কুতায়বা আহসান :
– খাইরুদ্দীন বারবারুসা দুইদিন তাঁর নৌবহর নিয়ে সাগরের বুকে ভেসে বেড়ান। এর পরবর্তী মধ্যরাতে সর্বধ্বংসী তুফানের বেগে ক্ষুধার্ত সিংহের গর্জন তুলে পানুনের দিকে অগ্রসর হন। কারণ তাঁর গোয়েন্দারা সংবাদ দিয়েছিল— হিস্পানিয়া থেকে যে রসদ এসে পৌঁছার কথা তা পানুনে এসে পৌঁছে গেছে।
– খাইরুদ্দীন দুদিন ধরে এ সংবাদটির জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। সংবাদপ্রাপ্তির পর রাতের মধ্য প্রহরে তাঁর ধ্বংসের বার্তাবাহী নৌবহরটি নিয়ে পানুনের উপকুলে লঙ্গর ফেলেন। তিনি প্রথমেই হিস্পানীয়া থেকে আগত নৌবহরটির উপর চড়াও হন। নৌবহরে যে সমস্ত মাল্লা ঘুমন্ত ছিল তাদেরকে চিরঘুমের রাজ্যে পাঠিয়ে দেন। এরপর জগৎপ্লাবী সয়লাবের গতিবেগে অাক্রোশের বিরতীহীন আঘাতে পানুনের প্রতিরক্ষাবাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়েন। যেহেতু ইতোমধ্যেই পানুনের প্রতিরক্ষায় হিস্পানীয় সৈন্য সহায়তা এসে পৌঁছে গিয়েছিল তাই পানুনের নিরাপত্তাব্যবস্থা আগের থেকে মোটামোটি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু খাইরুদ্দীন বারবারুসার আক্রমণ এতোটাই অতর্কিত ছিল যে, ওরা নিজেদের সামলে নেয়ার আগেই অনেকটা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।
– তারপর পানুন অধিপতি ডনমার্টন তার রিজার্ভ বাহিনীকে সাথে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। সে প্রতিআক্রমণে চলে আসে। কিন্তু ধ্বংসাসী স্রোতকে কি বালির বাঁধ আটকে রাখার সামর্থ রাখে? প্রবল ঘূর্ণির ঝাপটাকে কি বাঁশের খুঁটি সামলাবার ক্ষমতা রাখে? ডনমার্টনের কোনো প্রয়াসই হালে পানি পাচ্ছিল না। বারবারুসার তীব্র আক্রমণের মুখে তার বাহিনী খড়কুটোর মতো উড়ে যাচ্ছিল। আকাশের মৌন প্রহরী তারকারাজিরা দেখতে পাচ্ছিল— সময় যত যাচ্ছে বারবারুসার সৈন্যদের মধ্যে বাহাদুরি, জোশ ও জযবা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে চলছে।
– বারবারুসার সাথীরা সাইমুমের তীব্রতায়, ইরামধ্বংসী স্রোতের তাণ্ডবলীলায়, জলোচ্ছ্বাসে ফুঁসে ওঠা আকাশ উঁচু ডেউয়ের ধ্বংসলীলায় একেরপর এক পানুনের প্রতিরক্ষাবাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে তাদেরকে রক্তের গোসল করাচ্ছিলেন।
– খাইরুদ্দীন বারবারুসার আক্রমণ দেখে মনে হচ্ছিল— মাটিকে তুফানের পিঠে সওয়ার করে হাস্যোজ্জ্বল সূর্যের চেহারাকে চিন্তাক্লিষ্টের ম্লানিমা এনে দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল অাঁধারের উপসাগরে শত সহস্র তারকারাজির চাদর পরাচ্ছিল। অনেক্ষণ ধরে পানুন দ্বীপে জীবন দেয়া-নেয়ার খেলা চলতে লাগল। সেই খেলায় মাতাল উর্মিমুখর সমুদ্র যেভাবে সৈকতের অবস্থা আমূল বদলে দেয় বারবারুসা-বাহিনীও সেভাবে পানুনের চেহারাটা বদলে ফেলেন।
– পানুনের বেঁচে যাওয়া প্রতিরক্ষা বাহিনী যখন অনুভব করতে পারল এ ঝড়ের মোকাবেলা করতে যাওয়া মানে শুধু শুধু মৃত্যুকে ডেকে আনা, সুতরাং তারা হতোদ্যম হয়ে অস্ত্র সমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়।
