শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ৪:৪৮
Home / ইতিহাস ঐতিহ্য / সমুদ্র ঈগল ১১-১২

সমুদ্র ঈগল ১১-১২

কুতায়বা আহসান :

সমুদ্র ঈগল ১১
কাহতানি কবীলার সরদার স্ত্রী মাইসুনা, কন্যা নাবিল ও মা’আয এবং পুত্র মুগীরা বিন কাব কে নিয়ে সকালের খাবার থেকে সবে মাত্র ফারেগ হয়েছেন। মুগীরা তার বোনদের উদ্দেশ্য করে বললেন:
– মা’আয নাবিল! আমি আজ ঘোড়া দৌড়ানোতে তোমাদের সঙ্গ দিতে পারছি না। বাসিত চাচাকে নিয়ে তোমরা চলে যাও।
– নাবিল আর মা’আয উঠে যাচ্ছিল। ইতোমধ্যে মুগীরা তার পিতাকে লক্ষ করে বলল:
– আব্বু! আজ রাতে আমাদের হাবেলিতে বেশ ক‘জন মানুষের আওয়াজ শুনতে পেলাম। একবার ইচ্ছে করেছিলাম উঠে দেখব কারা এসেছেন, কেন এসেছেন, কিন্তু প্রচণ্ড ঘুম আমাকে কাতর করে ফেলায় আর উঠে আসতে পারিনি। ওরা কারা ছিল আব্বু?
– ‘বেটা আফ্রিকা থেকে ক‘জন সম্মানিত মেহমান এসেছিলেন। এরা কিছুক্ষণ আমাদের হাবেলিতে অবস্থান করেছিলেন। তুমি বোধহয় তাদের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছো।
– মুগীরা কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো আফ্রিকা থেকে এসেছিলেন? সেখানে আমাদের পরিচিত কেউ আছে আব্বু?
– কাব বিন আমির মুগীরাকে লক্ষ করে বললেন: বেটা! আফ্রিকা থেকে আজ রাতে আমাদের আজীম মুহসিন খাইরুদ্দীন বারবারুসার দুই সাথী হাসান ক্রুসু এবং কাকাদ এসেছিলেন।
– মা‘আযরা তখনো ঘর থেকে বেরিয়ে যায় নি। পিতার কন্ঠে হাসান ক্রুসু নামটা উচ্চারিত হতেই সে কৌতূহতলী হয়ে ওঠে এবং সেখানেই তার পা দুটি থমকে যায়। এরপর সে পুনরায় পায়ে পায়ে ঘরে ঢুকে তার পিতার সামনে চলে আসে। মা‘আযের দেখাদেখি নাবিলও চলে আসে। মা‘আয পিতাকে লক্ষ করে বলে: আব্বু! আপনি বললেন: খাইরুদ্দীন বারবারুসার সাথী হাসান ক্রুসু এবং কাকাদ আজ রাতে আমাদের হাবেলিতে এসেছিলেন? সত্যিই কি তারা এসেছিলেন?
– কাব বিন আমীর মুচকি হেসে বললেন: হ্যাঁ মা! তারা উভয় এসেছিলেন।
– মা‘আয তখন অনুযোগভরা কন্ঠে বলল: আব্বু আপনি না বলেছিলেন ওখান থেকে কেউ আসলে আমাকে তাঁদের সাথে সাক্ষাত করতে দেবেন? এরা তো সেই মর্দে মু‘মীন, যাদেরকে একনজর দেখাও পূণ্যের এবং সৌভাগ্যের কাজ বলে আমি মনে করি। আফসুস! আপনি যদি আমাকে জাগিয়ে দিতেন! ইশ! যদি আমি তাঁদের দেখা পেতাম। আব্বু! তারা কি রাত আমাদের হাবেলিতে ছিলেন? এখন তাঁরা কেথায় আছেন?
– মেয়ের পক্ষ থেকে উপুর্যুপোরি প্রশ্ন শুনে কাব গম্ভীর কন্ঠে বললেন:
– বেটি! আমি তাঁদেরকে রাতে আমাদের হাবেলিতে অবস্থানের জন্য অনেক অনুরোধ করেছি। অনেক পীড়াপীড়ি করেছি। কিন্তু সময় সংক্ষিপ্ততার কারণে তাঁরা আমাকে সে সুযোগ দিতে পারেন নি। আমাদের বস্তির মুনযির বিন যুবাইরও তাঁদের সাথে ছিলেন। তিনি তাঁদের পূর্বপরিচিত। তাঁর সাথেও জরুরী কাজ ছিল বিধায় তারা তাঁর ওখানে চলে গিয়েছেন এবং রাতটা তাঁর ওখানেই কাটাবেন বলে জানিয়েছেন’।
– মা‘আয চমকে উঠে বলল: আব্বু আপনার যদি অনুমতি থাকে তাহলে আমি মুনযির চাচার ওখানে গিয়ে তাঁদের সাথে সাক্ষাত করতে চাই’।
– কাব বিন আমির মুচকি হেসে বললেন: যাও মা! এ ব্যাপারে আমার অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন নেই। তোমার উপর আমার পরিপূর্ণ আস্থা রয়েছে। আমিও মনে করি মিল্লাতের এমন জানবায মুজাহিদদের সাথে সাক্ষাত করতে পারা সত্যিই সৌভাগ্যের ব্যাপার।
– মা‘আযের তর সইছিল না। অন্য সময় হলে সে তার পিতার এ কথার পিঠে অবশ্যই কথা বলত। কিন্তু এবার সে কোনো কথা না বলে দ্রুত পিছন ফিরে সেহেনে বেরিয়ে আসলো। এরপর দ্রুতপায়ে আস্তাবলের দিকে দৌড় লাগালো। মা‘আযের দেখা দেখি নাবিলও তার পিছনে পিছনে দৌড়াতে শুরু করেছিল।
– দুই বোনকে দৌড়ে আস্তাবলের দিকে যেতে দেখে বাসিতও সেদিকে দৌড় লাগালেন। এরপর তিনটি ঘোড়া হাবেলি থেকে বেরিয়ে দ্রুত মুনযির বিন যুবাইরের বাড়ির দিকে দৌড়াতে লাগলো।

