মুহাম্মদ নোমান :
সিরিয়া আজ রক্তাক্ত। হালব মৃত্যুপুরী। অসংখ্য নবী-রাসুল, সাহাবা ও ইমামদের স্মৃতিবিজড়িত পুণ্যভূমি। কয়েকবছর যাবৎ সিরিয়ায় চলছে ত্রিমুখী সংঘর্ষ। কারা সেখানে লড়ছে? কেন লড়ছে? সৌদি আরব ও তুরস্ক সুন্নি হয়েও সুন্নিদের রক্ত নিয়ে হোলিখেলায় মেতে উঠছে কেন? দুনিয়ার তাবৎ শক্তি এখানে কেন লড়ছে?
এসব জানতে পড়ুন :
হালব। বিধ্বস্ত রক্তাত্ত এক ভীতিকর জনপদ। দীর্ঘ চার বছর কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে টিকে থেকেও শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল। রাশিয়ানরা, সিরিয়ার সরকারি বাহিনী আর ইরানী মিলিশিয়ারা পোড়ামাটিনীতি গ্রহণ করেছে। যে কোন মুল্যে তারা হালবের দখল নিতে চায়। দামেস্কের পর হালবের দখল নিতে পারা মানে সিরিয়া যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেয়া। আসাদ নিজেও জানে যে, শেষ পর্যন্ত একটা রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে হবে। কেবল সামরিক পর্যায়ে সংকটের সমাধান করা অসম্ভব। তাই আলোচনার টেবিলে বসার আগে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোর দখল নিয়ে নিজের অবস্থান মজবুত করতে চায়। যাতে আলোচনার টেবিলে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে অধিকতর সুবিধা লাভ করা যায়।
গোটা সিরিয়া এখন একটা মাইনফিল্ড। প্রতি ইঞ্চি জায়গা যেখানে মৃত্যুর হাতছানি দিচ্ছে। এখানে শত্রু-মিত্র পার্থক্য করা দুরূহ ব্যাপার। সিরিয়া যুদ্ধকে আমরা যতটা সহজ মনে করছি আদতে তা নয়। এটি কেবল একটি সরকারের সাথে বিদ্রোহীদের লড়াই নয়। এখানে লড়াই করছে দুনিয়ার তাবৎ শক্তি। কেউ বা সরাসরি আবার কেউ প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত। ইসরাইল থেকে নিয়ে বেলজিয়াম সুইডেন পর্যন্ত যেখানে সক্রিয়। আমেরিকান, ব্রিটিশ, ফরাসী, জার্মান ও সুইডিশ যুদ্ধবিমানগুলো রাশিয়ান ফাইটারগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ছে। নিচে হিজবুল্লাহ আর ইরানী শিয়া মিলিশিয়াগুলো নেকড়ের মতো হন্য হয়ে ছুটছে। তথ্যমতে আসাদের পক্ষে যারা যুদ্ধ করছে তাদের মধ্যে মাত্র পঁচিশ শতাংশ হচ্ছে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী। বাকী পঁচাত্তর শতাংশ ইরানী বিপ্লবী গার্ডের সদস্য আর হিজবুল্লাহসহ বিভিন্ন শিয়া মিলিশিয়াগ্রুপ। এখানে আসাদ একটি ঘুঁটি মাত্র। সাংবাদিকদের সামনে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে হাজির হওয়া ছাড়া তার আর তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ নেই। আসল খেলোয়াড় ইরান। যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে তেহরানে, খামেনীর প্রাসাদে। এটি আসাদকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ নয়, বরং ইরানীদের স্বপ্নের বৃহত্তর পারসিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। ইসরাইলের অস্তিত্ব চিরকালের জন্য নিষ্কণ্টক করার