|
২০১৬ সালে ভারতের সেরা খবরটা আসে বছরের শেষ নাগাদ। জনসমক্ষে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ একটি শিল্পগোষ্ঠী স্বীকার করে নিল, সবচেয়ে শক্তিশালী মৌলবাদী গোষ্ঠীর প্রয়োজনীয়তা আছে। টাটা গ্রুপের রতন টাটা নিজের বিমানে চড়ে নাগপুরে আরএসএসের সদর দপ্তরে গেলেন সংঘের প্রধান মোহন ভাগওয়াতের সঙ্গে দেখা করতে। এই বৈঠকটির দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ২০ মিনিট। কিন্তু এতে বোঝা গেল, সংখ্যালঘু পারসি গোষ্ঠীর নেতৃত্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরাও পরাজয় মেনে নিয়েছেন। মনে হচ্ছে, সংকীর্ণতাবাদের পক্ষে যে উষ্ণ বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে, তাতে এখানে হিন্দুত্ববাদের প্রতি সহানুভূতিশীল দল ছাড়া বিকল্প থাকবে না।
এতে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি স্বাধীনতার আগে ভারতের জাতীয় আন্দোলন বহুত্ববাদ দ্বারা পরিপুষ্ট হয়েছে, তার সঙ্গে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, খান আবদুল গাফফার খান ও রাফি আহমেদ কিদওয়াইয়ের মতো মুসলিম নেতাও তাতে তেলজল জুগিয়েছেন। মুসলিম লীগ ধর্মের নামে যে চাপ সৃষ্টি করেছে, সেটা তাঁরা সহ্য করেছেন। এই নেতাদের হিন্দুদের ক্রীড়নক মনে করা হতো।
মহাত্মা গান্ধীর প্রার্থনা সভার একটি ঘটনা আমার মনে আছে। ওই সভাগুলোতে বাইবেল, কোরআন ও গীতা থেকে পাঠ করা হতো। তো হলো কি, একদিন পাকিস্তান থেকে আসা এক শরণার্থী আপত্তি জানিয়ে বসলেন, এখানে কোরআন পাঠ করা হয় কেন? গান্ধী বললেন, কোরআন পাঠ ছাড়া এই সভা হবে না। কারণ, এটি এই সভার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর দিন পনেরো পর অভিযোগকারী বুঝলেন, সভার সবাই গান্ধীর মতেই আস্থা রাখেন, তিনি বরং তাঁদের মধ্যে বাদ সাধছেন। এরপর তিনি গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে নিজের বিরোধিতা প্রত্যাহার করেন।
গান্ধীর কাছে ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধগুলো ছিল বিশ্বাসের মতো। আজ ভারত যে মধ্যপন্থী হিন্দুত্ববাদের খপ্পরে পড়েছে, তিনি থাকলে তা চ্যালেঞ্জর মুখে পড়ত। ভারতের ২০ কোটি মুসলমান, যাঁরা কিনা দেশের এক-পঞ্চমাংশ নাগরিক, রাষ্ট্রের কাছে তাঁদের দাম নেই। শুধু ভোটের সময়ই তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন।
ভারত ভাগ হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে, যার মধ্যে শত্রুতা ও প্রতিশোধপরায়ণতা আছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার সব চেষ্টারই আমি প্রশংসা করি, তা সে যতই ছোট হোক না কেন। নতুন বছরের প্রথম দিনে তরুণ ছেলে ও মেয়েরা ইন্ডিয়া গেটে সমবেত হয়ে ওয়াগা সীমান্তের উদ্দেশে বাসে চড়ে বসে, সেখানে গিয়ে তারা ইসলামাবাদের প্রতি বন্ধুতা জানিয়েছে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে সীমান্তে এত কড়াকড়ি ছিল না, তখন হলে এই ছেলেমেয়েরা দিল্লি থেকে সরাসরি লাহোরে যেতে পারত।
এই ছেলেমেয়েরা গর্বের সঙ্গে বাসে একটি ব্যানার ঝুলিয়েছিল, যাতে লেখা ছিল ‘বাস টু পাকিস্তান’। বাসে ছিল ৫০ জন তরুণ-তরুণী, তার সঙ্গে বাইসাইকেলে ছিল আরও ৫০ জন। ১০ কিলোমিটার অন্তর তারা জায়গা বদলেছে, আবার সীমান্ত পর্যন্ত যাওয়ার আগে নির্দিষ্ট স্থানে থেমেছে। স্থানীয় জনতা তাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছে।
