২০১৬ তে যেমনি যুদ্ধ আর শঙ্কার বছর। তেমনি অনেক মনীষীকে হারানোর বছর। বেশ কয়েকজন মনীষীকে আমরা হারিয়েছি ষোলতে। যারা দেশকে দিয়ে গেছেন অগণন। যাদের মাধ্যমে মানুষ পেয়েছে সত্য সুন্দরের শিক্ষা। আলোকিত হয়েছে আত্মভোলা মানুষ। আসুন জেনে নেই এমন শীর্ষ কজন মনীষীকে। লিখেছেন দিদার শফিক
শাইখুল হাদিস আব্দুল হাই পাহাড়পুরী রহ.
২৯ আগস্ট ২০১৬
শাইখুল হাদিস আল্লামা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী রহ.।বাংলাদেশের একজন প্রবীণ আলেম। অনেক শীর্ষ আলেমের মুরব্বি। আধ্যাত্মিক জগতের রাহবার। ইলম ও আমলের সমন্বয়ে জীবন গড়ার স্বপ্নদ্রষ্টা। ২০১৬ সালের ২৯ আগস্ট আনুমানিক বিকাল ৩টায় তিনি ঢাকার খিদমাহ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। তিনি মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুরের জামাতা।
আল্লামা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রহ. এর শিক্ষাজীবনের সূচনা পাহাড়পুর এমদাদুল উলূম মাদরাসায়। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী শেষে ১৯৬৭/৬৮ সালের দিকে লালবাগ মাদরাসায় এসে মিশকাত জামাতে ভর্তি হন। শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. কৃত বুখারির ব্যাখ্যা গ্রন্থের সম্পূর্ণ প্রুফ হজরত পাহাড়পুরী হুজুরই দেখেছেন। দাওরায়ে হাদিস শেষ করার পর জামিআ নূরিয়া আশরাফাবাদ কামরাঙ্গীর চড়ে বুখারি সানি পড়ানোর মাধ্যমে শিক্ষকতার জীবন শুরু করেন। তারপর জামিআ মুহাম্মাদিয়ায় শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৯৫ সালে জামিআ রাহমানিয়া আরাবিয়া মুহাম্মাদপুরে শিক্ষকতা আরম্ভ করেন। তারপর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি জামিয়া লালমাটিয়ার শায়খুল হাদিস ছিলেন। আবদুল হাই পাহাড়পুরী স্ত্রী, তিন ছেলে, সাত মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
কামরাঙ্গীচর জামিয়া নূরিয়া আশরাফাবাদ মাদরাসায় জানাজা শেষে তাকে হাফেজ্জী হুজুরের কবরের পাশে দাফন করা হয়।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান
২৫ জুন ২০১৬
সাহিত্য সাংবাদিকতা জগতে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছিলেন জমিদার। তিনি সাহিত্য-সম্রাট।বাংলা ভাষায় সিরাত চর্চা প্রবর্তন, তাফসিরগ্রন্থ মাআরেফুল কুরআনের অনুবাদ, ইসলামের মৌলিক বিষয়ের দুষ্প্রাপ্য ও উচ্চাঙ্গের কিতাবাদি সহজ- সরল, সাবলীল ভাষায় সবার বোধগম্য করে তিনি প্রকাশ করেছেন।এছাড়া বংলাদেশের ইসলামি রাজনীতি, তাহজিব তামাদ্দুনের তিনি ছিলেন পুরোধা। অগ্রপথিক। জাতীর এক মহান রাহবার।
মাওলানা মহিউদ্দীন খান গোটা পৃথিবীর দু’একজন বিরল সম্মানের অধিকারী মুসলিম মণীষীদের অন্যতম। যার প্রতিটি কথা হয়েছে গ্রন্থিত। জীবনের প্রতিটি দিক জীবন্ত ইতিহাস।প্রতিটি বক্তৃতা সংকলিত। রচিত পুস্তক হয়েছে চিরন্তন সাহিত্য। চিন্তার প্রতিটি ক্ষণ হয়ে উঠেছে আলো ছড়ানো অমৃত বার্তা।