– দ্বীপে হিস্পানীয়দের যে পরিমাণ সৈন্য ছিল তাদেরকে নিরস্ত্র করে নিরাপত্তার খাতিরে বন্দী করে নেয়া হয়। দ্বীপে যে মজবুত কেল্লার ভেতর তাদের রসদ ও অস্ত্রপাতি ছিল বারবারুসাবাহিনী দ্রুত সেগুলো তাঁদের নৌবহরে তুলে নেয়। এরপর মিনজানিকের মাধ্যমে পুরো কেল্লাটা এমনভাবে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় যে, নবাগত কোনো লোকই কল্পনাও করতে পারবে না— এখানে একসময় মজবুত একটা কেল্লা ছিল।
– খাইরুদ্দীন বারবারুসা আক্রমণের আগেই দ্বীপের চারপাশে ছোট ছোট নৌকার মাধ্যমে তাঁর গোয়েন্দাদের ছড়িয়ে রেখেছিলেন। যেন মুনকিড বা স্পেনের দিক থেকে কোনো সাহায্যকারী টিম পানুনের দিকে আসতে দেখলে তাঁকে সাথে সাথে জানানো হয়।
– অভিযান থেকে ফারেগ হবার পর খাইরুদ্দীন বারবারুসা কয়েদিদের এক জায়গায় জড়ো করেন। এরপর এদের মাধ্যমে কেল্লা ও কেল্লার ভেতরকার ইমারত সমূহের ধ্বংসাবশেষ সাগরে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এভাবে সাগরে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ একটা প্রতিকী সড়ক তৈরি হয়ে যায়। এতে পানুন দ্বীপ থেকে আফ্রিকার উপকুল অনেকটা নিকটবর্তী হয়ে ওঠে।
– দ্বীপের কাজ শেষ করে খাইরুদ্দীন বারবারুসা স্পেন থেকে আগত নৌবহরটিকে তাঁর নৌবহরের সাথে একীভূত করে নেন।
– ইতোমধ্যে আফিকার শাসক মুনকিড জানতে পারে যে তাদের গুরুত্বপূর্ণ পানুন দ্বীপ খাইরুদ্দীন বারবারুসা কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছে। সুতরাং সে কালবিলম্ব না করে তড়িৎ একটা নৌবহর পানুনের সহায়তায় পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু খাইরুদ্দীন বারবারুসা সে নৌবহরটির যে অবস্থা ঘটিয়েছিলেন একযুগ পর্যন্ত তা মানুষের জন্য হাস্যরসের উপকরণ হয়ে থাকে।
– ঘটনা ছিল এই— মুনকিড কর্তৃক প্রেরিত সাহায্যবাহী নৌবহরটি পানুনের কাছে এসেও দ্বীপে নোঙর ফেলছিল না। কারণ তারা পানুনকে চিনতেই পারছিল না। খাইরুদ্দীন বারবারুসার আক্রমণ এতোটাই তীব্র ছিল যে, তা পানুনের আকারই বদলে দিয়েছিল। তারা জাহাজের মাস্তুলে চড়েও দ্বীপে কোনো অবকাটামোর অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছিল না। তদুপরি সাগরে দীর্ঘ একটা সড়ক দেখে তারা হতবাক হয়ে পড়েছিল।
– কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুনকিডবাহিনী যখন দীর্ঘ ঐ সড়কটি পর্যবেক্ষণের জন্য ওদিকে এগিয়ে গেল তখন কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা নিজেদেরকে খাইরুদ্দীন বারবারুসার নৌবহর দ্বারা ঘেরাওকৃত হিসেবে আবিস্কার করতে পারলো।
– আতঙ্কিত মুনকিড বাহিনী আক্রমণে এসে একদিকে পালিয়ে যাবার পথ সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তাদের সে অভিপ্রায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। বারবারুসার লৌহকঠিন ঘেড়াও ভেদ করে তাদের পক্ষে পথ বের করে নেয়া সম্ভব হলো না। বেশ কিছুক্ষণ ভয়ঙ্কর লড়াই চলার পর ক্রমশ তাদের উপর পরাজয়ের ছায়া বিস্তৃত হতে লাগলো। একসময় সে ছায়া তাদের পুরো নৌবহরের উপর ছেয়ে গেল। বারবারুসা বাহিনী দ্রুত বেঁচে যাওয়া সৈন্যদের বন্দী করত জাহাজগুলোকে নিজেদের নৌবহরের সাথে একীভূত করে নেন।
