শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১:২৯
Home / ইতিহাস ঐতিহ্য / সমুদ্র ঈগল ২ (খ)

সমুদ্র ঈগল ২ (খ)

কুতায়বা আহসান :

– কাহতানী সর্দার যতক্ষণ কথা বলছিলেন হাসান ক্রুসু ততক্ষণ গভীর মনোযোগ সহকারে তাঁর কথা শুনে যাচ্ছিলেন। তিনি নীরব হয়ে যাবার পর হাসান ক্রুসু বলতে শুরু করলেন:
– ‘ইবনে যুবাইর আমার ব্যাপারে আপনাদেরকে যা বলেছেন তা সম্পূর্ণ সত্য। সত্যিই আমি দুটি মাকসাদ নিয়ে আমার পিতৃপুরুষের ভূমিতে এসেছি। প্রথম উদ্দেশ্যটা হচ্ছে আমার ব্যক্তিগত, অর্থাৎ আমি আমার মা বোনের তালাশে এসেছি। তবে এ মাকসাদে আমি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি। তাঁদেরকে খুঁজে পাওয়া দূরে থাক পাবার মতো কোনো সূত্রও বের করতে পারিনি। তবে দ্বিতীয় মাকসাদটা হচ্ছে জাতীয় এবং সেটা প্রথমটির তুলনায় অনেকগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় মাকসাদের ব্যাপারে আপনারা এতটুকু জেনে নিন যে, আমি খাইরুদ্দীন বারবারুসার পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে আপনাদের কাছে এসেছি। সে হিসেবে আমি আপনাদের উভয়ের খেদমতে আবেদন রাখবো— হিস্পানিয়ার যে সমস্ত মুসলামন লুণ্ঠিত ও নির্যাতিত হচ্ছেন, বিশেষ করে রাহিব, পাদ্রী আর হিস্পানিয়ার সম্রাট চার্লস ৫ম যাদেরকে জোরপূর্বক নাসারা বানাতে চায়; অথচ তারা নাসরানিয়াত গ্রহণ না করে মুসলিম পরিচয়ে বেঁচে থাকতে চেয়ে আশ্রয়ের খুঁজে আছেন, আপনারা দয়া করে তাদের সাথে যোগাযোগ করুন। এ ব্যাপারে আমার সাথীভাই বুট্রুস আপনাদের সহায়তা করবেন। আপনারা জেনে নিশ্চয় আনন্দিত হবেন— তাঁর সাথে ফারদিশ নদীর কিনারে গড়ে ওঠা রাহিব পল্লীতে যেসব রাহিব বসবাস করছেন তাঁরা মূলত সবাই মুসলমান। তাঁরা নিজেদের পরিচয় আড়ালে রেখে আপনাদেরকে সার্বিক সহায়তা দিয়ে যাবেন। যারাই যেখানে নির্যাতিত হচ্ছে আপনারা তাঁদেরকে সে ব্যাপারে অবহিত করবেন। তাঁরা ওদরেকে জালিমের হাত থেকে উদ্ধার করে আলবাশারাতে নিয়ে আসতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাবেন। এতে আপনাদের উভয়ের সহায়তার প্রয়োজন। আপনাদেরকে তেমন চিন্তা করতে হবে না। নির্যাতিত এই লোকগুলোকে বেশি দিন আপনাদের এখানে রাখতে হবে না। রাহিবরা খুব তাড়াতাড়ি ওদেরকে সাগর তীরের জেলেপল্লীতে স্থানান্তর করবেন। আর সেখান থেকে আমরা তাদেরকে আফ্রিকায় নিয়ে যাব। আমার আশা এবং বিশ্বাস, জাতির এ দুর্দিনে আপনারা উভয়ে এ ব্যাপারে সহায়তায় এগিয়ে আসবেন’।

– হাসান ক্রুসু কথাগুলো বলে থামতেই কাহতানী সর্দার কা’ব বিন আমিরের পরিবর্তে আদনানী সর্দার সা‘দ বিন সালামা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললেন-
– প্রিয় বৎস! তুমি এ কেমন কথা বলছ? এটাতো আমাদের কাজ। এটা আমাদের উপর ফরযতুল্য। এ ব্যাপারে আমাদের সহায়তার আবেদন করা হচ্ছে কেন? তারপরও তুমি জেনে রাখো! এমন যারাই আমাদের এই আলবাশারাতে এসে আশ্রয় নেবে আমরা সর্বস্ব দিয়ে তাঁদের সহায়তা যুগিয়ে যাব। প্রয়োজনে নগদ অর্থ দিয়েও তাঁদের সাহায্য করব। অত্যন্ত গোপনে তাঁদেরকে জেলেপল্লীতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করব। এ ছাড়া আমরা ফারদিশ নদীর কিনারে বসবাসকারী রাহিববেশী আমাদের মুসলিম ভাইদেরও সহায়তা দিয়ে যাব ইনশাআল্লাহ। আমরা এখন বুঝতে পারছি এরা নাসারাদের রাহিব বেশে আমাদের জাতির গুরুত্বপূর্ণ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।