যুদ্ধ। একশ বছরের পুরনো সাইক্স-পিক্ট চুক্তিকে পূনরায় ঢেলে সাজানোর যুদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে আরেকবার ছুরি চালানোর যুদ্ধ। বিশ্বরাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তিত হচ্ছে খুব দ্রুতগতিতে। নতুন নতুন সমীকরণ হচ্ছে। তার প্রভাব পড়ছে মধ্যপ্রাচ্যে। প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বার্থে খেলছে। প্রতিনিয়ত শত্রু মিত্রের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হচ্ছে। মাঝখানে বলির পাটা হচ্ছে সিরিয়ার নিরীহ জনগণ।
২০১২ সালের শেষের দিকে বিদ্রোহীরা দামেস্কের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলো। তাদের কামানের গোলা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের প্রতিরক্ষা দেয়ালে আঘাত হানছিল। মাহের আল আসাদ নিহত হয়। দামেস্কের পতন হয়ে দাঁড়ালো সময়ের ব্যাপার। কিন্তু না, তা হয়নি। হঠাৎ যুদ্ধের মোড় পাল্টাতে লাগল। দামেস্কের উপর বিদ্রোহীদের চাপ ধীরে ধীরে শিতিল হয়ে আসল। বিজিত অঞ্চল ধরে রাখাই তখন তাদের জন্য মুশকিল হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু কেন সিরিয়া সংকট সমাধানের দোরগোড়ায় পৌঁছেও ইউটার্ন নিল? দুই মাসে শেষ হতে যাওয়া একটি ইস্যুকে কারা পাঁচ বছর পেছনে ঠেলে দিল? ছয় লক্ষ সিরিয়াবাসী কাদের বলির পাটা হল?
সিরিয়া সংকটের শুরু থেকে নিয়ে এই পর্যন্ত চলে আসা ঘটনাপঞ্জির উপর একটি প্যানোরমা দৃষ্টি দিলে সংকটের পক্ষ-বিপক্ষ এবং কারা এর জন্য দায়ী তাদের একটা মোটামুটি লিস্ট এসে যায়।
(১) ইসরাইল ও পশ্চিমা বিশ্ব :
সিরিয়া সংকটের জন্য ইসরাইল ও মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব সবচেয়ে বেশী দায়ী। শুরু থেকেই তারা আরব বিপ্লবের পক্ষে ছিলনা। তিউনিসিয়া আর মিসরের বিপ্লব এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, সেখানে বাহ্যিক সমর্থন না দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তারা যখন বুঝতে পারল যে, মোবারক আর বেন আলীর টিকে থাকা সম্ভব নয়, তখন সুর পাল্টায়। বিপ্লবের পক্ষে মেকি সমর্থন ব্যক্ত করে। পশ্চিমাদের প্র্যাগম্যাটিক রাজনীতির ভয়ংকর দিক হচ্ছে দুটি। তারা কখনো দুর্বল আর অকেজো মিত্রকে বলি দিতে কার্পণ্য করে না আর সংকটের সব পক্ষের উপর নিজেদের প্রভাব ধরে রাখে। যাতে ঘটনা যেদিকেই মোড় নিক তাদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন থাকে। মিসর আর তিউনিসিয়ার বিপ্লবের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা বিপ্লবে সমর্থন দেয়। এতে তারা নতুন রাষ্ট্রশক্তিকে নিজেদের আয়ত্তে রাখতে সমর্থ হয় আবার গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি হিসেবে নিজেদের ভাবমূর্তিও অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু তখন থেকেই ইখওয়ান আর সমমনা ইসলামী দলগুলোকে ধংস করার ছক আঁকতে শুরু করে। এখানে পশ্চিমারা ফ্রন্ট