কুতায়বা আহসান :
মা‘আয ঘোড়ার কাছে আসতে আসতে নিজেকে অনেকটা সামলিয়ে নিয়েছিল। সে তার ঘোড়ার বাগ ধরে বোন নাবিলের প্রতি না তাকিয়েই বলল:
আপি! ‘চলুন আগে জাবির বিন মুগীছ দাদুর কাছে যাই। বাসিত চাচার কাছে তাঁর জন্যে আনিত খাবার রয়েছে। খাবারটা তাঁর কাছে পৌঁছে যাই’। নাবিল এতক্ষণ চুপচাপ মা‘আযকে দেখে যাচ্ছিল। মা‘আয যখন তার ঘোড়ায় বসল তখন নাবিল এবং বাসিতও তাদের ঘোড়ার সামলিয়ে তার পিছনে পিছনে চলা শুরু করে দিল।
তারা তিনজন জাবির বিন মুগীছের ঝুপড়ির পাশে এসে থেমে গেলে। বাসিত তাদের সবার ঘোড়ার রাগাম ধরে রইলেন। আর মা‘আয খাবারের গাঠুরি নিয়ে ঝুপরির ভেতর চলে গেল। নাবিলও তার পেছনে পেছনে সেখানে ঢুকে গেল।
জাবির বিন মুগীছ তখন চাটাইয়ের উপর বসে চিন্তার সাগরে হারিয়ে গিয়েছিলেন। মা‘আযকে ঝুপরিতে ঢুকতে দেখেই প্রীতকন্ঠে বললেন:
এসো বোন! আমার কান, আমার শ্রবণ শক্তি তোমার আওয়াজের সাথে এতোটাই পরিচিত হয়ে উঠেছে যে, তোমাকে না দেখেও আমি বলে দিতে পারবো তুমি এসেছো। আর তোমাদের সাথে মুহাব্বাতের ব্যাপারটা কী বলবো— মনে চায় সব সময় তোমাদের আমার পাশে পাই। কোনো দিন যদি তোমরা আসতো না পারো তাহলে আমি কী অস্বস্তির মধ্যে দিন আর রাত পার করি তা বলে বুঝাতে পারবো না। এসো তোমরা উভয় বোন আমার পাশে এসে বসো!
মা‘আয জাবির বিন মুগীছের একদিকে আর নাবিল আরেক দিকে বসে পড়ল। মা‘আয তার হাতের খাবারের গাটুরি একপাশে রাখতে রাখতে বলল:
‘দাদু! দয়া করে বলুন! এবার কি আপনার নাতি হাসান ক্রুসু আপনার কাছে এসেছিলেন?
মা‘আযের এ প্রশ্নটা শুনে জাবির বিন মুগীছের অবস্থা আমূল বদলে গেল। তাঁর চেহারায় উদাস ভাব ফুটে উঠল। চোখের ভ্রু যেন বিষন্নতার তুফানে কাঁপতে লাগলো। তিনি ঘাড় নিচিয়ে চিন্তায় ডুবে গেলেন। এরপর বলতে শুরু করলেন:
‘আমার বোন সে কওমের এক মহান কাজ নিয়ে ধুমকেতুর গতিতে আফ্রিকা থেকে আল বাশারাতের উপকুলে এসেছিল এবং কাজ শেষে উল্কার বেগে চলে গেছে। তা ছাড়া সে আমার কাছে আসবেই কীভাবে! আমি তো তাকে তার মা বোনকে খুঁজে বের না করে আমার কাছে আসতে বারণ করে রেখেছি’।
জাবির বিন মুগীছের দিকে তাকিয়ে মা‘আয প্রায় কান্নাবিজড়িত আনুযোগের কন্ঠে বলতে লাগল:
‘দাদু! আপনি হাসানের উপর এমন অত্যাচার করছেন কেন? আপনার খেয়ালে কি কখনো এ কথাটা আসে না যে, আপনার নাতি মিল্লাতের এক আযীম ফরযন্দ, আমাদের মতো অথর্বদের স্বপ্নপুরুষ খাইরুদ্দীণ বারবারুসার দক্ষিণ হস্ত? তা ছাড়া আপনি তো আজও দেখলেন আপনার নাতি কত মহান কাজে জানবাজি রাখছে। কত অসহায় ভাগ্যবিড়ম্বিত মুসলমানকে আজ সে শান্তির ঠিকানায় পৌঁছে দিচ্ছে’?
