মুফতি শাহ নূর আহমদ :
পরম সৌভাগ্যের বিষয় যে, আওলাদে রাসূল সা.’র হাতে গড়া এদারা বোর্ড এর দস্তারবন্দি সম্মেলন রবিউল আওয়াল মাসে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারকে সায়্যিদুস সাদাত, হযরত খায়রুল বাশার সা. এর পবিত্র সীরাতের উপরই লেখতে কলম ধরলাম। মরুর গালিচা বিছানো, সারি সারি খেজুর বৃক্ষের সবুজ বাহারীর ছাওনীঘেরা, বিশাল বিশাল গগণ স্পর্শী পর্বতমালার প্রাচীর বেষ্ঠিত আরবের সেই সর্বকালের সর্বমহান সায়্যিদ বাড়ীর কিঞ্চিৎ ঘরোয়া টুকিটাকি পবিত্র সীরাত শুনানোর প্রয়াসখানি যেন আল্লাহ তা’য়ালা কবুল করেন এবং রাসূল সা.’র রুহ মুবারককে যেন আমাদের উপর খোশ করে দেন। প্রথমে শুরু করছি হুজুরে পাক সা. এর সাহেবজাদা-সাহেবজাদীদের আলোচনা। আমাদের অভিজ্ঞতা যে, ভৃত্যরা যখন মুনিবের সন্তানদের গুণকীর্তন, প্রশংসা ও আদর সোহাগের মাধ্যমে তোষামোদ দেখায়, মুনিব তখন এমনিতেই দয়াদ্র হয়ে যান এবং ভূত্যের সৌভাগ্যের পূর্ব দিগন্ত উদ্ভাসিত, ভাস্করিত হতে থাকে।
হুজুর আকরাম সা. এর সন্তানাদি: নবুওয়াতের পূর্বে হযরত খাদিজা রা. এর গর্ভ হতে একজন সাহেবজাদা ‘‘আবদে মনাফ” জন্ম গ্রহণ করেন এবং নবুওয়াতের পরে আরেক সাহেবজাদা ‘ক্বাসিম’ জন্মগ্রহণ করেন। যার কারণে হুজুর সা. এর উপনাম ‘কুনিয়াত’ আবুল ক্বাসিম ছিল। আরেকজন সাহেবজাদা আব্দুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নামই ত্বায়্যিব এবং ত্বাহির ছিল। মতান্তরে ত্বায়্যিব একজন আর তাহির হলেন আরেকজন।
সাহেবজাদী হলেন চারজন ১. জায়নাব ২. রুক্বায়্যা ৩. উম্মে কলসুম ৪. ফাতিমা। মুহাম্মদ বিন ইসহাক্ব থেকে বর্ণিত যে, হুজুর সা.’র নবুওয়াতের পূর্বেই সকল সন্তানাদির জন্ম হয়েছিল। সাহেবজাদাগণ সবাই দুগ্ধ পান কালেই মারা যান। বর্ণিত আছে যে, কাসিম ২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। কন্যাগণ হুজুর সা. এর উপর ঈমান আনেন, তাঁর অনুস্মরণ করেন, তাঁর সাথে হিজরত করেন। কারো কারো মতে আব্দুল্লাহ ছাড়া সবাই নবুওয়াতের পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেদের মধ্যে সবার বড় ছিলেন কাসিম, অতঃপর ত্বায়্যিব, তারপর ত্বাহির। কন্যাদের মধ্যে সবার বড় ছিলেন হযরত জায়নাব, অতঃপর রুক্বাইয়্যা। কারো কারো মতে সবার বড় হলেন রুক্বাইয়্যা এরপর জায়নাব। তৃতীয় হলেন হযরত ফাতিমা রা. এরপর হযরত উম্মে কলসুম রা.। এক বর্ণনা মতে হযরত ফাতিমা রা. হলেন সবার ছোট।
এ সকল সন্তানাদি মক্কা মুকাররামায় হযরত খাদিজা রা. এর গর্ভ হতে জন্মগ্রহণ করেন।