আমি জানি না ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্কটা এ রকম শীতল হয়ে গেল কেন? দেশভাগ তো কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সম্মতিতে হয়েছে, যদিও কংগ্রেস এ ব্যাপারে তেমন একটা খুশি ছিল না। ৭০ বছর তো হয়ে গেল, পরস্পরকে গ্রহণ করা ও ভালো প্রতিবেশী হওয়ার জন্য এটা যথেষ্ট লম্বা সময়, যদি তারা বন্ধু না–ও হয়।
এটা ঠিক যে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, কিন্তু সেনাবাহিনী একসময় দেশটি শাসন করত, সেখানে শেষ কথাটিও বলে সেই সেনাবাহিনীর। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দেখা যায়, সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান করে ব্যারাকে ফিরে গেলেও এটা নিশ্চিত করে যায় যে প্রকৃত ক্ষমতা যেন তাদের কাছেই থাকে। ভারত এ দিক দিয়ে ভাগ্যবান যে তার তিনটি বাহিনী অরাজনৈতিক ও পেশাদার। তারা বিশ্বাস করে, সীমান্ত রক্ষা করা তাদের দায়িত্ব, সেটা নিশ্চিত করতে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। ভারতীয় সেনাবাহিনী ধর্মনিরপেক্ষতায় প্রশিক্ষিত, তারা এমন কিছু করতে চায় না, যার মধ্যে সংকীর্ণতাবাদের গন্ধ পাওয়া যেতে পারে, যাকে অনেক দেশই ঈর্ষা করে।
একইভাবে ভারতের বিচার বিভাগও উদাহরণ হয়ে উঠেছে, যাকে অন্যরা অনুসরণ করতে পারে। ভারতীয় বিচার বিভাগে যে মানের বিচারপতি আছেন, আশপাশের দেশে তা নেই। মাঝেমধ্যে আমার বিস্ময় লাগে, ভারত সরকারের মধ্যে বিভিন্ন কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও এত ভালো মানের মানুষেরা কীভাবে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি এক রায়ে বলেছেন, ‘নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় ও ভাষা কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবে না, কোনো প্রার্থী যদি এসবের দোহাই দিয়ে ভোট চান, তাহলে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করা হবে।’ এতে গণতন্ত্র সংহত হয়েছে, যার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা পরাজিত হয়েছে। তবে ভারতীয়দের আরামে বসে থাকলে চলবে না। কারণ, দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতীয় জনতা পার্টির মানুষ, যার প্রতি পক্ষপাত তিনি লুকাতেও চান না। এই দলের আদর্শিক নেতারা নাগপুরে থাকেন। মোদি তাঁদের বলেছেন, তাঁরা যেন এমন বার্তা দেন যে তিনি তাঁদের আদর্শেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে রতন টাটা যে মোহন ভাগওয়াতের কাছে যান, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই, যে ভাগওয়াত ক্ষমতাসীন দলকে দিকনির্দেশনা দেন। সাইরাস মিস্ত্রি একসময় টাটা গ্রুপের সদস্য ছিলেন। দৃশ্যত মনে হয়, সংসদের ভেতরে কী হয়, সেটা তিনি জানেন। রতন টাটা চান না, ভাগওয়াত সাইরাসের কথায় বিশ্বাস করেন, অর্থাৎ টাটা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর তিনি যা বলেছেন। সম্ভবত এটা ঘটনার আরেকটি দিক, যা রতন ঢেকে রাখতে চান। কিন্তু এটা জানা দরকার।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।