কুতায়বা আহসান :
– মিশর থেকে কুস্তুনতুনিয়া যাবার পথে সুলতান সেলিম কুস্তুনতুনিয়ারই পার্শ্ববর্তী আনাতুলিয়ার এক প্রশস্ত মাঠে শিবির পেতে বিরাম নিচ্ছিলেন। সুলতান তাঁর খিমায় বসে ওজীরে আযম মুহাম্মদের সাথে কোনো এক বিষয়ে গভীর আলোচনায় ছিলেন। ঠিক সে সময় জনৈক রক্ষী খিমার দরজার সামনে এসে উপস্থিত হলো।
– সুলতান তার দিকে তাকিয়ে হাত ইশারায় তাকে ভেতরে চলে আসতে বললেন।
– রক্ষী এগিয়ে এসে ইহতেরাম বজায় রেখে তাঁর সামনে বসে পড়ল, এরপর বলল: মুহতারাম আকা! এইমাত্র আফ্রিকা থেকে আমীর খাইরুদ্দীন বারবারুসার পক্ষ থেকে দু’জন কাসেদ আমাদের তাঁবু এলাকায় এসে ঢুকেছেন। তাঁরা এখনই আপনার খেদমতে হাজিরা দিতে চান। তাঁদের কাছে নাকি আমীর খাইরুদ্দীনের পক্ষ থেকে জরুরী পয়গাম রয়েছে।
– রক্ষীর কথা শুনে সুলতান তাঁর ওজীরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। এরপর রক্ষীকে উদ্দেশ্য করে বললেন:
– তুমি একটুক্ষণ খিমার বাইরে গিয়ে দাঁড়াও। আমি ওজীরে আযমের সাথে একটু পরামর্শ করে নিই।
– রক্ষী খিমা থেকে বেরিয়ে গেল। সুলতান তাঁর পাশে থাকা ওজীরে আযমকে লক্ষ করে বললেন:
– “আমার আজীজ! রক্ষী যা বলে গেল তা আমি যেমন শুনেছি তুমিও শুনেছ। খাইরুদ্দীন বারবারুসার নাম আমার কাছে যেমন আজনবী নয় তেমনি তোমার কাছেও নয়। জাতির মঙ্গলের লক্ষে সাগরে তাঁর ও তাঁর ভাইদের নিঃস্বার্থ ত্যাগ এবং কুরবানী সত্যিই প্রশংসাযোগ্য। তোমার ধারণায় তাঁর পক্ষ থেকে কাসিদ আমার কাছে কী মাকসাদ নিয়ে আসতে পারে?
– মুহাম্মাদ কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে অত্যন্ত ইহতেরাম ও আস্থার সাথে বলতে লাগলেন:
– “সুলতানে মুহতারাম! এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ নেই অতীতে বারবারুসা ভ্রাতৃদ্বয় সাগরে ভয়ঙ্কর নিরব ও উর্মীমুখর পরিবেশে বারবার ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুদের উপর বজ্রপাতের মতো বিধ্বংসী আজাব হয়ে নিপতীত হয়েছেন। খাইরুদ্দীনও তাঁর ভ্রাতৃবৃন্দের পথ অনুসরণ করেই দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। সাগরে ইউরোপীয় ডাকাতগুলোকে সমুচিত শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। জীবন বাজি রেখে নির্যাতীত আন্দালুসীয় মুসলমানকে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছিয়ে দেয়ার মহান ব্রত পালন করে যাচ্ছেন। শত্রুর আক্রমণকে সাগরের নীল জলে তলিয়ে দিয়ে আফ্রিকার উপকুলীয় অঞ্চলের হেফাযতের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে চলছেন।
– এটুকু বলার পর মুহাম্মাদ তাঁর কথার ধারা জারি রেখে বলে যেতে লাগলেন:
– সুলতানে মুহতারাম! আমার মনে হচ্ছে খাইরুদ্দীন তার আকাশ-উঁচু মাকসাদ আর সাহারা-বিস্তৃত কর্মকাণ্ডে কোনো সমস্যার সম্মুখিন হয়েছেন। সম্ভবত তাঁর শত্রুরা তাঁর এগিয়ে যাবার পথে বাঁধার পর্বত তুলে দাঁড়িয়েছে। আর সে অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যই তিনি আপনার কাছে সাহায্যের জন্য কাসেদ পাঠিয়েছেন। তবে এটা আমার ধারণা মাত্র। বাস্তবতা ভিন্নও হতে পারে।
– মুহতারাম সুলতান! যদিও এখনো আমরা জানি না, ওরা কী পয়গাম নিয়ে এসেছেন এবং আপনিও আমার কাছে জানতে চাননি যে, আমার ধারণা বাস্তব হলে আমাদের জন্য কী ব্যবস্থাগ্রহণ জরুরী— তথাপি আমি স্বপ্রণোদিত হয়েই বলছি: মিল্লাতের এই নিঃস্বার্থ মুজাহিদ, শত্রুর উপর মৃত্যুর বিভিষিকা হয়ে আপতিত হওয়া এই মর্দে মুমীনদের নিরাশ করা সমীচীন হবে না। সুলতানে মুহতারাম ———! মুহাম্মাদ আর আগাতে পারলেন না। কারণ তিনি দেখতে পেলেন সুলতান সেলিম তাঁর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন এবং তিনি কিছু বলতে চাইছেন। সুতরাং তিনি ওখানেই নীরব হয়ে গেলেন।
