শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ দুপুর ১২:৪৭
Home / ইউরোপ / লন্ডনের ছানু মিয়া!

লন্ডনের ছানু মিয়া!

সৈয়দ তাহমীম :

এক. ছানু মিয়াকে নিয়ে কিছু একটা লিখতে হবে এটা কখনো ভাবিনি। কিন্তু মনে হলো ছানু মিয়াকে নিয়ে যদি না লিখি তবে বৃটেনের একটি প্রজন্মের বেড়ে ওঠা,পূর্ব প্রজন্মের আলতাব আলীদের মার খাওয়ার ঘটনা থেকে ‘মার দেওয়ার’ রুপান্তর করা একটি প্রজন্মকে অস্বীকার করা হবে।

আশির দশকে আমরা যখন স্কুলে থাকতে ‘যায় যায় দিন’ পড়ি তখন আমাদের প্রথম প্রেম। সেই পত্রিকায় কলাম লেখেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী ,মরহুম এম আখতার মুকুল।

লন্ডনের জনমত, সুরমায় ছাপা হয়ে এগুলো যায় যায় দিনে যায়। সেই সময় লন্ডনে এম আখতার মুকুল একটি কলাম লেখেন -“লন্ডনে ছক্কু মিয়া”। সে সময় দেশে বিদেশে বিশেষ করে লন্ডন,নিউইয়র্ক,সিলেটে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে যে মানুষগুলো বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে জাহাজে করে লন্ডন এসেছেন তাদের।

tahmim
লেখক: সৈয়দ তাহমীম

ঢাকা থেকে যে মানুষগুলো পড়তে আসেন তারা আশ্রয় নেন সিলেটের রেস্টুরেন্টগুলোতে। কাজ করেন রোজগার করেন। অবলীলায় ভুলে যান এই ‘কামলা’ মানুষদের। আর এখন তো আছে ব্রিকলেনে শহীদমিনার। ঢাকা থেকে যে বুদ্ধিজীবী আসেন তারা “শ্লাগা” অনুভব করেন আহা রে ‘বাংলাটাউন’। কিন্তু তারা জানেন না এই বাঙালীদের, এই এশিয়ানদের অধিকার আদায়ের জন্য ব্রিকলেনের এই পার্কে ‘আলতাব আলী’কে প্রকাশ্যে জবাই করেছে বর্ণবাদীরা। বাঙালিরা নামাজ পড়তে পারতেন না, টুপি খুলে নেওয়া হতো। তাদের ছেলেমেয়েরা ‘বুলিইং’ এর কারণে স্কুলে পড়তে পারতো না। সে সময় কুকুরের ভয়ে অনেকেই স্কুল ছেড়েছিলেন। ‘ডগ অ্যাক্ট’ এর আগ পর্যন্ত অনেক বাবা মাই সেসময় কুকুর নিয়ে আসতেন।

এই ছানু মিয়াদের প্রজন্ম ঘুরে দাড়ায়। কামাল (আততায়ীর হাতে নিহত)রা, আশিকরা, মতবরা, সাবুলরা ঘুরে দাড়ায়। ‘গ্যাঙ্গ অব নিউইয়র্ক’  এর ‘ডি কেপরিও’র কারেক্টারের নাম হয় সেই সময়ের ‘ছানু মিয়া’ । পূর্ব লন্ডনের ছানু মিয়া।

দুই. আশির দশকের শুরুতে ভাষাসৈনিক তাসাদ্দুক আহমদের নেত্বত্বে বিলেতে শুরু হয় ভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। আবারও ঐ সাধারন বাঙালি। সিলেটের গ্রামের মানুষ। বিলেতের রাস্তাগুলোতে শোভা পেতে শুরু করেছ বাংলা হরফ। বাংলা ভাষা স্থান পায় ও লেভেল,এ লেভেলে। আশির দশকে ও নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাঙালিরা যখন একটু থিতু হয়েছে, সে সময় এই হরফগুলো হারিয়ে যায়। ইস্ট লন্ডন বাঙালিদের জন্য নিরাপদ একটি শহর ছিল।

অভ্যন্তরীণ কলহে হারিয়ে যায় বাঙালির এমপি হওয়ার স্বাদ। ২০০৮ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ছানু মিয়ারা তখন বেড়ে উঠছেন। বাবারা কঠোর পরিশ্রম করছেন,দেশে টাকা পাঠিয়ে পরিবার ভাই ভাতিজা চালাচ্ছেন। সেই সময় পরিবারের বড় ছেলেরা রেস্টুরেন্টে কাজ করে। বাবার সঙ্গে সংসার চালায়। ছানু মিয়ারা ছিলেন এই দলে। লন্ডনের এই গ্রামীন বাবা চাচারাই রুটি রুজির সাথে, ব্যবসার সাথে তাদের “দেশী কালচার” নিয়ে আসেন। মসজিদ বানান,মন্দির বানান।