জাবির বিন মুগীছ কতক্ষণ উদাসভাবে নীলব বসে রইলেন। এরপর অশ্র“সজল চোখে ধরাগলায় বলতে লাগলেন:
‘বোন! আমি চাই না আমার নাতি আমার পাশে থেকে পাথরের মতো জড় হয়ে যাক। আমি শুরু থেকেই চাইছি আমার নাতি যেন কওমের কল্যাণের লক্ষে অশান্ত মৌজের মত সর্বক্ষণ শত্রুর উপর আছড়ে পড়ে। সে যেন মিল্লাতের সুন্দর ভবিষ্যত বিনির্মাণের লক্ষে সব বাধা ভেঙে এগিয়ে চলা সয়লাবের মতো হয়। আমার সৌভাগ্য হাসানকে নিয়ে আমার স্বপ্ন বাস্তব হতে চলেছে। সে এমন লোকদের সঙ্গ গ্রহণ করে নিয়েছে যাদের অনুভবের বিশাল ব্যাপ্তিতে শত শত সমুদ্রও ডুবে যেতে পারে।
‘বোন! আমি বুড়ো হয়ে গেছি। আমি নিজেও জানি— আমাকে এখন জীবন নিয়ে চলতে হলে হাসানের মতো শক্তিমান হাতের সহায়তার সহায়তার প্রয়োজন। কিন্তু আমি চাই না হাসান আমার বার্ধক্যের লাটিতে পরিণত হোক। আমি আমার কষ্টকে মিল্লাতের সুখের লক্ষে উৎসর্গ করে দিয়েছি’।
‘হাসান যখন ছোট ছিল তখন থেকেই আমি তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম আমার নাতিটা হবে শত্রুর উপর অতর্কিত আক্রমণ করে তাদেরকে কিয়ামতের বিভিষিকা প্রদর্শনকারী। কওমের শত্রুদেরকে সমূলে উৎপাটনকারী। মিল্লাতের বিরুদ্ধে প্রজ্জ্বলিত আগুনের উপর শান্তির প্রপাত বর্ষণকারী। আমি প্রথম থেকেই চাইতাম হাসান হবে এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। আমি আজ চূড়ান্ত খুশি ও সুখি যে আমার নাতি মিল্লাতের জন্য নিবেদিত প্রাণ আযীম ইনসান কাইরুদ্দীণ বারবারুসার অন্তরঙ্গ সাথী। এটা আমার সৌভাগ্য। এটা আমার গর্বের কারণ’।
জাবির বিন মুগীছ তাঁর কথা বলে থামতেই মা‘আয গভীরভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর বলতে শুরু করল:
‘তাহলে কি আপনি জেনে শুনেই এই শর্তারোপ করেছেন যে, তিনি যেন তাঁর মা বোনকে খুঁজে বের না করা অবধি আপনার কাছে না আসেন? আসলে আপনি গরম লোহার শিক দিয়ে তার শরীরটা দাগিয়ে দেবেন?