– আমার আজীজ! তোমাকে আর বলতে হবে না। তুমি যা বলতে চাচ্ছ তা আমি বুঝে ফেলেছি। তুমি নিশ্চিত থাকো যদি খাইরুদ্দীনের পয়গামে সাহায্যের আবেদন থাকে তাহলে অবশ্যই আমি তাঁকে হতাশ করবো না। এবার তুমি রক্ষীকে ডেকে বল সে যেন কাসিদদ্বয়কে আমার কাছে এখানে নিয়ে আসে।
– মুহাম্মদ রক্ষীর নাম ধরে ডাক দিতেই সে দৌড়ে খিমার ভেতরে চলে আসলো। সে খিমার বাইরে পাশেই দাঁড়ানো ছিল। মুহাম্মাদ তাকে বললেন: যাও! তুমি কাসিদদ্বয়কে নিয়ে এসো। রক্ষী মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল। এরপর অত্যল্প সময়ের ভেতরেই সে তাদের সুলতানের খিমায় নিয়ে এসে উপস্থিত হলো।
– ওরা খিমার ভেতর এসে ঢুকতেই সুলতান এবং তাঁর ওজীর নিজ নিজ আসন থেকে দাঁড়িয়ে মুসাফাহা করত তাঁদেরকে ইস্তেকবাল করে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে আসলেন। এরপর সুলতান ও মুহাম্মাদ নিজ নিজ আসনে বসে পড়ে তাদেরকেও সামনের শূন্য আসনে বসার অনুরোধ করলেন।
– ওরা তাদের আসনে বসে যেতেই সুলতান তাঁদেরকে লক্ষ করে বললেন:
– “তোমরা আগে তোমাদের নাম বল! তারপর কথা হবে”।
– সুলতানের কথা শুনে তাঁদের একজন বললেন:
– মুহতারাম সুলতান! আমার নাম ‘কাকাদ’, আর আমার সাথীর নাম ‘হাসান আগা’।
– কাকাদ? খুব ভালো হয়েছে একটা উপলক্ষে তোমার সাথে আমার সাক্ষাত হয়ে গেল। তবে তুমি কি সেই কাকাদ যাকে ইউরোপীয়রা ‘শয়তান শিকারী’ নামে ভীতির সাথে স্মরণ করে থাকে?
– কাকাদের চেহারায় লাজুক হাসি খেলে গেল। বললেন: সুলতানে মুহতারাম! এ আমার সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য জানি না। তবে ইউরোপীয়রা আমাকে এ নামেই ডেকে থাকে।
– সুলতান এবার দ্বিতীয় কাসিদের দিকে তাকিয়ে তাঁকে লক্ষ করে বললেন: তুমি কি ‘খাজা সারা হাসান আগা’?
– হাসান আগাও হেসে দিলেন।
– বললেন: মুহতারাম সুলতান! আমরা দেখতে পাচ্ছি আপনি আমাদের ব্যাপারে ভালোই অবহিত আছেন। জ্বি, আমিই ‘খাজা সারা হাসান আগা’।
– সুলতান এবার তাঁদের লক্ষ করে বললেন: আচ্ছা তোমাদের মধ্যে মানে তোমাদের নেতৃস্থানীয় মাল্লাদের মধ্যে ‘হাসান’ নামে আর কেউ আছে?
– এবার কাকাদ বললেন: মুহতারাম সুলতান! আমাদের সাথী তো অনেক। তবে আমীর খাইরুদ্দীন ব্যতীত নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে আমরা ছাড়া রয়েছেন ফ্যলকন অব স্পেন খ্যাত হাসান ক্রুসু। অত্যন্ত বুদ্ধীদীপ্ত ও দুঃসাহসী সালেহ। সীমাহীন মুখলিস সানআন। তা ছাড়া —–। কাকাদ আর অগ্রসর হতে পারলেন না। সুলতান তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলেন: এই সানআন কি ইহুদি?
– মুহতারাম সুলতান! একসময় তিনি ইহুদি ছিলেন। বর্তমানে কেবল নামের দিক দিয়ে ইহুদি। নতুবা তিনি ইসলামের একজন মহান শাহ সওয়ার। অসংখ্য লড়াইয়ে তাঁর ইখলাস ও জাতিপ্রেম পরীক্ষিত। তিনি আমীর খাইরুদ্দীন বারবারুসার বিশ্বস্ত ও আপনজনদের একজন।
– সুলতান কিছুটা ভেবে নিয়ে বললেন: এবার বলো তোমরা কোন পয়গাম নিয়ে আমার কাছে এসেছো?
– জবাবে কাকাদ আফ্রিকার বর্তমান অবস্থা বিস্তারিতভাবে বর্ণনার পাশাপাশি খাইরুদ্দীনের আবেদন তুলে ধরলেন।
– জবাবে সুলতান কতক্ষণ তাদের দিকে মুহাব্বাতের দৃষ্টি বুলিয়ে বললেন: আজ রাত তোমরা আমার তাঁবুর শহরে কাটাও। আগামীকাল ভোরেই আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেব। তবে এইটুকু অাশ্বাস নিয়ে নিদ্রায় যেতে পারো যে, আমি তোমাদেরকে নিরাশ করবো না। যে আশা নিয়ে তোমরা আমার কাছে এসেছো, যে আস্থায় আমীর খাইরুদ্দীন তোমাদেরকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন, আমার আল্লাহ সহায় হলে আমি এর দ্বিগুণ সাহায্য তোমারকে দেয়ার চেষ্টা করবো। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নিশ্চয় তোমরা ক্লান্ত। এবার যাও, গিয়ে বিশ্রাম গ্রহণ কর। সুলতান সেলিমের জবাব শুনে কাকাদ এবং হাসান আগা সন্তুষ্ট হয়ে গেলেন। এরপর সেই রক্ষীর পেছনে পেছনে তাঁদের জন্য নির্ধারিত বিশ্রামাগারের দিকে হাটা ধরলেন। চলবে।