সমুদ্র ঈগল ১২
– রাখাল মুনযির বিন যুবাইরকে তারা বাড়িতে পায়নি। কারণ তিনি তাঁর ভেড়া বকরির পাল নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
– মা‘আযরা জানতো তিনি কোথায় তার বকরির পাল চড়িয়ে থাকেন। সুতরাং তারা দ্রুত তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে শালির পাহাড়ের পাদদেশের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। মুনযিরের কাছে এসেই মা‘আয একলাফে ঘোড়া থেকে নেমে দৌড়ে তাঁর কাছে গিয়ে কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলতে লাগলো:
– ‘চাচা! মুহতারাম খাইরুদ্দীন বারবারুসার অন্যতম দুই সাথী হাসান ক্রুসু এবং কাকাদ— যারা আজ রাত আপনার ঘরে অবস্থান করেছিলেন তাঁরা এখন কোথায়? আমরা আপনার বাড়ি হয়ে এসেছি, সেখানে তাঁদের পাইনি। মুনযির অত্যন্ত মুহাব্বাত-ঝরা কন্ঠে বললেন:
– ‘মা হিস্পানিয়ার ভাগ্যবিড়ম্বিত যেসব মানুষকে তোমার পিতা আর সাদ বিন সালামা নানাভাবে সহায়তা দিয়ে সাগর উপকুলের জেলে পল্লীতে নিয়ে রেখেছিলেন, হাসান ক্রুসুরা তাদেরকে আফ্রিকায় নিয়ে যাবার জন্য এসেছিলেন। তাঁরা আমার এখানে রাত যাপন করেছেন সত্য, তবে খুব ভোরে সূর্য উঠার আগেই আমার এখান থেকে বেরিয়ে গেছেন। তাঁদের খুব বেশি তাড়া ছিল বিধায় সকালের নাস্তা না করেই বেরিয়ে গেছেন। তাঁরা যত দ্রুত সম্ভব সাহিলে জড়ো হওয়া হতভাগা মুসলমানদের নিয়ে আজই আফ্রিকায় চলে যেতে চান।
– মা‘আয আর কোনো প্রশ্ন না করে সেখান থেকে তার ঘোড়াকে সাহিল অভিমুখে হাঁকিয়ে দেয়। যেতে যেতে মুনযির বিন যুবাইরকে দ্রুততার সাথে বলে: ‘আমরা তিনজন সেখানে যাচ্ছি। হতে পারে এখনও তারা সেখানে আছেন। এমন হলে আমরা তাঁদের মোলাকাতের সৌভাগ্য অর্জন করতে পারবো।
– নাবিল এবং বাসিতও মা‘আযের পিছনে পিছনে ঘোড়া দৌড়াচ্ছিল। একসময় তারা তিনজনই উপকুলে জেলেদের বস্তিতে এসে উপস্থিত হলো। ওখানে এসেই মা‘আয ঘোড়া থেকে নেমে পায়ে হেটে অগ্রসর হচ্ছিল। এরপর সামনে প্রথম যে ব্যক্তিটিকে পেল তাকে লক্ষ করে বললো:
– ‘মুহতারাম! আমি কাহতানী সর্দার কা‘ব বিন আমিরের কন্যা।
– লোকটি তাকে কথা পূর্ণ করতে না দিয়ে বলল: বেটি! আমি তোমাকে। ভলোবাবেই জানি চিনি। আমাকে তোমার পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন নেই। আমি জানি তোমার নামা মা‘আয। তোমার পিছনে রয়েছে তোমার বড়বোন নাবিল। আর তোমাদের সাথে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে রয়েছে তোমাদের গোলাম বাসিত। এবার বল তুমি কী জানতে চাও?