মদীনায় এক ছেলে ইব্রাহীম হুজুর সা. এর বাঁদী মারিয়অ কিবত্বিয়ার গর্ভে জন্ম লাভ করেন। সেখানেই তিনি জন্মের সতের দিনের মাথায় মৃত্যুবরণ করেন। হযরত ফাতিমা রা. ছাড়া হুজুরে আকরাম সা. এর সকল আওলাদই তাঁর পূর্বে ইন্তেকাল করেন। হযরত ফাতিমা রা. হযরত সা. এর ইন্তেকালের ছয় মাস পরে ইন্তেকাল করেন।
হুজুর সা. এর কন্যাগণের বিবাহ ও তাদের সন্তানাদির বিবরণ
১. হযরত জায়নাব রা.: হযরত জায়নাব রা. এর বিবাহ আবুল আ’স বিন রাবী বিন আব্দুল উজ্জা বিন আবদে শামস এর সাথে হয়েছিল। তিনি তাঁর খালাত ভাই ছিলেন। তাঁর আম্মার নাম ছিল হালা বিনতে খুওয়াইলিদ, যিনি হযরত খাদিজা রা. এর বোন ছিলেন। এ বিবাহের সিদ্ধান্ত হযরত খাদিজা রা. ই হুজুরে আকরাম সা. কে দিয়েছিলেন। হুজুর আকরাম সা. তাঁর সিদ্ধান্তের বিরোধিতাকে পছন্দ করতেন না। এ বিবাহ ওহী অবতরণের পূর্বে হয়েছিল। হযরত আবুল আ’স রা. ব্যবসা বাণিজ্যে, সত্যবাদীতায় পবিত্র মক্কা নগরীর বিশেষ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পরিগণিত হতেন।
যখন নবী আকরাম সা. কুরাইশবাসীর সামনে পবিত্র ইসলাম পেশ করলেন তখন তারা আবুল আসের কাছে এসে বলল যে, তুমি তোমার স্ত্রীকে ছেড়ে দাও। তুমি যাকে চাইবে, আমরা তার সাথে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করব। তখন তিনি উত্তর দিলেন: আমি কিছুতেই তাকে ছাড়তে পারব না। বিনিময়ে কুরাইশগোত্রের যত শ্রেষ্ঠ কন্যাই হোক না কেন, আমি তা চাইনা। আবুল আসের কাছ থেকে হযরত জায়নাবের এক ছেলে ‘আলী’ জন্মগ্রহণ করেন। যিনি শৈশবেই মারা যান। এক মেয়ে ‘উমামা’ জন্মগ্রহণ করেন, যাকে নামাজে থাকা অবস্থায় হুজুর সা. কুলে উঠায়েছিলেন। তিনি জীবিত ছিলেন। হযরত ফাতিমা রা. এর ইন্তেকালের পরে হযরত আলী রা. তাকে শাদী করেছিলেন। তিনি থাকাবস্থায় হযরত আলী রা. আহত হোন এবং শহীদ হয়ে যান। অতঃপর হযরত মুগিরা রা. বিন হারিস বিন আব্দুল মুত্তালিব তাকে শাদী করেন। তার কাছেই তিনি ইন্তেকাল করেন।
হযরত ফাতিমা রা.: তাকে হযরত আলী রা. বিবাহ করেন। তাঁর উদর থেকে তিন সন্তান হাসান, হুসাইন, মুহসিন জন্মগ্রহণ করেন। হযরত মুহসিন শিশুকালেই ইন্তেকাল করেন। তিন কন্যা রুক্বাইয়্যা, জয়নাব, উম্মে কলসুম জন্মগ্রহণ করেন। রুক্বাইয়া ছোট কালে ইন্তেকাল করেন।