লাইনে থাকলেও পর্দার আড়ালে সব কলকাটি নাড়ছিল ইসরাইল। এক তুরস্ক নিয়ে তাদের মাথাব্যথার শেষ নাই। হামাসকে হজম করতে হিমশিম খেতে হচ্ছ। তার উপর আবার আরব বিশ্বের শাসনদণ্ড ইসলামপন্থীদের হাতে যাওয়া মানে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। তাই তারা মরিয়া হয়ে এই জোয়ার ঠেকানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে। নির্বাচিত হবার মাত্র এক বছরের মাথায় প্রেসিডেন্ট মুরসির পতন ঘটে। আর সদ্য অভ্যুত্থানকারী জান্তা সরকারের সব অপকর্মের বৈধতা দিয়ে দেয়ার ঠিকাদারি নেয় ইসরাইল। ইহুদী মিডিয়া টাইকুন রোপারড মারডকের মিডিয়া সাম্রাজ্য এবং অন্যান্য ইহুদী লবীর বদৌলতে সিসি তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে সক্ষম হয়। ইখওয়ানের ঘুরে দাঁড়ানোর সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
মিসরের বিপ্লবী শক্তির পতনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি লাগে সিরিয়ার গণআন্দোলনে। তারা চরমভাবে হতাশ হয়ে পড়ে। তাদের বুঝতে বাকী থাকে না যে, তারা এক কঠিন ও অসম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। যেখানে আসাদ হচ্ছ সারফেসে ভেসে উঠা ডুবুচরের চূড়া। মূল শেকড় আরও অনেক গভীরে। আরও ভয়ংকর। কিন্তু তখন আর পিছিয়ে আসার সুযোগ ছিল না। ইসরাইল সরাসরি ঘোষণা করল, তারা আসাদের পতন মেনে নিবে না। “হয় আসাদ, আর না হয় কেউ নয়”। পঞ্চাশ বছর ধরে ইসরাইলের দখলে থাকা গোলান মালভূমিতে যে একটি গুলিও ছুড়েনি তাকে টিকিয়ে রাখা তো তাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তাছাড়া ইসরাইল দিব্যি চোখেই দেখতে পাচ্ছে আসাদের পর ইসলামপন্থীরাই দামেস্কের ক্ষমতায় আসবে। তাই আর মিসরের ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চায়নি। অতএব, যা হবার তাই হল।
ইসরাইলের সুরক্ষা নিশ্চিত করা তো আছেই, তবে পশ্চিমা জোটের পরিকল্পনা এক্ষেত্রে আরও গভীর ও সুদূরপ্রসারী। দুইটি লক্ষ্য নিয়ে তারা অগ্রসর হয়। প্রথমতঃ তুরস্ক-সৌদির প্রভাবাধীন সুন্নি রাষ্ট্রগুলোকে ধ্বংস করা। অথবা যতটুকু পারা যায় দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় করা। বিপরীতে ইরানের নেতৃত্বাধীন শিয়া জোটকে শক্তিশালী করা। এর কারণ, শিয়া জোট আর সুন্নি জোটের শক্তির ব্যাবধান কমানো, যাতে দীর্ঘমেয়াদী শিয়া-সুন্নি যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যায়। শিয়া শক্তিকে সামনে নিয়ে আসার আরেকটি কারণ হচ্ছ, ইরান তাদেরকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, সুন্নিরাই কেবল জিহাদি চিন্তাধারা লালন করে। শিয়ারা জাতিগতভাবেই শান্তিপ্রিয়। তারা আল কায়েদা আর আইএস কে উদাহরণ হিসেবে পেশ করে। পশ্চিমা থিংকট্যাংকগুলোও এই নীতি সমর্থন করে।