সমসাময়িক বিষয়ে সুচিন্তিত মত, চিন্তা-গবেষণা, ইসলামি জাগরণ আর কর্ম সাধনায় তিনি নিজেকে অমর করে গেছেন। তার লিখিত গ্রন্থ ইউরোপের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য। বাংলাদেশে তিনিই কেবল ‘খানায়ে কাবা’র ভেতরে প্রবেশ করে নামাজ পড়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। তিনি কেবল একজন ব্যক্তি নন, তিনি বহুমুখী কর্মতৎপরতার একটি সফল প্রতিষ্ঠান ।
এই মহান সাধক পুরুষ ১৩৪২ বঙ্গাব্দে ৭ বৈশাখ জুমার আজানের সময় ময়মনসিংহের মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯ রমজান ২৫ জুন ২০১৬ ইসায়ি সনে ইফতারেরর পূর্বক্ষণে সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান।
মাসিক মদীনা ও সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান সম্পাদনা, মৌলিক রচনা, অনুবাদ,বাংলা ভাষায় নবির জীবনী চর্চার প্রবর্তনসহ অনেক অবদান আছে তার। ভাষা-সাহিত্য, রাজনীতি ও মানবতা প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। বাংলা সাহিত্যে আলেমদের এখন যৌবনকাল এটা তারই নিরলস সাধনা ও প্রেরণার ফসল। রাবেতায়ে আলম আলইসলামির তিনি বাংলাদেশের প্রথম সদস্য এবং এ সংস্থাটির কার্য নির্বাহী পর্ষদের দায়িত্বে ছিলেন। মদিনা ইউনিভার্সিটির সম্মানিত স্কলার ও ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন তিনি। ফ্রি কুরআন বিতরণ,মসজিদ-মাদ্রাসা, দাতব্য চিকিৎসালয় নির্মাণসহ জনকল্যাণমূলক অনেক কাজের মাধ্যমে আমাদের মাঝে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
মাওলানা আব্দুল জব্বার জাহানাবাদী
১৮ নভেম্বর ২০১৬
৩০ বছরের অধিককাল ধরে তিনি বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার মহাসচিব ছিলেন। বেফাকের অফিসিয়াল কার্যক্রম আঞ্জামসহ তিনি বাংলাদেশে অনেক মাদরাসা ও বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। বিভিন্ন ইসলামি সংগঠন ও আন্দোলনেও তার অসামান্য ভূমিকা আছে। বিশেষভাবে কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিক উন্নয়নে তার প্রচেষ্টা চিরস্মরণীয়।
তিনি মাওলানা আব্দুল জব্বার জাহানাবাদী হিসেবে পরিচিত। তার পারিবারিক নাম আব্দুল জব্বার। বাবা শেখ নাসিরুদ্দীন।১৯৩৭ সালে বর্তমান খুলনা বিভাগের অন্তর্গত বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানার সহবত কাঠি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম । পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে মাওলানা আব্দুল জব্বার দ্বিতীয়। তিনি ঢাকার বড় কাটারা মাদরাসা থেকে দাওরা বা তাকমিলুল হাদিস সম্পন্ন করেন।
তার উল্লেখযোগ্য উস্তাদদের মধ্যে আছেন ১. মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. ২. হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ ৩. শায়খুল হাদীস আল্লামা আযিযুল হক রহ ও ৪. হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব পীরজী হুজুর রহ.।
বেফাকই ছিল তার সারা জীবনের সাধনা। তিনি ইসলামি শিক্ষাকে সর্বস্তরে পৌছে দেওয়ার জন্য বেফাকের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মশালা ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। তার সম্পাদনায় বেফাক প্রকাশিত বিভিন্ন বই মাদ্রাসাগুলোতে পাঠ্য। এছাড়া মৌলিক রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