– সা‘দ বিন সালামা কথা বলে একটু থামলেন। হঠাৎ করেই তিনি যেন বিষন্ন হয়ে পড়লেন। এরপর ভারী কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন-
– বাবা হাসান! একসময় এ এলাকায় আমাদের শাসন ছিল। আমরা ছিলাম স্বাধীন। আমাদের হাতেগড়া শহরগুলো ছিল ছবির মতো সুন্দর ও ছিমছাম। কিন্তু আজ এ ভূখণ্ডের প্রতিটি জায়গায় ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের প্রেতাত্মারা অট্টহাসি দিচ্ছে। যেদিকে তাকাবে সেদিকেই কেবল ভীতি জাগানিয়া দৃশ্য চোখে ভাসবে। আজ সেই সোনার শহরগুলি উইপোকায় খাওয়া কাগজের ডিবির মতো। আমি এর জন্য কাউকে দোষারোপ করি না। আমাদের অবহেলা, আমাদের গাফিলতি আর আমাদের ভুলের জন্যই আজকের এ পরিণতি। আমরা নিজেদের শাসকরূপে ভুল মানুষগুলোকে নির্বাচিত করেছিলাম। এরা ভোগে মগ্ন হয়ে পড়েছিল। রং তামাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। ওরা তাদের অন্তর থেকে কওমের মুহাব্বাত ঐক্য ভ্রতৃত্ব থেকে দূরে সরে গিয়ে বিলাসিতায় ডুবে গিয়েছিল।

– প্রিয় বেটা! যখন কোনো কওমের ব্যক্তিগত দুর্বলতা সামষ্টিক ভুলে পরিণত হয়ে যায় তখন সে জাতি আল্লাহর অবধারিত শাস্তির হকদার হয়ে যায়। আমরাও সে অপরাধ করেছি। পরিণামে আজ সে শাস্তি ভোগ করছি। আমাদের শাসকশ্রেণি জাতির বাহু প্যারালাইজ রোগির মতো বানিয়ে ফেলেছিল। আমাদের হাতে তালোয়ার তুলে দেয়ার পরিবর্তে সূরা আর সেতার তুলে দিয়েছিল। আজ স্থানে স্থানে ইহতেসাবী আদালত গড়ে ওঠেছে। ওখানে আজ মুসলামনদেরকে জোরপূর্বক নাসারা বানিয়ে নেয়া হচ্ছে। যারা ইসলাম ছেড়ে নাসরানিয়াত গ্রহণ করে নিচ্ছে তাদেরকে সমাজে হেয় দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। উপহাসস্বরূপ তাদেরকে মরিস্কো নামে ডাকা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে নাসরানিয়াত কবুল করার পরও ওরা নিরাপদ নয়। ওদের মধ্যে যাদের অর্থসম্পদ রয়েছে রাহিবরা তাদের আদালতে এদের নামে এই অপবাদ লাগাচ্ছে যে ওরা দীল থেকে নাসরানিয়াত গ্রহণ করেনি। আর এ অজুহাতে রাহিবরা তাদের কাছ থেকে তাদের মাল-সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এরা যাতে আর কখনো মাথা তুলে দাড়াতে না পারে সে জন্য অজস্র অপবাদ লাগিয়ে তাদেরকে কারান্তরীণ করে নিচ্ছে।

– সেই প্রিয় ভূখণ্ড যেখানে আমরা একসময় রাজার হালে আর আমাদের নারীরা রাণীর হালে বসবাস করছিলাম আজ সেখানে আমাদের নারীরা যেন বৈধব্যের বসন আর শোকাহত মায়ের জামা পরে আছে। যে চোখগুলো থেকে একসময় আনন্দের দ্যুতি টিকরে বের হতো আজ সে সব চোখ থেকে বেদনার অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। আজ তারা সজল ভ্রুর গিরিপথ দিয়ে তাদের হারা অতীতকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। অনেক শিল্পী আর গুণীজনেরা কাঙালের মতো দ্বারে দ্বারে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ফিরছে। আজ প্রতিটি আন্দালুসীয় মুসলিম নর ও নারী দীলে এই তামান্না রেখে ঘুমায়, হায়! সকালে উঠে যদি এমন কোনো সালারের খুঁজ পেতাম যে সূর্যের দীপ্তি আর শক্তির পরাক্রম নিয়ে আবির্ভূত হবে। যে আমাদেরকে আমাদের হারা অতীত ফিরিয়ে দেবে। যে আমাদের ঘাড় থেকে গোলামির জিঞ্জির হটিয়ে স্বাধীনতার চাদর পরাবে। মিল্লাতের পিপাসিত আত্মাকে একটুখানি তৃপ্তি দেবে।

