মঙ্গলবার, ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১১:২১
Home / এশিয়া / মিনা ট্রাজেডি: রহস্যের জট খুলবে কি আদৌ ?

মিনা ট্রাজেডি: রহস্যের জট খুলবে কি আদৌ ?

শাইখ মামুনুল হক্ব, মক্কা শরিফ থেকে:

mamunul haque১৪৩৬ হিজরীর হজ্ব এক বিষাদময় ট্রাজেডিক উপাখ্যান হয়ে রইল ৷ পবিত্র মসজিদে হারামে ক্রেন উপড়ে গিয়ে শতাধিক প্রাণহানীর পর জামারাতের পথে মিনায় পদপিষ্ট হয়ে প্রচারিত মতে প্রায় আটশত হাজি মর্মান্তিকভাবে নিহত হন ৷ অনেকের আশংকা, প্রকৃত নিহতের সংখ্যা এরচেয়ে আরো অনেক বেশি ৷ দুঃখজনক বিয়োগান্তুক ঘটনাগুলোর পর স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম বিশ্বে এক দিকে যেমন গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে, সেইসাথে উঠেছে সমালোচনার ঝড় ৷ চলছে নানামুখী বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনাও ৷ কেউ কেউ নিছক দুর্ঘটনা ও হাজিদের বিশৃংখলাকে কারণ হিসাবে চিহ্নিত করলেও অনেকে এগুলোকে স্রেফ সউদি সরকারের গাফলতি ও ত্রুটির ফলাফল বলে সমালোচনা করছে ৷ কেউ কেউ আবার ঘটনাগুলোকে স্যাবোটাজ হিসাবেও আখ্যায়িত করছে ৷ ব্যপকহারে আল্লাহর নাফরমানি, সৌদি ও মুসলিমবিশ্ব জুড়ে পাপ-পঙ্কিলতার বিস্তার ও আরব শাসকদের সীমাহীন ভোগবাদিতার ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে পাকড়াও ও গজব হিসাবেও বিশ্লেষণ করছে অনেকে ৷

তবে ঘটনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ হিসাবে একাধিক বিষয়ের পর্যালোচনা আসা বিচিত্র কিছু নয় ৷mina tradegy
ক্রেন দুর্ঘটনার ব্যপার যাই হোক মিনার ঘটনায় সৌদি আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভুল পদক্ষেপ ও তাদের খামখেয়ালিপনাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই ৷ বরং বলা চলে তাদের ভুল সিদ্ধান্তই এই ভয়াবহ ট্রাজেডির মূল কারণ ৷

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও দুর্ঘটনাস্থলে বিপদের শিকার আমার একান্ত এক বন্ধুর মুখে ঘটনার যে বিবরণ শুনেছি তা অনেকটা এমন-

মুযদালিফা থেকে জামারাতে আসার জন্য বড় বড় কয়েকটি পায়ে হাটার পথ আছে ৷ প্রতিটি পথ ধরেই মুযদালিফায় সমবেত হাজি সাহেবান সকাল থেকে জামারাতের উদ্দেশ্যে চলা শুরু করেন ৷ এবং প্রতিটি পথ ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে জামারাতে পৌঁছে যায় ৷ একটি পথ অপর পথের সাথে ক্রসিং হয় না ৷ সে মতে কিং ফয়সাল মহা সড়ক ধরে জামারাতগামী হাজিদের দলটি যখন চৌরাস্তায় পৌঁছে তখন সেখানকার দায়িত্বরত বাহিনী এ মহাসড়কে আগত হাজিদের গতি ঘুরিয়ে দেয় অপর আরেকটি মহা সড়কের দিকে ৷ অথচ এক মহাসড়ক থেকে অপর মহাসড়কে যাওয়ার জন্য সেখানে বড় প্রশস্ত কোনো সংযোগ সড়ক ছিল না ৷ ফলে লাখো হাজিদের এ স্রোতটি তাবুর ভিতরের ছোট পথ ধরে অগ্রসর হতে আরম্ভ করে ৷ মহাসড়কের বিপুল পরিমাণ মানুষ সংকীর্ণ পথে ঢুকতেই সেখানে প্রচন্ড ভীড় তৈরি হয় এবং স্বাভাবিকভাবেই চলার গতি শ্লথ হয়ে আসে ৷mina tradegy1