তিন. ছানু মিয়ার মৃত্যুতে আমার ফেসবুক ষ্ট্যাটাসে আমি লিখেছিলাম তিনি এক উপন্যাসের নায়ক। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘রসগোল্লা’ গল্পের ‘ঝান্ডু দা’। রসগোল্লা গল্পে বলা আছে ঝান্ডু দা কখন এলেন,কখন গেলেন, দেশে না বিদেশে এগুলো বলতে নেই।ছানু মিয়াও সেই ঝান্ডু দা। সপ্তাহে,পনের দিনে, মাসে তিনি দেশ বিদেশ ঘুরবেন। তাকে বলতে নেই তিনি দেশে না বিদেশে। ছানু মিয়ার উত্থান নিয়ে ভিন্নমত পোষনকারী বিলেত প্রবাসী লেখক নজরুল ইসলাম বাসন ভাই লিখলেন, ১৯৮৭ সালে নজরুল ইসলাম (সাবেক ভিপি এমসি কলেজ) ছানু মিয়াকে নিয়ে সাপ্তাহিক ‘সুরমা’ অফিসে এলেন।

ছানু মিয়ার মাথা ভর্তি কালো চুল, ফর্সা চেহারা এককথায় সুদর্শন একজন তরুণ, তবে তার মাঝে আমি যেনো শিশুসুলভ এক ধরনের ব্যবহার লক্ষ্য করলাম। তার এই শিশু সুলভ ব্যবহারই মানুষ পছন্দ করতো।

ভাবা যায়? আশির দশকে ছানু মিয়া ফুটবল টুনামেন্ট দিয়েছিলেন আজকের বাংলাটাউন এলাকায়। তার উদ্বোধন করেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছানু মিয়ার “বড়বোন”।

আশির দশকে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা যখন লন্ডনে থাকেন বাঙালীরা তখনো এতো স্বচ্ছল হয়নি, বাঙালীদের গাড়ি হাতেগোনা। তখন ছানু মিয়া ছুটছেন রানারের মতো তার ছাই রং এর ফোর্ড এসকট নিয়ে। আড়াইশ/তিনশ মাইল পথ ‘ভগনর’। লন্ডন থেকে। ‘আপারা’ যাবেন, ছানু মিয়া রেডি। ইয়র্ক হলে শেখ হাসিনার মিটিং এরশাদ সরকারে বিরুদ্ধে। তখনো তিনি আওয়ামীলীগের সভানেত্রী হননি। দেশী বিদেশী এজেন্সীগুলো সক্রিয়। তার (শেখ হাসিনা) মৃত্যুভয়। ব্লাক বেল্ট হোল্ডার ছানু মিয়া রেডী তার দলবল নিয়ে। কিন্তু বরাবরের মতো বৈষয়িক বিষয়ে উদাসিন এই ছানু মিয়া সেই সম্পর্ককের সুত্র ধরে কোন সুবিধা নেন নি বা চান নি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