– সা‘দ বিন সালামা আবার একটু বিরতী নিলেন; এরপর প্রায় প্রায় কান্নাভেজা কন্ঠে বলতে লাগলেন: কিন্তু হায় প্রতিটা ভোর আমাদের জন্য অধিকতর দুঃসহ ও ভারী হয়ে উদিত হয়। শুধু মাত্র আমাদের এই আলবাশারাত ওয়াদিটাই যা একটু ভালো আছে। এখানে এখনো রাহিবরা তাদের না-পাক নাক গলাতে পারছে না। নতুবা পুরো আন্দালুসিয়ার অবস্থা হচ্ছে চাঁদনি রাতে পত্রপল্লবহীনতার বেদনায় কান্নারত শুকিয়ে যাওয়া বৃক্ষের ন্যায়। জালিম রাহিবদের আদালত যখন ইচ্ছা পুরণো বই এর মতো মুসলমানদের ছিঁড়ে ফেলছে। এরা সভ্যতা নামক কালো জিন্দান খানায় ঢুকিয়ে মুসলমানদের সব কিছু খুলে নিয়ে তাঁদেরকে সম্পূর্ণ উদুম করে ফেলছে। আজ প্রতিটি আত্মা এই প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে— আসে কিনা আলমে ইসলামের এমন কোনো বীর, যে শক্তি আর সাহসের সাথে মোকাবেলা করে এ দেশটাকে পুনরায় আমাদের বসবাসযোগ্য করে তুলবে।

– সা’দ আবার একটু নিয়ে বলতে লাগলেন, বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে দুটি বড় হুকুমত রয়েছে। একটি তুর্কদের অপরটি ইরানীদের। তুর্কদের সুলতান হচ্ছেন সেলিম বিন বায়েজিদ আর ইরানীদের বাদশাহ হচ্ছেন ইসমাইল সাফাবি। কিন্তু ওরা মিল্লাতের ভালোমন্দ নিয়ে ভাবছেন বলে মনে হচ্ছেন না। ওরা যদি পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দালুসিয়ার মুসলমানদের সাহায্য করার ইচ্ছা করতেন তা হলে আমার বিশ্বাস; কেবল মুসলমানদেরকে নাসারাদের হাত থেকে মুক্তি দেয়াই নয় বরং আন্দালুসিয়ার হারা ঐতিহ্যও তারা পুনরোদ্ধার করতে পারতেন। কিন্তু ওদিক থেকে যেসব খবর আসছে তা বড়ই বেদনাদায়ক। শুনতে পাচ্ছি সুলতান আর শাহের মধ্যকার শত্রুতা উত্তরোত্তর বেড়েই চলছে। যদি প্রাপ্ত এ দুঃসংবাদটা সঠিক হয় তাহলে আমি বলতে পারি পুরো মুসলিম উম্মাহর জন্য বোধহয় আন্দালুসিয়ার পরিণতি অপেক্ষা করছে।

– সা’দ বিন সালামা আবার একটু বিরতী নিলেন; এরপর হাসান ক্রুসুকে লক্ষ করে বললেন: কা’ব বিন আমির তোমার কাছ থেকে খাইরুদ্দীন বারবারুসা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। এবার আমিও তোমাকে অনুরোধ করছি যেহেতু তুমি তাঁর উল্লেখযোগ্য একজন সাথী তাই তাঁর ব্যাপারে আমাদেরকে যতটুকু বিস্তারিত সম্ভব জানতে দাও।
– তরুন রাহিব লিসাঙ্কু যিনি মূলত হাসান ক্রুসু, যিনি একজন জাতিপ্রেমী মুসলিম, যিনি বারবারুসার অন্যতম একটি তির, কিছুক্ষণ মাথা নুয়ে ভাবতে লাগলেন, এরপর সর্দারদ্বয়কে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন-
– আমার মুহতারাম সর্দারদ্বয়! খাইরুদ্দীন বারবারুসার জন্ম লাযবিসে। তাঁর মূল নাম খিযির। তাঁর পিতার নাম ইয়াকুব। খাইরুদ্দীনরা চার ভাই। সবার বড় ইসহাক, তাপর ইলইয়াস, তারপর উরুজ, আর সবার ছোট খিযির। তার বড় ভ্রাতৃত্রয়ের পেশাও ছিল সাগরে নৌবহর পরিচালনা করা। শৈশবে খাইরুদ্দীন লোহা পিটিয়ে সোজা করা তথা কামারের পেশা গ্রহণ করেছিলেন। এ ছিল সে সময়ের কথা— যখন ইউরোপীয়রা সাগরে জলদস্যুতাকে তাদের পেশা বানিয়ে নিয়েছিল। এই পেশার সাথে জড়িত একদল লোক এক নৌযুদ্ধে খাইরুদ্দীনের ভাই হত্যা করে ফেলেছিল।