তাদের দ্বিতীয় লক্ষ্য হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে আরেকবার ছুরি চালানো। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে সাইক্স-পিক্ট চুক্তির অধীনে প্রণীত একশ বছরের পুরনো মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র এখন তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছেনা। আর তাই তুরস্ক, ইরাক আর সিরিয়াকে ভেঙ্গে নতুন কুর্দি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে আরেক ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সৌদি, বাহরাইন আর ইয়েমেনে শিয়াদের প্রভাব বাড়িয়ে আরও একাধিক শিয়া রাষ্ট্রের জন্ম দিতে চায়। এভাবেই ইসরাইল আর পশ্চিমারা ভাংগা গড়ার এক ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠে। তুরস্ক আর সৌদি তাদের বিপদ বুঝতে পেরে এখনন অস্তিত্বের লড়াই লড়ছে।
(২) আরব শাসকবর্গের স্থূল চিন্তা
সৌদি নেতৃত্বাধীন আরব দেশগুলো শুরু থেকেই আরব বিপ্লবের বিরোধিতায় নামে। একমাত্র কাতারই ছিল ব্যাতিক্রম। মিসরের বিপ্লবী শক্তিকে ধংস করার জন্য তারা সম্ভাব্য সবকিছুই করে। সামরিক অভ্যুত্থানে প্রত্যক্ষ মদদ দেয়। ইরান ইসরাইল নয়, আরবের স্বাধীনতাকামী জনগণই তাদের মসনদের জন্য আসল হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। স্বাভাবিকভাবেই বিপ্লবী জনতার নেতৃত্বে থাকা ইখওয়ানই হয়ে উঠে তাদের চক্ষুশূল। যেকোনো মুল্যে ইখওয়ানের পতন ঘটানো তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এবং তারা তা করতে সক্ষমও হয়। ২০১২ সালের ৩ই জুলাই মুরসির পতন ঘটেনি, বরং সেই সাথে সিরিয়ার গণআন্দোলনের ভাগ্যই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। যখন গর্দভ আরব শাসকেরা সুন্নি সামাজিক শক্তিগুলোকে নির্মূল করছিলো, তখন বিপরীতে ইরান শিয়া উপদলগুলোকে জড়ো করছিল আর সামরিক ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি ব্রেইন ওয়াশের মাধ্যমে প্রত্যেকটা যোদ্ধাকে জীবন্ত মাইনে রুপান্তর করছিল। এভাবেই ইরান তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাগদাদ থেকে বৈরুত, সানা থেকে দামেস্ক পর্যন্ত ইরানী পতাকা পতপত করে উড়তে থাকে। ইরানী র্যাবমবো জেনারেল কাসেম সুলাইমানি ফালুজা থেকে আল আনবার, দামেস্ক থেকে মসুল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভুমি চষে ফিরতে থাকে। ইয়েমেনে আরব আমিরাতের প্রত্যক্ষ মদদে ইখওয়ান সমর্থিত শক্তিকে কোণঠাসা করা হয়। অথচ ইখওয়ানই হতে পারত ইরানের মোকাবেলায় আরবদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সামাজিকভাবে শিয়া প্রভাব ঠেকানোর কার্যকর উপায়। কিন্তু তাদের তৈলাক্ত মাথা এই সহজ সমীকরণটি বুঝার যোগ্য ছিলনা। ফল যা হবার তাই হল। সানা থেকে সুন্নি শক্তিকে নির্মূল করা হল আর হাউছি শিয়ারা এখন হারামাইনের উপর তাদের গরম নিঃশ্বাস ফেলছে।
সিরিয়া সংকটের জন্য পশ্চিমারা যতটুকু দায়ী আরব দেশগুলো ঠিক ততটুকুই দায়ী। হয়তো তার চেয়েও বেশী। জানিনা বাদশাহ আব্দুল্লাহ যে ভুল করে গেছেন তার প্রায়শ্চিত্ত করতে উম্মাহকে কতো মুল্য দিতে হয়?!