চার. ছানু মিয়ার সাথে যারা চলেছেন তারা ছানু মিয়ার কথা নিয়ে মজা করতেন। মনে করতেন এটা এক ধরনের ‘ফান’। আসলে এগুলো ‘ফান’ না। তার কানেকশন সত্যি বড় গভীর। সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার তার ব্যাক্তিগত বন্ধু। টনি ব্লেয়ার যখন লেবার পার্টিতে ‘স্লিপ’ নিয়ে হাটতেন ছানু মিয়া তখন ছানু মিয়া তখন লাঞ্চে তার সাথে বিড়ি টেনেছেন। টনি বেন বা পিটার শো লিজেন্ডারী শ্রমিক নেতা। রাত ১২টা একটায় ছানু মিয়ারে ফোন করেছেন, ছানু গাড়ি নিয়া আও (অবশ্যই ইংরেজীতে)। নেলসন ম্যান্ডেলা জেলে। ছানু মিয়া পাগল। উইনি ম্যান্ডেলার সাথে তার সরাসরি যোগাযোগ। উইনি ম্যান্ডেলা লন্ডন আসেন। ছানু উইনিকে নিয়ে লন্ডনে হাঠেন। নেলসন ম্যান্ডেলা লন্ডন এসে ছানুকে জড়িয়ে ধরেন। ছানু বলেন আমি ‘মুজিবর’ এর দেশের মানুষ। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী কাদের সিদ্দিকী তখন ভারতে। ছানু মিয়া কাদের সিদ্দিকীকে দেখতে যান ভারতে। লন্ডনে এসে কাদের সিদ্দিকী ব্রিকলেন ঘুরেন ছানু মিয়া আর চঞ্চলের সাথে। গাফফার চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ফিল্ম বানাবেন। সেটা মনে হয় নব্বই দশকের প্রথমার্ধে। ছানু মিয়া সরাসরি যোগাযোগ করলেন অমিতাভ বচ্চনের সাথে। বোম্বে ছুটলেন। বাউল আব্দুল করিমকে যখন কেউ চিনে না, ছানু মিয়া তৎকালীন বাংলাদেশে নিযুক্ত হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে নিয়ে সুনামগন্জ ছুটলেন। আনোয়ার চৌধুরীর অশ্রুশিক্ত চোখ মিডিয়ায় আসলো আব্দুল করিমের গান শুনে। আরব আমিরাতের প্রিন্স ‘ আল সাবা’র ব্যাক্তিগত বন্ধু ছানু মিয়া। জাহানারা ইমামকে ‘ডিসেবল চেয়ারে’ করে ব্রিকলেন ঘুরেন ছানু মিয়া। লন্ডনে নিয়ে আসেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।ছানু মিয়ার ভাষায়,”আমি ‘ছিরামিষী’র পোলা। আমার গ্রামের সব মানুষকে হত্যা করেছে পাকিষ্তানী আর্মি। আমি বিচার চামু না তো কে চাইবে?”। নব্বই দশকে কাদের সিদ্দিকী, হাসান ইমামদের নিয়ে করেন সর্বকালের বৃহৎ সমাবেশ তার গ্রামে।

পাঁচ. ফেইসবুকে ছানু মিয়ার একটা ছবি ভাইরাল ছিলো বৃটিশ মেরিনের টুপি মাথায় ছানু মিয়া।বাসন ভাই তাকে ‘জেনারেল’ ডাকতেন। প্রায়ই বলতো সেনাবাহিনীর সাথে আমর্স ডিলিং করবে। রাশিয়া যাবে, চায়না যাবে। মিলিয়ন পাউন্ডের ডিল। তার সাথে যারা চলেন তারা ‘হাসেন’। ছানু মিয়া আযম খানকে প্রথম নিয়ে আনেন লন্ডন। তার ভাষায় জেনারেশন চিনুক। বিলেতে প্রথম টিভি ‘বাংলা’ টিভির ওপেনিং পোগ্রামে এরিনার দায়িত্বে ছানু মিয়া। বোম্বে থেকে বাঙালী মিঠুন চক্রবর্তীকে নিয়ে এসেছেন। বাউল কালা মিয়া,সাজ্জাদ নূর,মামুন এদেরকে পরিচিত করান। সব থেকে বড় কথা হলো আশির দশকের মেইন স্ট্রিম মিডিয়ায় চ্যানেল ফোর এর মাধ্যমে তুলে ধরেন বিলেতের যুদ্ধাপরাধীদের কথা।

বৃটিশ মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার রুহুল আমিনরা ছানু মিয়ার সাথে চলেন। এভাবেই গুড মর্নি ঢাকা বলে হারিয়ে যান আমাদের ছানু মিয়া। হয়তো একদিন রুহুল আমিন বা বৃটেনে বড় হওয়া কোন ‘করণ জহর’ ছানু মিয়ার বৈচিত্রময় জীবন নিয়ে ইংলিশ কোন মুভি বানাবে। অস্কারপ্রাপ্ত গ্ল্যাডিয়েটর মুভির ‘ম্যাক্সিমাস’ (রাসেল ক্রো) চরিত্রের মতো ছানু মিয়ার মৃত্যুতে  বড় কোন ষ্টেডিয়ামে দাড়িয়ে রোমান সম্রাট মার্কোস ওরেলিয়াসের মেয়ে লোসিলা র মতো তার বোন শেখ হাসিনা বলে উঠবেন, “Is Rome worth one good man’s life who we believed in once ? Make us believe it again . He was soldier of Rome.Honour him.”

লেখক : সৈয়দ তাহমীম, বিলেত প্রবাসী সলিসিটার, কলাম লেখক এবং নব্বই দশকের সাবেক ছাত্রনেতা।

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

আজ ঐতিহাসিক ১৮ই এপ্রিল!

মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আল-মামুন:: আজ ১৮ এপ্রিল, বাংলাদেরশের ইতিহাসে একটি বিজয়ের দিন। ২০০১ সালের এই দিনে ...