– তার মৃত্যুর পর খাইরুদ্দীনের বড়ভাই উরুজ সাগরে মাল্লাগিরীর পেশা বেছে নিয়েছিলেন। উরুজ ছিলেন ঝানু একজন এডমিরাল। তাঁর দাঁড়ি ছিল আগুনের শিখার মতোই লাল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত উদার হস্ত ও উদার দীলের অধিকারী। তিনি বিভিন্ন দ্বীপে হিস্পানীয় নৌদস্যুদের সাথে মোকাবেলা করে যাচ্ছিলেন। এ সব লড়াইয়ে তাঁর একটা হাত কাটা পড়ে গিয়েছিল। এরপর তিনিও জলদস্যু আর হিস্পানীয় নৌডাকাতদের সাথে লড়াই করতে করতে শাহাদত বরণ করেন। তাঁর মুত্যুর পর তাঁর সবচেয়ে ছোট ভাই খিজির— ইতিহাস যাকে খাইরুদ্দীন বারবারুসা হিসেবে স্মরণ করে থাকবে বড় ভাইয়ের নৌবহর পরিচালনার দায়িত্বভার নিজ কাঁধে তুলে নেন। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পরপরই এমন নির্ভিকচিত্ম আর দুঃসাহসের সাথে পশ্চিম অভিমুখে এগিয়ে যেতে থাকেন যে দুঃসাহসের সাথে তাঁর ভাই উরুজ অগ্রসর হচ্ছিলেন।

– খাইরুদ্দীনের ভাই উরুজের দাঁড়ি লাল থাকায় তাঁর সাথীরা তাঁকে বারবারুসা নামে ডাকতো। যেহেতু খাইরুদ্দীনের দাঁড়িও ছিল ভাইয়ের মতো লাল তাই তাঁকেও তাঁর সাথীরা বারবারুসা নামে ডাকা শুরু করে। খাইরুদ্দীন যখন তাঁর ভাইয়ের নৌবহরের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন আফ্রিকার অবস্থা ছিল অনেকটা অরাজক। সেখানে তখন অনেক শাসকের শাসন চলছিল। তিলমিসানের শাসকের নাম ছিল আবু হামু। সে খাইরুদ্দীনের ভাইয়ের বিরোধী হওয়ায় ছিল খাইরুদ্দীনের বিরোধীতা করে গেছে, এখনও যাচ্ছে। আল জাযায়েরের যে অংশে হিস্পানিয়রা তাদের দখল প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিল সেখানকার এক বড় কমান্ডার মূন কিড বড় একটা বাহিনীর কমান্ডিং করছে। সে ওখানকার শাসকও। এ ছাড়া কুকু শহরের অধিপতি ইবনে কাজিও বারবারুসার চরমতম শত্রু। আল জাযায়েরের পাশেই পানুন নামে একটা বড় দ্বীপ আছে ওখানে ছিল একটি মজবুত দুর্গ। ওখানেও হিস্পানীয়দের বড় একটি বাহিনী বসবাস করছে। দ্বীপটা হিস্পানীয়দের অস্ত্রের ভাণ্ডারস্বরূপ ব্যবহৃত হচ্ছে। ওখানে তাদের নৌবহর আর সৈন্যদের কমান্ডিং করছে ডনমার্টন নামক এক জেনারেল। সে সব সময় মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লেগেই আছে। এ ছাড়াও বারুবারুসা আর ভাইয়ের সবচেয়ে জঘন্যতম শত্রু হচ্ছে তিউনিশের মুসলিম শাসক হাসান। এদের ছাড়াও তাঁর শত্রুর অভাব নেই। সারশালের শাসকও আমাদের শত্রুদের মধ্যে অন্যতম একজন। পুরো আফ্রিকায় আমাদের একজন মাত্র সহযোগী রয়েছেন।

– আমি আপনাদের কাছে বিস্তারিতই বলছি। আফ্রিকায় অত্যন্ত যুদ্ধবাজ দুটি কবীলা রয়েছে এদেরকে সুগরা বলা হয়ে থাকে। এদের দুজন নেতা রয়েছেন। একজনের নাম আব্দুল আজীজ, আর অপরজনের নাম আহমদ বিন কাজি। সুগরাবিরা এই দুই নেতার অধীনে। অর্ধেক আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে কাজ করে থাকে আর অর্ধেক আহমদ কাজির নেতৃত্বে।

আহমদ বিন কাজি হচ্ছে আমাদের জঘন্যতম শত্রুদের একজন। সে সর্বদা আমাদের বিরুদ্ধবাদীদের সঙ্গ দিয়ে আসছে। এমনকি সে খাইরুদ্দীনের বিরোধীতায় হিস্পানীয়দের সাথে হাত মেলাতেও কুন্ঠিত হয়নি। কেবলমাত্র আব্দুল আজিজই হচ্ছেন সেই বাহাদূর সর্দার যিনি বিরূপ পরিস্থিতির মোকাবেলা করেও সর্বদা মুসলিম শক্তিকে সহায়তা দিয়ে আসছেন। আফ্রিকায় বলতে গেলে তিনিই আমাদের একক সহযোগী। যেদিন থেকে খাইরুদ্দীন তাঁর ভাইয়ের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন সে দিন থেকেই সারশাল এবং তিউনিশের শহরগুলোতে আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জেগে উঠেছে। আর সেই বিদ্রোহে কুকু শহরের অধিপতি ইবনে কাজি তার সহযোগীদের নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। তিলমিসানের শাসক আবু হামু আমাদের সাথীদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করেছে। ফলে আল জাযায়েরের যেসব এলাকা আমাদের অধীন ছিল সেসব এলাকা আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে।