হযরত উম্মে কলসুম রা.: হযরত উম্মে কলসুম রা. কে হযরত উসমান বিন আফফান রা. শাদী করেন হযরত রুক্বাইয়্য রা. এর ইন্তেকালের পরে। তিনি এর পূর্বে উতবা বিন আবি লাহাব এর ভাই উতায়বা বিন আবি লাহাবের সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। যখন সূরা লাহাব অবতীর্ণ হল, তখন আবু লাহাব তার দু’ছেলেকে তাদের সহধর্মীনি হযরত উম্মে কলসুম রা. ও হযরত রুক্বাইয়্য রা. কে তালাক দিতে চাপ সৃষ্টি করলে তারা তালাক দিয়ে দেয়।
হযরত উম্মে কলসুম রা. এর মৃত্যু ৯ হিজরি সনের শাবান মাসে হযরত উসমান রা. এর সংসারে থাকাবস্থায় হয়েছিল। হুজুর সা. বলেছিলেন, হে উসমান আমার যদি আরেকটি কন্যা সন্তান হতো, তাহলে তাঁকেও তোমার কাছে শাদী দিয়ে দিতাম।
নবী করীম সা. এর চাচা এবং ফুফুগণ: হুজুর সা. এর ১১ জন চাচা ছিলেন। ১. হারিসঃ তার জন্যই আব্দুল মুত্তালিবের কুনিয়াত আবুল হারিস ছিল। ২. ক্বাছাম, যিনি ছোট কালেই মারা গিয়েছিলেন। ৩. হযরত জুবাইর রা. তিনি কুরাইশদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত ছিলেন। তাঁর সাহেবজাদা হলেন হযরত আব্দুল্লাহ বিন জুবাইর রা.। ৪. হযরত হামজাহ রা. বিন আব্দুল মুত্তালিব। যিনি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল সা. এর সিংহ বলে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁর কুনিয়াত আবু উমারাহ ছিল। তিনি হুজুর সা.’র দুধ ভাই ছিলেন। তাঁর মাত্র এক কন্যা সন্তান ছিল। ৫. আবুল ফজল আব্বাস রা. তিনি মদীনা ত্বায়্যিবায় হিজরত করেন। তাঁর বয়স হুজুর সা. থেকে তিন বছর বেশি ছিল। তাঁর কয়েকজন কন্যা সন্তান ছিলেন। বড় ছেলের নাম আল ফজল। এজন্যই তাঁর কুনিয়াত আবুল ফজল ছিল। জমজমের কর্তৃত্ব এবং পানি পান করানোর মহান দায়িত্ব তাদের স্কন্ধে অর্পিত ছিল। পবিত্র মক্কা বিজয়ের দিন হুজুর সা. তাঁকে এ দায়িত্ব অর্পন করেছিলেন। ৩৪ হিজরি সনে হযরত উসমান রা. এর খেলাফতের যোগে তিনি ইন্তেকাল করেন। শেষ বয়সে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ৬. চাচা আবু তালিব তার নাম আবদে মনাফ ছিল। হুজুর সা. পিতা আব্দুল্লাহ এবং ফুফু আতিফা রা. যার “স্বপ্ন” বদরের যুদ্ধ বলে প্রসিদ্ধ। এ দুনুজনের মা শরীক ভাই ছিলেন। তার মায়ের নাম ফাতিমা বিনতে আমর বিন আয়িজ বিন আমর বিন মাখজুম ছিল। ৭. আবু লাহাব তার নাম আব্দুল উজ্জা ছিল। চেহারা খুব সুন্দর হওয়াতে তার পিতা তার নাম আবু লাহাব রেখেছিলেন। তার সন্তানাদির মধ্যে উতবা, মা’তাব এবং ওরাহ ও তিন জন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ৮. আব্দুল কা’বা। ৯. হাজাল যার নাম ছিল মুগিরা। ১০. জেরার, তিনি আব্বাস রা. এর মা শরীক ভাই ছিলেন। ১১তম চাচা হলেন গাইজাক্ব। তিনি এ নামে এজন্য প্রসিদ্ধ লাভ করেন যে, কুরাইশদের মধ্যে তিনি সবচাইতে বেশি সম্মানী এবং লোকদেরকে বেশি বেশি করে খানা খাওয়াতেন। ইবনে মাজায় হযরত আলী বিন ছালেহ হতে বর্ণিত যে, আব্দুল মুত্তালিবেরন দশ জন ছেলে ছিলেন। প্রত্যেকেই ছাগলের ২ বছরী বাচ্চা ‘জাজআ’ খেতেন।