তার লিখিত গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, ১. ইসলাম ও আধুনিক প্রযুক্তি ২. মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ৩. ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসন ও তাদের গৌরবময় ইতিহাস ৪. ইসলামে নারীর অধিকার ও পাশ্চাত্যের অধিকার বঞ্চিতা লাঞ্ছিতা নারী।
তিনি ১৮ নভেম্বর সকাল ১০ টা ১০ মিনিটে ঢাকার মগবাজারে অবস্থিত হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলে ৭৯ বছর।মাওলানা আবদুল জাব্বার জাহানাবাদী রহ. দীর্ঘদিন ধরে কিডনি হার্ট ও শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে ভুগছিলেন।
ড. খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর
১১ মে ২০১৬
মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় চলতি বছর ইন্তেকাল করেন ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদিস বিভাগের অধ্যাপক ড. খোন্দকার আ ন ম আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর। ড. জাহাঙ্গীর ১৯৬১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহের ধোপাঘাট গোবিন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা খোন্দকার আনওয়ারুজ্জামান ও মায়ের নাম বেগম লুৎফুন্নাহার।
তিনি ঢাকা সরকারি আলিয়া মাদরাসা থেকে ১৯৭৩ সালে দাখিল, ১৯৭৫ সালে আলিম এবং ১৯৭৭ সালে ফাজিল ও ১৯৭৯ সালে হাদিস বিভাগ থেকে কামিল পাস করেন। এরপর তিনি সৌদি আরবের রিয়াদের ইমাম মুহাম্মাদ বিন সাঊদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৬ সালে অনার্স, ১৯৯২ সালে মাস্টার্স ও ১৯৯৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
রিয়াদের অধ্যয়নবালে তিনি বর্তমান সৌদি বাদশা ও তৎকালীন রিয়াদের গভর্নর সালমানের হাত থেকে পর পর দু’বার সেরা ছাত্রের পুরস্কার গ্রহণ করেন। খ্যাতিমান এই মনীষী ১১ মে ২০১৬ সবাইকে কাদিয়ে চলে যান আখেরাতের সফরে।
কারি মুহাম্মদ উবায়দুল্লাহ
২০ ডিসেম্বর ২০১৬
কারী উবায়দুল্লাহ। কুরআনের আলো ছড়ানো এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সুমধুর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করে কুরআনের হৃদয়স্পর্শী আবেদন মানুষের হৃদয়ের গভীরে পৌছে দেওয়াই ছিল তার কাজ। দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে ২০ ডিসেম্বর ২০১৬ মঙ্গলবার ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে তার নিজ বাসায় তিনি পরলোকগমন করেন।
মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। তিনি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়ার কোদালা ইউনিয়নের একটি সম্ভ্রান্ত ধার্মিক পরিবারে ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম গ্রহণ করেন। বাবা বিশিষ্ট আলেমে দীন আল্লামা শাহ মেহেরুজ্জামান ইসলামাবাদি রহ.। বাবা আল্লামা শাহ মেহেরুজ্জামান ইসলামাবাদি রহ. এর কাছেই তার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে ঢাকার লালবাগ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। লালবাগে মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর রহ. , শাইখুল হাদিস আজিজুল হক রহ. সহ অন্যান্য বিজ্ঞ আলেমদের কাছে তিনি শিক্ষালাভ করেন। ১৯৬২ সালে লালবাগ মাদরাসা থেকে তিনি তাকমিল বা দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। এ বছরেই তিনি লালবাগ মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। একই বছর মাত্র ১৮ বছর বয়সে নাজিমুদ্দিন রোডে অবস্থিত রেডিও পাকিস্তান কেন্দ্রে প্রথম কোরআন তেলাওয়াত করেন তিনি।১৯৬৫ সালে শুরু হওয়া পাকিস্তান টেলিভিশন যত দিন ছিল ততদিন ক্বারী উবায়দুল্লাহ সুমধুর কন্ঠ দিয়ে মাতিয়ে রেখেছিলেন অগণিত ধর্মপ্রাণ মানুষকে।
১৯৭৫ সালে বিটিভি উদ্বোধন হয়েছিলো তারই তিলাওয়াতের মাধ্যমে । বাংলাদেশ পার্লামেন্টের সেই উদ্বোধনী অধিবেশন থেকে ৯ম পার্লামেন্ট পর্যন্ত আমাদের জাতীয় সংসদসহ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানসমুহকে কুরআনের মধুর তেলাওয়াতে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন তিনি। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, নিউমার্কেট, হোটেল শেরাটনসহ জাতীয় অসংখ্য স্থাপনার উদ্বোধন হয়েছে তার তেলাওয়াতের মাধ্যমে। তার যাদুকরি কন্ঠে কোরআনের তেলাওয়াত করে দেশ ও জাতির জন্য বয়ে এনেছেন বিরল সম্মান ও মর্যাদা ।
কারি উবায়দুল্লাহ সৌদি আরব, কাতার, দুবাই, লিবিয়া, বাহরাইন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পাকিস্তানসহ বিশ্বের অন্তত ২০-২৫টি দেশে আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতায় বারবার প্রথমস্থান অর্জন করে বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনেন বিরল মর্যাদা। সৌদি বাদশাহ ফয়সাল ও খালেদ দুইবার তাকে কোরআনের শিল্পী বা কারী হিসেবে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেন।
১৯৬২ সাল থেকে ঐতিহ্যবাহী চকবাজার শাহি মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন তিনি। অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর থেকে নামাজ পড়াতে না পারলেও তাকে নিয়মিত সম্মানী দিয়ে যাচ্ছিল মসজিদ কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ বেতারে তার সুমধুর কণ্ঠে আজান ও কুরআনের তেলাওয়াত সম্প্রচারিত হত। তিনি দীর্ঘ দিন অসুস্থ ছিলেন। অসুস্থ থেকেই অবশেষে ২০ ডিসেম্বর ২০১৬ মঙ্গলবার বাদ ইশা ইন্তেকাল করেন। তার ইন্তেকালে এ দেশ একজন কুরআনের আলো ছড়ানো মহান ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছে।
২০১৬ সাল বিদায় নিচ্ছে। এ বছরটি শোক ও বেদনার বছর। এ বছর বাংলাদেশ হারিয়েছে তার বেশ কয়েকজন সূর্যসন্তানকে। চিরবিদায় নিয়েছেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় বরেণ্য, বিশ্বনন্দিত কয়েকজন আলেম ও সাধকপুরুষ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অবদান ও কর্মময় জীবন নিয়ে লিখেছেন দিদার শফিক। পড়ুন আওয়ার ইসলামে।
মাওলানা জালালুদ্দিন আল কাদেরী রহ.