বর্তমান অবস্থা হচ্ছে বারবারুসা তাঁর সঙ্গীসাথীদের নিয়ে পূর্ব দিকে পিছিয়ে গিয়েছেন। তিনি ইতোমধ্যে তুর্কী সুলতান সেলিমের কাছে সাহায্য চেয়ে একদল প্রতিনিধি প্রেরণ করেছেন। যাতে সুলতানী সহায়তার মাধ্যমে আফ্রিকায় হিস্পানীয়দের সহযোগী মুসলিম শক্তিদের মোকাবেলা করে তাদের হাতে নির্যাতিত মুসলমানদের প্রতিশোধ তুলা যায়। শুধু প্রতিশোধই নয় এদেরকে পদানত করে আফ্রিকায় মুসলমানদের শাসনকে মজবুত করারও স্বপ্ন তিনি দেখছেন।

এখন আমরা অপেক্ষায় আছি সুলতান আমাদের এই আবেদনে কী সাড়া দেন। তিনি আমাদেরকে কতটুকু সাহায্য করতে রাজি হন।
– এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই আমার আমীর আমাকে হিস্পানিয়ায় প্রেরণ করেছেন। আমাকে প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করার কারণ হচ্ছে আমার জন্ম এখানে। আমি এখানকার অধিকাংশ এলাকা চিনি এবং এখানকার মানুষের মনোভাবও অনেকটা জানি। আমি যে প্রক্রিয়ায় যে বেশে হিস্পানিয়ায় প্রবেশ করেছি এর বিস্তারিত আমার সাথী আপনাদেরকে অবহিত করেছেন। আমি গ্রানাডা ছাড়াও আন্দালুসিয়ার বড় বড় গির্জায় গিয়েছি। যেহেতু আমি আফ্রিকার সবচেয়ে বড় বিশপ লুইসের পুত্রের পরিচয়ে নিজেকে প্রকাশ করেছি তাই যেখানে গিয়েছি সেখানেই আমাকে যথেষ্ট কদর করা হয়েছে। এখানেও যেহেতু রাহিবদের খানকা রয়েছে সে হিসেবেই এখানে আমার আগমন হয়েছে। আমার ধারণা এখানকার এই বেশ আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য খুবই সহায়ক হবে। আমি যে গুরুত্বপূর্ণ কাজের উদ্দেশ্যে এসেছি তা ইতোপূর্বে আপনাদের কাছে তুলে ধরেছি। আবারও বলছি আপনারা রাহিব পল্লীর রাহিবদের সহায়তায় হিস্পানিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে নির্যাতিত মুসলমানদের আপনাদের এখানে স্থান দিয়ে জেলে পল্লী পর্যন্ত পৌঁছাবার চেষ্টা করবেন। ইন শা আল্লাহ আমরা তাদেরকে সেখান থেকে উদ্ধার করে আফ্রিকায় কিংবা কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবো।

– এ পর্যন্ত বলে হাসান ক্রুসু নীরব হয়ে গেলেন। তার মাথাটা ঝুকে পড়েছিল। বেশ কতক্ষণ নীরব থাকার পর কাঁপা কন্ঠে বলতে শুরু করলেন-
– আমার জাতির মুহতারাম সরদারদ্বয়! আমাদের প্রিয় আন্দালুসিয়া; একসময় যা ছিল আমাদের শৌর্যবীর্যের উৎসভূমি সময়ের অত্যাচারী পাঞ্জা আমাদের গলায় গোলামীর মালা পরিয়ে আমাদের ওষ্ট থেকে গোলাবের হাসি ছিনিয়ে নিয়ে সে ওষ্টটাকে বিরস ও ফ্যাকাশে করে রেখেছে। যে জাতি শ্রেণী বৈষম্যের শিকার হয়ে পড়ে, যাদের মধ্যে জাতির উত্থান অপেক্ষা কাবায়েলী আসাবিয়্যাহ অগ্রাধিকার পায় সে জাতির সামগ্রিক জীবন উজাড় হতে সময় লাগে না।

– যে জাতি তার জাতীয় ঐক্যের সাথে বিদ্রোহ করে শতধা বিচ্ছিন্ন হয় যায়, যারা নিজেদের জন্য ভুল ব্যক্তিদেরকে নিজেদের শাসক হিসেবে নির্বাচন করে নেয় তারা ভালোমন্দের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তাদের কপালে তখন্দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই লেখা হয় না।