– মুনকিডের নৌবহরটি কব্জা করার পর বারবারুসা ঝড়ের তাণ্ডব নিয়ে আলজেরিয়ার উপকুলের দিকে অগ্র্রসর হন। এরপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে উপকুলের বিস্তৃত অঞ্চলে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নেন।
– স্পেন সম্রাট কখনোই এটা বরদাশত করতে পারছিল না যে, খাইরুদ্দীন আলজেরিয়ায় তাঁর ঘাঁটি গেড়ে নিন। কারণ এখান থেকে আফ্রিকার সাথে অতি সহজে যোগাযোগ রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ জাবালুত্তারিক প্রণালিটি ছিল একেবারে কাছে। বারবারুসা যদি কোনোক্রমে একবার আলজেরিয়ায় তাঁর অবস্থান গড়ে তুলে নেন তাহলে তাদের সেই গুরুত্বপূর্ণ প্যাসেজটি হুমকির মুখে পড়ে যাবে। এ ছাড়া নতুন দুনিয়া থেকে স্পেনের জন্য আগত মূল্যবান সম্পদবাহী জাহাজগুলোর জন্য বারবারুসা আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠবেন।
– সাগরের দূরন্ত ঈগল খাইরুদ্দীন বারবারুসাও দখলকৃত এ অঞ্চল হাতছাড়া করতে চাইছিলেন না। উপকুলের পাশ ঘেঁষা ফসলের ও সবুজের সমারোহে পরিপূর্ণ পাহাড়শ্রেণীর পাশাপাশি কোনো এককালের সৌখিন বাদশাহ কর্তৃক তৈরি মজবুত ও নয়নাভিরাম কেল্লা স্থানটির প্রতি তাঁর আকর্ষণ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। খাইরুদ্দীন তাঁর অবস্থানের জন্য একটা শাহী বালাখানা বেছে নেন। বালাখানার পাশেই ছিল ঘণ সন্নিবিষ্ট একটি বিশাল খেজুরের বাগান। বাহানটির মনোরম দৃশ্য কেবল বারবারুসাকেই নয় তাঁর পুরো বাহিনীর লোকজনকেই চমৎকৃত করে দিয়েছিল।
– আলজেরিয়ার এই নতুন অঞ্চল কব্জা করার পর বারবারুসা সেখানে স্পেন থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা আরবদের সেখানে আবাদ করার বন্দোবস্ত করেন। বিশেষ করে সেই আরবদের যারা ছিল বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্মে অভিজ্ঞ। খাইরুদ্দীন বারবারুসা মূলত ওখানে এক নতুন স্পেন গড়ে নিতে চাইছিলেন।
– আলজেরিয়ার এ অঞ্চলে বারবারুসার উপস্থিতি ছিল স্পেন সম্রাট চার্লসের জন্য বিরাট মাথাব্যথার কারণ। কারণ খাইরুদ্দীনের হাতে এ অঞ্চলটা চলে আসার পরপর তাদের অধিকৃত এলাকা ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসছিল। সুতরাং চার্লস খাইরুদ্দীনকে ওখান থেকে তাড়ানোর জন্যে জেনেভা থেকে সামুদ্রিক যুদ্ধে অতিদক্ষ একজন এডমিরালকে ডেকে নিয়ে আসে। তাদের বিশ্বাস মতে ঐ এডমিরাল ছিল সামুদ্রিক যুদ্ধে অপরাজেয়। তার নাম ছিল আন্দ্রে ডুরিয়া।
– স্পেন সম্রাট বিশাল একটি নৌবহর ঐ এডমিরালের হাওয়ালা করে দিয়ে বলে আমি জীবিত অথবা মৃত বারবারুসাকে এখানে দেখতে চাই। তোমাকে বিশাল নৌবহর বিপুল সৈন্য ও সমরাস্ত্র দেয়া হলো। যদি আরো কিছুর প্রয়োজন থাকে তাহলে আমাকে বলতে পারো। তবে যে কোনো মূল্যে তোমাকে খাইরুদ্দীনকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসতে হবে।