কিন্তু পেছন থেকে ধেয়ে আসা স্রোতের তো কোনো কমতি ছিল না ৷ এভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই কিছু কিছু দুর্বল মানুষ ভীড়ের ধাক্কা শামলাতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে থাকে ৷ আর রাস্তার দুই পাশে অপেক্ষাকৃত চাপ বেশি হওয়ায় শক্তিশালী সবল মানুষগুলো তাবুর গ্রীল বেয়ে উপরে উঠে যেতে শুরু করে ৷ রাস্তায় পড়ে যাওয়া দুর্বল মানুষগুলোকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জটলাও তৈরি হতে থাকে ৷ এতে ভীড়ের চাপ আরো বেড়ে যায় ৷ ইত্যবসরে আহতদের সাহায্যে বিপরিত দিক থেকে এ্যাম্বুলেন্সগাড়ী ঢুকে পড়ে সরু রাস্তায় ৷ এতে সামনে এগুনোর পথ স্বাভাবিকভাবেই আরো সংকুচিত হয়ে যায় ৷ কিন্তু পিছন দিক থেকে তো জনস্রোতের চাপ ক্রমাগত বাড়তেই থাকে ৷ আর এভাবেই এক পর্যায়ে একজনের উপর আরেকজন তার উপর আরেকজন তারপর মানুষের সারির উপর মানুষের সারি আছড়ে পড়তে থাকলে স্মরণকালের ভয়াবহ বিপর্যয়ের ট্রাজেডি তৈরি হয় ৷ প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে একথাও এসেছে যে, বিপর্যস্ত মানুষগুলোর পেছনের দিকে ইরানী শিয়াদের বড়সড় একটা দল ছিল যারা কি না অনেক আহত ব্যক্তিদের উপর আরো বেশি চাপ তৈরি করেছে ৷
এই হল আমার বিশ্বস্ত বন্ধুর সরাসরি বরাতে প্রাপ্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ ৷mina tradegy3

মহা সড়ক বন্ধ করে লাখো মানুষের জনস্রোতকে সংকীর্ণ পথের দিকে ঠেলে দেওয়ার কারণ হিসাবে চাউর হয়েছে যে, প্রিন্সের গাড়ী বহরকে পথ তৈরি করে দিতেই এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এবং সংবাদটি সম্ভবত ইরানী মিডিয়া থেকে প্রচারিত হয়েছে ৷ ঘটনার পরপরই ইরানী মিডিয়া সৌদি সরকারকে দায়ী করে সংবাদ প্রচার শুরু করে এবং সরাসরি অভিযোগ দায়ের করে ৷
ঘটনার আদ্যপান্ত এবং প্রকৃত দায় কার সে বিষয়ে বিস্তারিত কোনো বিবরণ মিডিয়াতে আসার রেওয়াজ এখানে নেই ৷ তাই এমন আশা করা অবান্তর যে, প্রকৃত ঘটনার বিবরণ জনসম্মুখে প্রকাশ হবে ৷
এমনিতে তো স্বাভাবিক হিসাবে সকাল আটটার দিকে উল্টো পথ দিয়ে কোনো প্রিন্সের গাড়ীবহর আসার কোনো বাস্তবতা নেই ৷ তাদের জন্যতো হেলিকপ্টারে করেই আসার ব্যবস্থা থাকে ৷ সেক্ষেত্রে প্রশ্ন তৈরি হবে, তাহলে জামারাতগামী কিং ফয়সাল মহাসড়কের হাজিদের গতি কী কারণে সরু পথের দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হল? এখান থেকেই বিষয়টিতে রহস্যের জটলা পাকায় ৷
হজ্বের সফরে এসে আমি এখানকার অনেকের সাথে বর্তমান সৌদি বাদশাহর নীতি-পলিসি বিষয়ে আলোচনা করেছি ৷ এছাড়া বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমেও বেশ কিছু বিষয় পরিষ্কার ৷