(৩) বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বিপ্লব ব্যর্থ হবার বড় একটি কারণ। তারা পঞ্চাশটিরও বেশী উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রত্যেক দল নিজেদেরকেই একমাত্র মুখলিস বিপ্লবী মনে করতে থাকে। কখনো কখনো তাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের রূপ নিত। প্রধানত তুর্কি, সৌদি আর মার্কিন, এই তিন ব্লগে তারা বিভক্ত হয়ে পড়ে। তুরস্ক শত চেষ্টা করেও তাদেরকে এক প্লাটফর্মে আনতে ব্যর্থ হয়। বিপরীতে শিয়া উপদলগুলো ইরানের একক নেতৃত্বে ময়দানে নামে। ফল যা হবার তাই হল।
(৪) আইএস এর উত্থান সিরিয়া বিপ্লবের মোড়কে পুরোপুরিভাবে ঘুরিয়ে দেয়। পশ্চিমারা তো এমনিতেই বিপ্লবের পক্ষে ছিলনা। এখন তারা বিরাট বাহানা খুঁজে পায়। আসাদ নয়, আইএস কে ধংস করাই তাদের বাহ্যিক লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। সিরিয়াবাসির মুক্তির লড়াইকে হ্যাক করে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের রূপ দেয়া হয়। সিরিয় বিদ্রোহীদেরকে আইএসের বিপক্ষে দাঁড় করে দিয়ে দামেস্কে আসাদের অবস্থানকে সুকৌশলে মজবুত করে দেয়া হয়। বিদ্রোহী যোদ্ধাদের মধ্যে দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা। কোন ফ্রন্টে তাদের লড়াই করা উচিত তা বুঝতে পারছিলনা। শেষ পর্যন্ত সরকারি বাহিনী আর আইএস দুই ফ্রন্টেই তাদেরকে একই সময়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। বিভক্তি আর আত্মকলহ পূর্ব থেকেই তাদেরকে দুর্বল করে দিয়েছিল। আর এখন দ্বিমুখী লড়াই তাদের শেষ শক্তিটুকুও নিঃশেষ করে দেয়। ফল যা হবার তাই হল। আর নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হল যে, আইএস ট্রয় নগরীর কাঠের ঘোড়া ছাড়া আর কিছুই নয়।
(৫) সিরিয় সংকটে রাশিয়ার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছিল বিপ্লবের কফিনে সর্বশেষ পেরেক টোকার মত। মধ্যপ্রাচ্যে লিবিয়া হাতছাড়া হওয়ার পর একমাত্র সিরিয়া ছাড়া তাদের কদম ফেলার আর কোন জায়গা নেই। যদি সিরিয়াও তাদের হাতছাড়া হয় তাহলে পুতিনের বৃহত্তর জার সম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন ধুলিস্যাত হয়ে যাবে। সিরিয়ার তরতুসে অবস্থিত রাশিয়ার নৌঘাঁটির ভবিষ্যৎ চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে। আসাদও বুঝতে পারলো যে, তার মসনদ রক্ষা করার জন্য কেবল ইরানীরা যথেষ্ট নয়। অতএব রাশিয়ান শ্বেত ভল্লুকদের ডেকে নিয়ে আসলো। রাশিয়ার প্রচণ্ড বিমান হামলার মুখে বিদ্রোহীদের টিকে থাকা অসম্ভব ছিল। যদি তাদেরকে বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করা হতো তাহলে হয়তো যুদ্ধের মোড় কিছুটা ঘুরানো সম্ভব হতো। কিন্তু আমেরিকা এক্ষেত্রে বেঁকে বসে। তারা এই সব অস্ত্র আইএসের হাতে চলে যাবার ভয় দেখায়। তুরস্ক অনেক তদবির করেও পশ্চিমাদেরকে রাজী করাতে পারেনি। পরে তুরস্ক উত্তর সিরিয়ায় নো ফ্লাই জোন গঠন করার দাবী জানায়। কিন্তু আমেরিকা এখানেও ভেটো দেয়। আর রাশিয়ান বিমান শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও তুরস্কের হাতে নেই। ফলে রাশিয়ার বিমান হামলার ছত্রছায়ায় সরকারি বাহিনী আর শিয়া মিলিশিয়া গ্রুপগুলো একটির পর একটি বিদ্রোহী এলাকার দখল নিতে থাকে।
হালবের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠছে। কিন্তু এই কান্নার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে অনেক দিন আগে। সম্ভবত কায়রোতে। হালবের কান্না রাবেয়া স্কয়ারের কান্নারই ধারাবাহিকতা মাত্র।
মুহাম্মদ নোমান, কায়রো, মিসর
সম্পাদনায় : মুহিউদ্দীন কাসেমী