২৬ নভেম্বর ২০১৬
মাওলানা জালালুদ্দিন আলকাদেরী । বহুমুখী প্রতিভায় বিকশিত এক সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব। চট্টগাম জেলার পটিয়াস্থ চরকানাই গ্রামে আল্লামা জালালুদ্দিন আলকাদেরী রহ.-এর জন্ম। তার বাবার নাম মরহুম আলহাজ অলি আহমদ চৌধুরী । মা মরহুমা সুফিয়া খাতুন।
বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১৯৭০ সালে কামিল হাদিস প্রথম শ্রেণি এবং ১৯৭১ সালে কামিল ফিকহ প্রথম শ্রেণি ও সরকারি কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ বোর্ডস অব গভর্নর, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়ার সাবেক অধ্যক্ষ ও জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদের খতিব, বাংলাদেশ জাতীয় খতিব কাউন্সিলের সভাপতি, বাংলাদেশ জমিয়তুল মোদার্রেছীন কেন্দ্রীয় পর্ষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
২৬ নভেম্বর ২০১৬ শনিবার রাত ১০টায় ঢাকাস্থ বারডেম হাসপাতালে ৭০ বছর বয়সে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি ২ ছেলে ৫ কন্যা ও বহুগুণগ্রাহী রেখে যান।
মাওলানা শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী
১৪ এপ্রিল ২০১৬
আরবি ভাষার অন্যতম শিক্ষক ও পন্ডিত, বিশিষ্ট ক্যালিগ্রাফি শিল্পী হাফেজ মাওলানা শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী ইন্তেকাল করেন ১৪ এপ্রিল। ফজরের সালাতের পর মর্নিংওয়াক শেষে নয়াপল্টনের বাসায় এসে ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘুমের মধ্যেই তিনি ইন্তিকাল করেন।
শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী ১৯৫৪ সালে মানিকগঞ্জের সিংগাইরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পবিত্র কুরআন হিফজ শেষে সৌদি আরবে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য গমন করেন। সেখানে ক্যালিগ্রাফিতে ডিপ্লোমা এবং এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। আরবি ভাষা ও সাহিত্যে তার পাণ্ডিত্য ছিল শীর্ষ পর্যায়ের। এবিষয়ে তিনি কয়েকটি বই লিখেছেন। এছাড়া ক্যালিগ্রাফিতে তার অবদান অবিস্মরণীয়। এ বিষয়ে হাতে-কলমে বই লিখেছেন। তার ছাত্ররা দেশে বিদেশে সুখ্যাতি পেয়েছে। তিনি ঢাকাস্থ সৌদি দূতাবাসে সামরিক এটাচিতে কর্মরত ছিলেন। মৃত্যুকালে স্ত্রী, পুত্র ও ২ কন্যা, আত্মীয়-স্বজন ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
শায়খুল কুররা আলী আকবর সিদ্দীক
৮ মার্চ ২০১৬
শায়খুল কুররা মাওলানা আলি আকবর সিদ্দিক। কুরআনের বিশুদ্ধ পাঠ-পঠনে ব্যয়িত হয়েছে তার জীবন। তিনি ভানুগাছী হুজুর নামেও পরিচিত।
আঞ্জুমানে তালিমুল কুরআন বাংলাদেশের মাধ্যমে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে সারাবিশ্বেই বিশুদ্ধ তেলাওয়াতের বার্তা ও অনুশীলন ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
জন্ম : ১৯৪৬ সালের ৫ জুন চাঁদপুর জেলার হাজিগঞ্জ থানার বাখরপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন শায়খুল কুররা মাওলানা আলি আকবর সিদ্দিক। পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে পিতা-মাতা মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার ভানুগাছ সরইবাড়ী গ্রামে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাঁর পিতা মরহুম মাওলানা রহিম উদ্দিন পাটওয়ারি রহ.। মাতা মরহুমা বেগম আলতাফুন্নেছা।
শিক্ষা : জন্মস্থানেই তার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি।১৯৬২ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত হবিগঞ্জ জেলার মিরপুর জামিয়া হুসাইনিয়া মাদরাসায় অত্যন্ত সুনামরে সাথে আলিয়া চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেন। উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ১৯৬৯ সালে ঐতিহ্যবাহী জামিয়া ইসলামিয়া হুসাইনিয়া গহরপুর সিলেটে ভর্তি হয়ে ১৯৭১ সালে কৃতিত্বের সাথে দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স সমমান) পাশ করেন।