– আমাদের প্রিয় আন্দালুসিয়াবাসী সেই অভিশাপের শিকার হয়েছে। এখানকার মুসলমানরা জাতীয় ঐক্য দৃঢ় করার পরিবর্তে কাবায়েলী আসাবিয়্যায় লিপ্ত হয়ে তারা প্রকারান্তরে দুর্বলতা আর গোলামীকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসেছে। এর পরিণামেই উত্তরের দুর্বল শক্তি ছোট ছোট শক্তিগুলোকে একত্রিত করে মুসলমানদের দেশ ছাড়া করার তদবির করতে থাকে। কিন্তু আমরা আসাবিয়্যাহ এতোটাই অন্ধ হয়ে পড়েছিলাম যে, চোখের সামনে বিপদ দেখেও সতর্ক হবার গরজ অনুভব করিনি। আমরা ছিলাম গাফতির নিদ্রায় বিভোর।

– আমার কওমের সম্মানিত নেতৃদ্বয়! শুধুমাত্র দেশ থেকে বিতাড়নের মধ্যেই যদি আন্দালুসিয়ার মুসলমানদের দুর্ভাগ্য সীমীত থাকতো তাহলে অতোটা দুঃখ লাগতোনা। কিন্তু সে দুর্ভাগ্যটা এরচেয়ে বড় আকারে প্রকাশ পাচ্ছে। এখানকার প্রতিটি মুসলমানদের জবরদস্তিমূলকভাবে নাসারা বানিয়ে নেয়া হচ্ছে। যদিও জোরপূর্বক নাসারা হওয়া মুসলমানরা দীলে দীলে এখনর নিজেদের মধ্যে মুসলমানিত্ব লালন করে চলছেন। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম কি আর মুসলমান থাকবে। এ জন্যেই আজ প্রয়োজন নিগৃহিত এই মুসলমানদের উদ্ধার করে কোনো মুসলিম রাষ্ট্রে পৌঁছে দেয়া।

– এ লক্ষেই মুহতারাম আমীর খাইরুদ্দীন বারবারুসা চাইছেন আন্দালুসিয়ার সে সমস্ত মুসলমান নাসারা হতে রাজি না হবার অপরাধে নির্যাতিত হচ্ছেন তাঁদেরকে এখান থেকে উদ্ধার করে আফ্রিকার কোথাও আবাসিত করবেন। আমরা যারা তাঁর সাথে রয়েছি আমরা এ কাজকে আমাদের উপর ফরয হিসেবে শুমার করছি। আমার বিশ্বাস এই মহৎ কাজে আমরা আপনাদের যথাযথ সহায়ত পাব।

– হাসান ক্রুসুর আবেগপূর্ণ দীর্ঘ এই বক্তব্য শুনে কেবল মুনযির বিন যুবাইর আর রাহিব বুট্রুসের অবস্থাই বিষন্ন হয়নি বরং সর্দারদ্বয়ের চোখ দুটোও অশ্রুসজল হয়ে উঠে। এরপর কাহতানী সর্দার কা’ব বিন আমির হাসান ক্রুসুকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করেন-
– “বেটা হাসান! তুমি আমার পুত্রের মতো। যখনই তুমি এ হাবেলিতে আসবে তখনই তোমাকে আমি পুক্রজ্ঞানে বরণ করবো। আমি আর সা‘দ বিন সালামা তোমার সাথে অঙ্গীকার করছি বিভিন্ন এলাকা থেকে লুন্ঠিত ও অত্যাচারিত মুসলমানরা যখনই আমাদের এই আল বাশারাতে এসে পৌঁছাবে আমরা তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাই শুধু করবো না বরং নিরাপদে তাদেরকে জেলে পল্লী পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার সবধরনের ব্যববস্থা গ্রহণ করবো”।

– কা’ব বিন আমিরের কথা শুনে হাসান ক্রুসুর ওষ্টে হাল্কা তাবাস্সুম খেলে গেল। তিনি তাঁর আসন থেকে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন-
– “আমি মনে করছি যে মাকসাদ নিয়ে আমি আন্দালুসিয়ায় প্রবেশ করেছিলাম সে মাকসাদে আমি শতভাগ কামিয়াব। এবার আমি চলে যাচ্ছি। কেননা আমি আমার কাজ সফলভাবে আঞ্জাম দিতে পেরেছি”।

