষা আন্দোলনের সূত্রেই পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ইতিহাস তৈরি হয়েছে। এ পথ বেয়েই আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র তথা প্রত্যাশিত বাংলাদেশ। বাঙালির জাতীয় জীবনে তাই একুশ এক মহিমান্বিত দিন। ১৯৫২ সালের এ মাসে যেমন ভাষা রক্ষায় বাঙালিরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল; তেমনিভাবে এ চেতনা যেন সবার প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে যায় আরো বেশি; একই সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের এ শক্তিই প্রজন্মের পর প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করবে আগামী দিনেও এমনটি প্রত্যাশিত।
বছর ঘুরে এ দিবসটি আমাদের কাছে আসে। আমরা ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন, সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে সভা, সেমিনার সহ বিভিন্ন ফোরামে নানামুখী আলোচনা ও পর্যালোচনা করি। যারা লেখক তারা গঠনমূলক লিখি। জাতির অগ্রযাত্রায় এসব আলোচনা ও পর্যালোচনা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বাঙালির অসামান্য অর্জনের কথা সর্বজনবিদিত।
ভাষা আন্দোলনে আমরা বিজয়ী হয়েছি বলেই আজ দেশের কবিতা-কথাসাহিত্য-প্রবন্ধ নতুন সম্পদে ভরে উঠেছে। সাহিত্যের সে ধারা আজ বহু পত্রপল্লবে বিকশিত একটি মহীরুহের রূপ ধারণ করেছে। প্রতিবছর একুশে বইমেলায় নবীন ও প্রবীণ লেখকদের হাজার হাজার নতুন বইয়ের মোড়ক উম্মোচন হয়। আমাদের অর্জন অসামান্য হলেও আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের নানা ক্ষেত্রে কিন্তু অর্জিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে অনেক কিছুই। সর্বস্তরে যে বাংলা ভাষা প্রচলনের দাবিতে রক্ত দিয়েছিলেন বীর শহীদরা; দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজো সব ক্ষেত্রে বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয় নি। বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে- আমরা বাংলা নিয়ে গর্ব করি, কিন্তু আমরা সঠিক বাংলার ব্যবহার করতে জানি না। কিছু বাংলা, কিছু উর্দু আর কিছু ইংলিশ একত্রে করে আমরা আমাদের নিজস্ব ভাষার ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলেছি। গতবছর ভাষার মাসে টেলিভিশনের একটি নিউজে দেখলাম সাংবাদিক রাজধানীর নামিদামী স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বাংলা বারো মাসের নাম জিজ্ঞেস করছে। ছয় ঋতুর নাম জিজ্ঞেস করছে। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিবসের কথা জিজ্ঞেস করছে। বাংলা সাহিত্য নিয়ে অনেক প্রশ্ন করছে। কিন্তু অনেকেই ক্যামেরার সামনে হা করে দাড়িয়ে রইলো। সঠিক উত্তর দিতে পারলো না। দেখলাম অনেকেই সরাসরি বলেই দিলো আমি জানি না। বলতে পারবো না। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, ছাত্রছাত্রী ছাড়াও অনেকেই আছেন বাংলা বারো মাসের নামগুলো বলতে হিমশিম খেয়ে যাবেন। অথচ ইংরেজী বারো মাসের নাম সহজে বলে যেতে পারবেন।
উচ্চশিক্ষা, বিশেষায়িত শিক্ষাসহ আজ নানা ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষার প্রচলন সম্ভব হয়নি। উচ্চশিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বইপত্র প্রণয়নের কাজও খুব সন্তোষজনকভাবে এগোয়নি। আমরা লক্ষ্য করেছি- স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ইংরেজীর গুরুত্ব যে ভাবে বেশি, ঠিক তেমনি বাংলার নেই। ছাত্র ছাত্রীরাও বাংলা নিয়ে তেমন আগ্রহী দেখা যায় না। মাদ্রাসা শিক্ষায়ও সমান অবস্থা। কওমী মাদ্রাসায় আরবী আর উর্দু ভাষার গুরুত্ব যেভাবে রয়েছে ঠিক তেমনি বাংলার গুরুত্ব নেই। অনেক ছাত্ররা পরীক্ষার উত্তরপত্রে বাংলা লেখার ইচ্ছা করলেও লিখতে পারে না। কারণ সেখানে উর্দু ও আরবীকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়।
আমাদের অফিস-আদালতে আজো বাংলা ভাষার অধিকার স্বীকৃত হয়নি। এটা আমাদের মহান ত্যাগের সার্থকতাকে রুদ্ধ করেছে। ফলে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের যথাযথ দৃষ্টি দেয়া উচিত বলেই মনে করি।
যে ত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে আজ সারা বিশ্ব এ দিনটিকে পালন করছে; অথচ মায়ের ভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ রক্ত দিল, প্রাণ দিল, সে দেশেই আজ বাংলার সর্বত্র প্রচলন নেই, এটা আমাদের জন্য দুঃখ ও লজ্জার ব্যাপার্। সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে আমরা অন্য দেশের ভাষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল দেশের সর্বত্র গড়ে উঠেছে। আগামী প্রজন্মের মানুষগুলো এ থেকে কতটুকু বাংলা শিখতে পারবে তা ভাবার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।
একুশ আসলেই যদিও বিভিন্ন ভাবে আমরা বাংলার প্রতি সম্মান জানাই কিন্তু সত্যিকারার্থে আমরা বাংলা চর্চায় অনেক পিছিয়ে একথা সবাইকে মেনে নিতে হবে। দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক থেকে নিয়ে নিম্ন শ্রেনী পর্যন্ত আজ অবহেলিত আমার মায়ের ভাষা। মনে রাখতে হবে, ভাষা মানুষের সাংস্কৃতিক বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভাষার উদ্ভব ও তার বিকাশের পরিপূর্ণতা আমাদের মানবসভ্যতায় বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। তাই সভ্যতার ক্রমবিকাশে ভাষাকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। বাঙালির জাতীয় বিকাশ ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে একুশের চেতনা তখনই এ জাতিকে এগিয়ে নেবে যখন সত্যিকারার্থে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে সর্বক্ষেত্রে। এ ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আমাদের যেমন সচেষ্ট থাকতে হবে; তেমনি মাতৃভাষার চর্চা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নিতে হবে রাষ্ট্রকে।
একটি সত্য সুন্দর আলোকোজ্জ্বল বাংলাদেশ গড়তে নতুন প্রত্যয়ে ভাষার চেতনা ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে এই প্রত্যাশা আজকের এই মহান একুশে।