বর্তমান সৌদি বাদশাহ সালমান এবং তার শাসনকাল তার পূর্বসূরি বাদশাহ আব্দুল্লাহর শাসনকাল থেকে বেশ কিছু বিষয়ে ব্যতিক্রম ৷ যেমনটা ভিন্ন ভিন্ন তাদের দুজনের ব্যক্তিচিন্তা ও রাজনৈতিক দর্শন ৷ বাদশাহ আব্দুল্লাহর প্রশাসনে সেক্যুলার চিন্তার লোকদের প্রভাব ছিল বেশি ৷ তারা মুসলিম ও আরব বিশ্বের সাথে বৈরিতা নিয়ে চলত ৷ সেই তুলনায় সালমান নাকি অনেকটাই বিপরিত চিন্তার ৷ সে কুরআনের হাফেজ ৷ তার পররাষ্ট্র নীতিও মুসলিমবিশ্ব কেন্দ্রিক ৷ আর তাই সালমান বাদশাহ হওয়ার পরই তার মন্ত্রিসভায় বড় রকমের পরিবর্তন আনে ৷ সে তার প্রধান নায়েব তথা যুবরাজ মিকরিন বিন আব্দুল আযীয ও বান্দার বিন আব্দুল্লাহসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পরিবর্তন করে ৷ যাদের ব্যপারে পশ্চিমা অনৈসলামিক আনুকুল্যের অভিযোগ রয়েছে ৷ এভাবে গুরুত্বপূর্ণ অনেক পরিবর্তনসহ সালমান নতুন ভাবে মন্ত্রিসভাকে ঢেলে সাজায় ৷mina tradegy.2

আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে দাড় করিয়ে নামাযে চলে যাওয়া সালমানের সাহসী কর্ম হিসেবে পরিচিতি পায় ৷ মুসলিমবিশ্বের বর্তমান অন্যতম চিন্তাশীল নেতা এরদোগানের সাথে নাকি সালমানের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ৷ ইখওয়ানুলমুসলিমীনের ব্যাপারেও সালমানের চিন্তা আব্দুল্লাহর চেয়ে ভিন্ন রকম ৷ মিশরের সিসিকে প্রদত্ত সৌদি সহযোগিতাও বন্ধ করে দিয়েছে সালমান ৷ মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে মাথা গজিয়ে ওঠা শিয়া ফেতনা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে ৷ আর শিয়াদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও উস্কানী দেয়ার মাধ্যমে পশ্চিমা ইহুদী-খ্রীষ্ট শক্তি ইসলামী শক্তিকে দুর্বল করে রাখতে চায় ৷ মালিক সালমান শিয়াদের বিষয়েও কঠোর অবস্থান নিয়েছেন ৷ সঙ্গত কারণেই সৌদি নেতৃত্ব নতুন এক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন ৷ ভিতরে-বাইরে বর্তমান নেতৃত্বকে কঠিন প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করতে হচ্ছে ৷ এসকল কারণে এমন সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দেয়া যায় না যে, খুবই সুক্ষ্ম কোনো পরিকল্পণার আলোকে একটি প্রতিকুল অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে ৷ শোনা যাচ্ছে, বিষয়টি নিয়ে ইরান জাতিসংঘে তোলপাড় সৃষ্টি করবে ৷ পূর্বাপর এসকল পরিস্থিতি দৃষ্টে একথা শতভাগ নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, রহস্যের জট খুলে পুরো ঘটনা তার কার্যকারণসহ খোলাসা হওয়া কঠিন ৷
সুতরাং এক্ষেত্রে পক্ষ-বিপক্ষ কোনো দিকে দৃঢ় অবস্থান গ্রহন করার আগে অনেক কিছু জানতে হবে এবং ভাবতে হবে ৷ সেইসাথে মালিক সালমানের সৌদি আরব-এরদোগানের তুরস্ক-মিশরের ইখওয়ান ও নওয়াজ শরীফের পাকিস্তান মিলে মুসলিম বিশ্বে নতুন মেরুকরণের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে এবং একইসাথে এই সম্ভাবনার বিপরিতে কুচক্রী শিয়া গোষ্ঠীর অপতৎপরতা ও তাদের প্রতি পশ্চিমা আনুকুল্যের বিষয়টিকেও মাথায় রাখতে হবে ৷ কোনো কিছুই বর্তমানে খুব সরলভাবে বিবেচনা করা যায় না ৷

২৮শে সেপ্টেম্বর’ ১৫
পবিত্র মক্কা মুকাররমা

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কাশ্মীরে অভিযান আরও জোরদার করেছে ভারত

কমাশিসা: জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান আরও জোরদার করেছে ভারত। স্থানীয় পুলিশ, প্যারামিলিটারি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা জেলায় ...