– আমি আপনার কাছে কেবল এ টুকুই জানতে চাই— হিস্পানিয়ার অসহায় মুসলমানদের আফ্রিকায় নিয়ে যাবার জন্য সেখান থেকে যে ক‘জন লোক এখানে এসেছিলেন তাঁরা কি এখনও এখানে আছেন নাকি চলে গিয়েছেন।
– লোকটি কিছুটা দরদমাখা কন্ঠে বললেন: বেটি তোমরা আসতে দেরি করে ফেলেছো। তারা তো বেশ পূর্বেই এখান থেকে চলে গেছেন। কথাটা বলেই লোকটি অন্য দিকে চলে গেলেন।
– তাঁর কথা শুনে মা‘আযের অবস্থাটা কেমন জানি হয়ে গেল। তার অন্তরে যেন আক্ষেপের প্রচণ্ড ঢেউ আঘাত হানতে লাগলো। তার চোখে অশ্রু এসে গিয়েছিল। এক অবোধ্য হতাশা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। ভেতরে যেন বেদনার ধুঁয়া উঠতে লাগলো। তার চেহারায় যেন পরাজিতের ভাব ফুটে উঠল। যেন কেউ সেখানে এক মুটি কাদা লেপ্টে দিয়েছে। সে ওখানে দাঁড়িয়ে হতাশ চাহনি মেলে নীল সাগরের দিকে তাকিয়ে রইল।
– সে দেখতে পাচ্ছিল সাগরের নীল জলরাশিতে ফুঁসে ওঠা মৌজ যেন তার দীলের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ফিরে যাচ্ছে।
– মা‘আয কিছুক্ষণ আজীব ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সাগরের দিকে তাকিয়ে রইল এরপর সগতোক্তির মতো বলতে লাগলো:
– ‘হায় কোনো দরদী যদি এই রহস্যটা আমার সামনে উন্মোচন করে দিত যে, কওমের আযমতের এই মহান মুহাফিযরা কোথা থেকে আলোর ঝলক নিয়ে এসেছিলেন এবং উপকুলটাকে অন্ধকার করে কোথায় চলে গেছেন। হায়! কোনো রহস্যভেদী যদি এ রহস্যটা উদ্ঘাটন করতো যে, মিল্লাতের আয়নার স্বচ্ছতার নেগাহবানরা কোথা থেকে উদয় হয়ে কোথায় হারিয়ে গেলেন! মা‘আয আর বলতে পারলোনা! তার কন্ঠ ধরে এলো। তার চোখ থেকে ক‘ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সে অশ্রু বিন্দুগুলোকে সাথে সাথে উপকুলীয় বালি খেয়ে ফেলল। এরপর সে মাথার মাথার রুমালের একপ্রান্ত দিয়ে চোখ দুটো মুছে নিয়ে আপন ঘোড়ার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। নাবিল এবং বাসিত তার অবস্থা দেখে কোনো কথা বললো না। তারাও তার পিছনে পেছনে চলতে লাগলো।

আরও পড়ুন : সমুদ্র ঈগল ১০ (খ)

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...