১৯৬৪ সালে দেশের স্বনামধন্য কারি হযরত ইব্রাহিম রহ. চাঁদপুরির নিকট পূর্ণাঙ্গ (ক্বিরাআতে হাফস) প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে দারুল উলুম দেওবন্দের ক্বিরাআত বিভাগীয় প্রধাণ আল্লামা আবুল হাসান আজমীর কাছ থেকে ক্বিরাআতে “সাবআ আশারার” বিশেষ সনদ লাভ করেন।
অধ্যাপনা : ফারেগ হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন সরইবাড়ী ইসলামিয়া আরাবিয়া মাদরাসা। পরে মৌলভীবাজার সদর থানার ভাদগাঁও ইমদাদুল উলুম মাদরাসার শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। পরে বালাগঞ্জ ফিরোজাবাগ মাদরাসার শিক্ষা সচিব ও জামে মসজিদের ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। মৌলভীবাজার সদর থানার দামিয়া বাজার জামে মসজিদেও কিছুদিন ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুপর্যন্ত স্বপ্রতিষ্ঠিত সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার গোটাটিকরস্থ জামিয়া তা’লিমুল কুরআন মাদরাসার মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেছেন।
আঞ্জুমানের সভাপতির পাশাপাশি জামিয়া তা’লীমুল কুরআন গোটাটিকর, সিলেট ও সরইবাড়ী ইসলামিয়া আরাবিয়া হাফিজিয়া মাদরাসা এবং ভানুগাছ জামিয়া তাজবীদুল কুরআন মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিমের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
২০১৬ সালের মার্চ মাসে সিলেটের নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়েস হয়েছিল ৭০ বছর। তিনি স্ত্রী, চার ছেলে, চার মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী ও আত্মীয়-স্বজন রেখে গেছেন।
মুফতি মুস্তফা হামিদী
কুমিল্লার লাকসাম গাজিমুড়া আলিয়া মাদরাসার সাবেক প্রিন্সিপাল, ছারছীনা দারুচ্ছুন্নাত কামিল মাদ্রাসার সাবেক ভাইস প্রিন্সিপাল ও প্রস্তাবিত ছারিজানিয়া ছালেহিয়া দ্বিনিয়া ইউনিভার্সিটির সম্পাদক আলহাজ্ব মাওলানা মুফতি মুস্তফা হামিদী (৮৮) ১৭ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার ভোর ৫টায় নাঙ্গলকোটের রায়কোট ইউনিয়নের ছারিজানিয়া গ্রামে ইন্তেকাল করেন। তিনি ৩ ছেলে ৪ মেয়ে সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান।
বাংলা ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য পুস্তক রচনা করেছেন মাওলানা মুস্তফা হামিদী৷ বিভিন্ন ইসলামী সাহিত্য পত্রিকায় লেখালেখি করতেন তিনি৷
মুসলিম সমাজে সৃষ্ট ইখতেলাফী মাছায়েলের সমাধানের জন্য বাহাছ-মুনাজারায় নেতৃত্ব দিতেন ছারছিনা আলিয়া মাদরাসার সাবেক এই উপাধ্যক্ষ৷ তার ক্ষুরধার বক্তব্যের মাধ্যমে অনেক বাতিল মতামত রহিত হয়েছে।
আরো যাদের হারিয়েছি এ বছর
মাওলানা আহমদ করীম
২৫ আগস্ট ২০১৬
ফেনীর সোনাগাজীর দারুল উলুম আল হোছাইনিয়া ওলামা বাজার মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা আহমদ করীম ইন্তেকাল করেন ২৫ আগস্ট। তিনি ফেনী জেলাসহ চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় আলেম ও বুজুর্গ ছিলেন। বৃহস্পতিবার রাত ৯ টার দিকে তিনি নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন।
হাফেজ মাওলানা তাজুলইসলাম
১৯ ডিসেম্বর ২০১৬
নরসিংদী পুরাতন বাসট্যান্ড মসজিদের খতিব হাফেজ মাওলানা তাজুল ইসলাম ১৯ ডিসেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন৷ মাওলানা তাজুলইসলাম বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস নরসিংদী জেলার সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলেন।
তিনি শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর ডাকে খেলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শরীক হয়ে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দ্বীন কায়েমের নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করে গেছেন। সামাজিক ক্ষেত্রে তার অসংখ্য অবদান রয়েছে।
কুমিল্লার দাউদকান্দীতে জন্ম নেয়া এই আলেম বাল্যকালেই এতিম হয়ে যান। পরবর্তিতে মাদারাসায় পড়ে আলেম হয়ে নরসিংদীর পুরাতন বাসট্যান্ড জামে মসজিদে দীর্ঘ ৪৫ বছর ইমামতি করেন৷
মাওলানা আবদুল আউয়াল রহ.