– হাসান ক্রুসু আর রাহিব বুট্রুস যখন উঠে দাঁড়ালেন তখন কাব বিন আমির এবং সা‘দ বিন সালামাও উঠে দাঁড়ালেন। সা‘দ হাসানের দিকে কতক্ষণ গভীরবাবে তাকিয়ে আপনজন হারানোর মতো কন্ঠে বললেন: প্রিয় বৎস তুমি আর কতদিন এখানে অবস্থান করবে?
– হাসান ক্রুসুও তাঁর দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বললেন-
– “এখন আর এখানে অবস্থান করার কোনো প্রয়োজন আমার নেই। আমি যে মাকসাদ নিয়ে এসেছিলাম আপনাদের সাথে সাক্ষাতে তা পূর্ণতায় পৌঁছে গেছে। আমি আজ রাতের ভেতরেই সমুদ্র উপকুলে চলে যাব এবং যে কিশতিযোগে এসেছিলাম সেই কিশতিযোগেই ফিরে যাব। কারণ আফ্রিকার দিকে আমাদেরকে এখন গভীরভাবে নজর দিতে হবে”। এ কথাগুলো বলার পরপরই হাসান ক্রুসু কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলেন। ব্র“ট্রুস, মুনযির বিন যুবাইর, কা’ব বিন আমির এবং সা‘দ বিন সালামাও তাঁর পিছনে পিছনে চললনে।

– হাসানকে নিয়ে তারা সবাই যখন হাবেলির আঙিনায় এসে পৌঁছলেন ওমনি দেখতে পেলেন সর্দার কা’ব বিন আমিরের দু মেয়ে নাবিল আর মা‘আয তাদের গোলাম বাসিত সহ ঘোড়া দৌড়িয়ে হাবেলিতে ঢুকছে। মা‘আয বয়সে কিশোরী হলেও সে ছিল একজন ঝানু ঘোড় সওয়ার। রাহিবদ্বয়কে বেরিয়ে যেতে দেখেই সে তার ঘোড়াকে হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে এসে সেখানে উস্থত হলো। রাহিবদ্বয়ের উপর নজর পড়তেই চেহারার রঙ পরিবর্তন হয়ে গেল। তার সুরমা জরিন চোখ থেকে আগুনের হল্কা বের হতে লাগলো। প্রতিশোধের জ্বলন্ত আগুন যেন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলে। সে ভয়ঙ্কর কন্ঠে হাসান ক্রুসুকে লক্ষ করে বলল-
– তোমরা রাহিবরা মুসলমানদের বস্তিগুলোতে চিল আর কাকের মতো কী তালাশ করে বেড়াও? তোমরা নিরপরাধ মুসলমানদেরকে কালিসার জিন্দানখানায় এবং রাহিবদের ইহতেসাবি আদালতে নিয়ে কেন নির্যাতন কর? কেন তাদের সম্পদ ছিনিয়ে নাও? যাদের কাছে সম্পদ থাকে না তাদেরকে কেন নাসরানিয়াত গ্রহণে বাধ্য কর? এটাই কী তোমাদের ধর্মের শিক্ষা? এটাই কি তোমাদের মানবতার তাকাযা? তোমরা আমাদের হাবেলিতে কী নিতে এসেছো? কী দেখতে এসেছো? তোমরা কি এটা দেখতে এসেছো যে, স্বাধীনতা হারানোর পর গোলামীল জামা পরে আমরা কেমনতর জীবন যাপন করছি?

তোমরা সীমা লঙ্গল ছেড়ে দাও! আমাদের আশা নিরাশার ঘরকে আর বিরান করতে এসো না। তোমরা আমাদের অন্তরে পরাজয়ের অনুভূতি জাগিয়ে, আমাদের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য ছিনিয়ে নিয়েও কি শান্ত হওনি? কেন তাহলে আমাদের শেষ শক্তিটুকুও বরবাদ করে দেয়ার জন্য মাথা বেধে লেগে আছো?

মুসলমানদের উপর মিথ্যে আর বানোয়াট অপবাদ চাপিয়ে কেন তাঁদেরকে মাটির ডিবির মতো বানাতে চাচ্ছো? কেন আমাদের জীবনের কড়িকাঠে আগুন ধরাতে এতোটা উদগ্রীব হয়ে উঠেছো? কেন তোমরা মানুষ হয়ে আমাদের কাছে হিংস্র পশুর রূপে আবির্ভূত হচ্ছো? তবে জেনে রেখো আমারা এখন জীবনের এমন এক ক্রান্তিকালে এসে দাঁড়িয়েছি যেখানে ভয় ডর বলতে কিছুই নেই। যেখানে হারাবার আর কিছু নেই। যেখানে আছে কেবল বেঁচে থাকার অদম্য এক আকাঙ্খা। আমরা এখন আর অতীত নিয়ে কাঁদি না। এখন আমরা বর্তমান নিয়েই ব্যস্ত।

হে রাহিবরা শোনো! এই ভূখণ্ডে তোমরা আর কালিসাসমূহের পাদ্রীরা হচ্ছো আগুন আর গরম পানি বর্ষণকারী। অসহায় মায়েদের কোলে শিশুর মৃত্যু দেখে অট্টহাসি দানকারী। স্মরণ রেখো! এ কথাটা দিবালোকের মতো সত্য যে, তোমরা হচ্ছ খারাপ কাজের পয়গাম্বর। তোমরা হচ্ছো মরুর পিপাসা। তোমরা জ্বলন্ত আগুন। তোমরা হচ্ছ জঘন্যতার প্রতিচ্ছবি। তোমরা হচ্ছ আজাবের সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি।