সম্মানিতা ফুফুগণ: হুজুর সা. এর ছয় জন ফুফু ছিলেন। ১. হযরত সাফিয়া রা. বিনতে আব্দুল মুত্তালিব। হযরত উমর রা. এর খেলাফতের যমানায় মদীনা ত্বায়্যিবায় তাঁর ইন্তেকাল হয়। তিনি হযরত হামজাহ রা. এর মা শরীক বোন ছিলেন। ২. আতিকা রা. তিনি আবু উমাইয়্যা বিন মুগিরা বিন আব্দুল্লাহ বিন মাখজুম এর সহধর্মিনী ছিলেন। ৩. আরওয়া যার শাদী উমাইর বিন ওয়াহাব বিন আব্দুদদার বিন কুসাই এর সাথে হয়েছিল। তাঁর ছেলে তুলাইব বিন উমাইর প্রথম স্তরের মুহাজিরীনদের মধ্যে ছিলেন। বদরের যুদ্ধে শরীক হয়েছিলেন। ৪. উমাইয়া বিনতে আব্দুল মুত্তালিব, যিনি জাহাশ বিন রবাবের স্ত্রী ছিলেন। তা থেকে আব্দুল্লাহ নামে একজন সন্তান জন্ম নিয়েছিলেন। যিনি ওহুদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। ৫. বররা রা. তিনি আব্দুল আসাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন আমার বিন মাখজুম এর স্ত্রী ছিলেন। তা থেকে আবু সালমা জন্ম নিয়েছিলেন। যার নাম আব্দুল্লাহ ছিল। তিনি হুজুর এর পতিœ মহোদয় হযরত উম্মে সালমা রা. এর প্রথম স্বামী ছিলেন। আব্দুল আসাদের পরে তাকে আবু রাহাম বিন আব্দুল উজ্জা বিন আবি ক্বায়েস শাদী করেছিলেন। তা থেকে আবু সাবরা বিন আবি রাহাম জন্মগ্রহণ করেন।
৬ষ্ঠ ফুফু হলেন উম্মে হাকিম বায়জ্বা। তিনি কুরাইজ বিন রাবিয়া বিন হাবীব বিন আবদে শামস বিন আবদে মনাফ এর স্ত্রী ছিলেন। তা থেকে আরওয়া বিন কুরাইজ জন্ম গ্রহণ করেন, যিনি হযরত উসমান বিন আফফান রা. এর মাতা ছিলেন। “দাস দাসিনী” যাদেরকে হুজুর সা. আযাদ করে দিয়েছিলেন।
হুজুর সা. ৩১ জন পুরুষকে আযাদ করে দিয়েছিলেন। ১. জায়দ বিন আল হারিস বিন মারাহিল কালবী। তিনি হযরত খাদিজা রা. এর গুলাম ছিলেন। হুজুর সা. তাকে আযাদ করে দিলেন। ২. উসামা বিন জায়দ রা.। ৩. ছওবান বিন বজদুদ রা.। ৪. আবু কাবশা রা.। হযরত উমর রা. খেলাফতের পূর্বের দিন তাঁর ইন্তেকাল হয়। ৫. উনাইসা রা. ৬. শাক্বরান রা. তার নাম সালেহ ও বলা হয়েছে। ৭. রাবাহ আসওয়াদ নাওবী রা. তাকে হুজুর সা. ওয়াফদে আব্দে ক্বায়েস রা. থেকে ক্রয় করে আযাদ করে নিয়েছিলেন। ৮. ইয়াসার নাওবী রা.। ৯. আবু রাফে রা.। তিনি হযরত আব্বাস রা. এর শুনাম