১৩ এপ্রিল ২০১৬
মাদানীনগর মাদরাসার প্রবীণ উস্তায হযরত মাওলানা আবদুল আউয়াল (আড়াইহাজার হুযুর) রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। ৫ রজব ১৪৩৭ হি. মোতাবেক ১৩ই এপ্রিল ২০১৬ ঈ. বুধবার দুপুর ২টা ৫ মিনিটে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা হারিয়েছি আমাদের এক আদর্শ উস্তাযকে।
১৯৬৫ সনে মেট্রিক পরীক্ষার পর তার মাদরাসায় পড়ার আগ্রহ জন্মায়। পরীক্ষার ছুটিতে নানা বাড়িতে বেড়াতে গেলে একদিন নানাকে বললেন, নানা আমি মাদরাসায় পড়ব। এ কথা শুনে নানা খুশিতে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, যেদিন তুমি জন্মগ্রহণ করেছ সেদিন আমি আল্লাহর কাছে দু‘আ করেছিলাম, আল্লাহ তাআলা যেন তোমাকে আলেম বানান। পরে তিনি নিজের কিছু জমানো টাকা তাকে দিয়েছিলেন মাদরাসায় ভর্তি ও পড়াশুনার কাজে ব্যয় করার জন্য। প্রথমে তিনি লালবাগ মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে মক্তব থেকে মিযান পর্যন্ত পড়েন। তারপর হিন্দুস্তানের আশরাফুল উলূম রশীদী গাঙ্গুহ ও দেওবন্দ মাদরাসায় পড়াশুনা করেন। ১৯৮৫ সনে দেশে ফিরে আসেন এবং মাদানীনগর মাদরাসায় খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন। এরপর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি মাদানীনগরেই ছিলেন। মাদানীনগরকে নিয়েই ছিল তার সব চিন্তা-ভাবনা।
মুফতি আব্দুস সামাদ কাসেমী রহ.
২৫ জানুয়ারি ২০১৬
২৫ জানুয়ারি সোমবার রাত সাড়ে ১০টায় কিশোরগঞ্জ-এর এক নীরব সাধক মুফতি আব্দুস সামাদ রহ. ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। মরহুমের জানাযায় উপস্থিত ছিলেন, আল্লামা শাহ আহমদ শফি (দা.বা.) এর খলিফা ও বেফাকের নির্বাহী সদস্য আল্লামা মুফতি ওমর ফারুক সন্দ্বিপী, নরসিংদী দত্তপাড়া মাদরাসার নায়েবে মুহতামিম মাওলানা শামছুল ইসলামসহ বহু আলেম।
কিশোগঞ্জের এ এই নীরব সাধক জামিয়া এমদাদিয়া কিশোরগঞ্জে হাদীসের শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। এছাড়া তিনি ময়মনসিংহের জামিয়া ইসলামিয়া, সোহাগী মাদরাসা, গাজীপরের বরমী মাদরাসা, তারাকান্দি ইসলামি বিশ্ব বিদ্যালয় ও কুলিয়ারচর আব্দুল্লাহপুর মাদ্রাসায় প্রায় ৫০ বছর হাদীসের পাঠদান করে অসংখ্য মাওলানা, মুফতী ও ইসলামী ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলেন।
সম্পাদনা: রোকন রাইয়ান
আওয়ার ইসলামের সৌজন্যে