আমি জানি না তোমরা কোন কুৎসিত ইরাদা নিয়ে আমাদের এই হাবেলিতে পা রেখেছো। তবে স্মরণ রেখো তোমরা যদি এই হাবেলির কারো নামে কোনো অপবাদ আরোপ করতে চাও তাহলে ফারদিশ নদীর কিনারে গড়ে ওঠা তোমাদের পল্লীর একটা খানকাও বাঁচবে না। আমরা সেখানে আগুন লাগিয়ে তা চিরদিনের জন্য মিটিয়ে দেব। সেই খানকাগুলোতে বসবাসকারী কোনো রহিবও প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে না। এবার তোমরা দ্রুত এখান থেকে সড়ে পড়। আগামীতে কখনো যেন এই হাবেলিতে তোমাদের ছায়াটুকুও না দেখি”।

– মা‘আয এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু বিরতী নিয়েছিল। সে আরো কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু তার পিতা কা’ব বিন আমির তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন: “মা‘আয! কথা বলতে হুঁশ রাখা চাই। তুমি জযবায় আক্রান্ত হয়ে সম্মানিত এই রাহিবদ্বয়কে অপমান করছো। এরা আমাদের মেহমান। শ্রদ্ধার পাত্র”। কা‘ব বিন আমির আর বলতে পারলেন না। তাকে জোর করে থামিয়ে দিয়ে মা‘আয বলে উঠলো-
– “শ্রদ্ধেয় আব্বা! যে রাহিবরা স্থানে স্থানে আমাদের নিরপরাধ ভাইদের রক্ত বহাতে উদগ্রীব। যারা মিথ্যে অপবাদ আরোপ করে মুসলিম যুবকদেরকে ইহতেসাবী আদালতে নিয়ে মানবতাহীন শাস্তি দিয়ে থাকে। যারা কালিসার জিন্দানখানায় নিয়ে মুসলমানদের গায়ে গরম লোহা দাগিয়ে অসহায় মুসলমানদের কষ্ট দেখে অট্টহাসি দিয়ে থাকে, এদেরকে আপনি সম্মানিত বলছেন। দুঃখিত আব্বা! আমি এদেরকে পশু হিসেবে শুমার করতেও লজ্জাবোধ করি।

– কা’ব বিন আমির তাঁর সামনে জাতির জন্য নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিটিকে নিয়ে মা‘আযের এ চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি শুনে তাকে শক্ত করে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন: কিন্তু তাঁর আগেই হসান ক্রুসু তাঁর ও মা‘আযের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলেন-
– “মুহতারাম সর্দার! তাকে বলতে দিন। সে হচ্ছে এক নাদান ও অদূরদর্শি বালিকা। সে যা বলেছে আমি মনে এ কেবল তার কথাই নয় এ হচ্ছে পুরো আন্দালুসিয়াবাসীর দীলের আওয়াজ। সে মোটেও কোনো মিথ্যা বলেনি। মা‘আয যা বলছে তার প্রতিটি কথা প্রতিটি শব্দ এখানকার মানুষের অনুভব ও অনুভূতির প্রতিনিধিত্ব করছে। তার এ কথাগুলোর মধ্যে আমি মুসলিম আন্দালুসিয়ার অতীতকে ঝিলিক দিয়ে উঠতে দেখছি। তাকে দীল খুলে বলতে দিন। সে বলে তার দীলটাকে হাল্কা করে নিক। তার ভেতর জযবার যে তুফান বইছে তাকে কিছুটা বের হতে দিন। তাকে কোনো দোষারোপ করবেন না”। এ কথা বলার পরপরই হাসান ক্রুসু মাথা নুইয়ে ফেললেন: অতঃপর মাটির দিকে তাকিয়ে মা‘আযকে লক্ষ করে বলতে লাগলেন-
– “আমার শ্রদ্ধেয় গুরুজন কা’ব বিন আমিরের বেটি মা‘আয! আমরা দুঃখিত যে আমাদের আগমন তোমার অন্তরে কষ্ট জাগিয়ে তুলেছে”। এ কথাটুকু বলেই হাসান ক্রুসু ইবনে যুবাইর এবং বুট্রুসকে সাথে নিয়ে দ্রুত হাবেলি থেকে বেরিয়ে গেলেন। মা‘আয হতবাক হয়ে তাদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল। কেননা সে যে কঠিন কথা বলেছিল তার বিপরীতে একজন রাহিব এতোটা নরম কথা বলবে এ তার কল্পনায়ও ছিল না।

আরও পড়ুন, সমুদ্র ঈগল ২ (ক)

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...