জাবাবে জাবির বিন মুগীছ দীর্ঘ একটা হতাশ্বাস ছেড়ে বলতে লাগলেন:
‘বোনরে! তোমার ধারণা ঠিক। আমি যদি তার সাথে এমন কঠোরতা অবলম্বন না করতাম তাহলে সে পথ হারিয়ে ফেলতো। সে তখন মিল্লাতের চিন্তা ছেড়ে আমার মতো এক অথর্বকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। আমি ধমক দিয়ে মূলত তাকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখতে চেয়েছি। এতে আমার উদ্দেশ্যটা হলো সে যেন তার পুরো ক্ষমতা, সকল চিন্তা মিল্লাতের কল্যাণকামনায় নিবেদন করে। আরএটাই আমার কামনা। এতেই রয়েছেআমার আত্মার প্রশান্তি।
এ পর্যন্ত বলে জাবির বিন মুগীছ কিছুটা বিরতী নিলেন: এরপর রহস্যভরা কন্ঠে বললেন: আচ্ছা বোন! এবার তুমি আমাকে বলো— এতো গভীর একাগ্রতার সাথে হাসান ক্রুসুর ব্যাপারে তুমি খুজ নিচ্ছ কেন? তুমি কি ইতোপূর্বে তার সাথে সাক্ষাত করেছো? তার সাথে কি তোমার কথনো মুলাকাত হয়েছে? প্রশ্নটা শুনে মা‘আযের ঘাড় ঝুকে পড়ল। সে মুখে কিছু বললো না, কেবল মাথা ঝাকিয়ে নেতিবাচক উত্তর প্রদান করলো। তবে তার চেহারায় হঠাৎ করে যেন অস্তগামী সূর্যের রালিমা ছড়িয়ে পড়ল।
জাবির বিন মুগীছ বললেন: তুমি বলছো তাকে তুমি দেখনি! কিন্তু তারপরও তার ব্যাপারে তোমার এতো কৌতূহল কেন? এরপর তিনি স্মিত হেসে বললেন: তাহলে কি তুমি না দেখেই আমার সমুদ্র ঈগলকে ভালোবাসতে শুরু করেছো? মা‘আযের চেহারা অধিকতর রক্তিম হয়ে উঠল। সে জাবির বিন মুগীছের কথার কোনো জবাব না দিয়ে কম্পিত কন্ঠে বলতে লাগলো:
‘দাদু! আমি আপনার সময় নষ্ট করে ফেলছি। আপনার খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন। এ কথা বলেই সে দ্রুত সেখান থেকে উঠে দাঁড়ালো। নাবিলও তার সাথে উঠে গেল।
ঝুপরি থেকে বেরিয়ে আসতেই নাবিল একটু এগিয়ে মা‘আযকে জাপটে ধরে অত্যন্ত আনন্দঝরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল:
‘মাআয! আমার প্রিয় বোন! ঘোড়ায় চড়ার আগে তুই আমার এ প্রশ্নের জবাবটা দে যে, তুই দাদুর প্রশ্নের উত্তর দিলি না কেন?
জবাবে মা‘আয কোনো কথা না বলে, নিজেকে বোনের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা না কলে নীরবে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল। নাবিল এ অবস্থা দেখে তাকে ঝাকি দিয়ে বলল:
‘মা‘আয আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছি চুপ থাকার জন্য নয়। আর চুপ থাকাটা আমার এ প্রশ্নের উত্তরও নয়। আমি তোমার কাছ থেকে স্পষ্ট কিছু শুনতে চাই। তুমি যদি হাসান ক্রুসুকে নিয়েই স্বপ্ন দেখতে থাকো, তাকে না দেখেই ভালোবাসতে শুরু করে থাকো তাহলে বল। ভালোবাসার কথা বলতে লজ্জার কী আছে। অন্তত আমার কাছে?
মা‘আযের দৃষ্টি তবুও মাটি অভিমুখী পড়ে রইল। তবে তার কন্ঠ দিয়ে ক্ষীণ শব্দে উচ্চারিত হতে লাগলো—
‘আমার আপু! মুহাব্বাত আর ভালোবাসা কাকে বলে তা এখনও আমি জানি না। আমি কেবল এতটুকু অনুভব করতে পারি তাকে ছাড়া হয়ত আমি জীবিত থাকতে পারব না। এ কতা বলেই সে এক ঝটকায় নাবিলের হাত থেকে নিেেজকে মুক্ত করে তার ঘোড়ায় চড়ে বসল। নাবিল ও তার সাথে সাথে নিজ ঘোড়ায় উঠে গেল। এরপর বাসিতকে সাথে নিয়ে তারা নিজেদের বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।